প্রবাস

গুণী মানুষদের প্রেমে মেয়েরা যুগে যুগে পাগল হয়েছে

বইটার ফ্ল্যাপে লেখা আছে– ‘সুসং দুর্গাপুরের চন্ডিগড় গ্রামে ছবি বানাতে গেছেন একজন বিখ্যাত পরিচালক। ছবির নাম আমার আছে জল। বিরাট ইউনিট, বিরাট কর্মকাণ্ড। ছবিতে প্রথম কাজ করতে এসেছে রুমালী নামের এক কিশোরী। ছবি বানানোর এই বিপুল আয়োজন, এই বিশাল কর্মকাণ্ড সে দেখছে অবাক বিস্ময়ে। সে এক সময় ছবির গল্পের সঙ্গে মিশে যেতে শুরু করল। তার মনে হতে লাগলো সে রুমালী নয় সে আমার আছে জল-এর কিশোরী নায়িকা, দিলূ। শুরু হল বিচিত্র এক মেটামরফোসিস। রুমালীর গল্প এক অস্বাভাবিক রূপান্তরের গল্প। লাগাম-হীন তীব্র আবেগের গল্প, তীব্র হাহাকারের গল্প, অমোঘ নিয়তির গল্প। সে নিয়তির কাছেই আমাদের সকল সমর্পন।’

Advertisement

বইটা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯৭ সালে। যতদূর মনে পড়ে আমি পড়েছিলাম ১৯৯৮ সালে বন্ধু শাহেদের কাছ থেকে ধার নিয়ে। তখন আমরা সবেমাত্র কলেজের চৌহদ্দি পার হয়েছি। তাই এই উপন্যাসের আগামাথা কিছুই বুঝিনি। কিন্তু এই বয়সে পড়তে গিয়ে আবারও স্বীকার করতে বাধ্য হলাম হুমায়ূন আহমদ’র কোনো মোটা বইই খারাপ না। খারাপ না বলতে আমি আমাদের দেশের সাহিত্যিকদের মতামতকে বুঝাচ্ছি। কারণ তাদের মোতো তিনি কিসব ছাইপাঁশ লেখেন।

এমনকি এখনকার অনেক উঠতি লেখককে হুমায়ূন আহমদ’র নাম শুনে নাক সিঁটকাতে দেখেছি। তখন আমার মনে একটাই প্রশ্ন জাগে, সেটা হলো এই জীবনে যে প্রথম গল্পের বই বা উপন্যাস কোনটা পড়েছিলেন। আমি মোটামুটি নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি সেটা হবে হুমায়ূন আহমেদ'র কোন বই।

বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জীবনকে গভীরভাবে দেখার এবং বোঝার এক অসম্ভব ক্ষমতা ছিল হুমায়ূন আহমেদের। পাশাপাশি বাংলাদেশের নদী-জল, শ্যামল-প্রকৃতি সবই উঠে আসতো তার রচনায়। এই উপন্যাসেও তার ব্যতিক্রম নেয়। এছাড়াও এই উপন্যাসে মানুষের মনের গভীরে আলো ফেলা হয়েছে। বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে মানুষের শরীরবৃত্তীয় এবং মনোবৃত্তিক কার্যপ্রণালীকে।

Advertisement

আমাদের শরীরকে মন নিয়ন্ত্রণ করে না কি মনকে শরীর নিয়ন্ত্রণ করে। এমন প্রশ্নও করা হয়েছে। এই যে বিপরীত লিংঙ্গের প্রতি আমাদের আকর্ষণ তার মূলে কি আছে। সেটারও স্বরূপ সন্ধানের চেষ্টা করা হয়েছে। ভালোবাসা, মায়া, মমতা এইসব কোমল অনুভূতিগুলো কি আলাদা না কি একই অনুভূতির ভিন্ন ভিন্ন নাম। মানুষ কি ক্ষিধের কাছে পরাজিত হয়।

এইসব প্রশ্নের উত্তরও খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে। সবমিলিয়ে অত্যন্ত সুখপাঠ্য একটা বই। বইটা শেষ করার পর বুক থেকে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে যায় নিজের অজান্তেই। বাংলাদেশের প্রকৃতির এক অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল জোনাকি পোকা। এখন বহুল মাত্রায় কীটনাশকের ব্যবহার, বনজঙ্গল ধ্বংস করা আর বিদ্যুতের অতি ব্যবহারের ফলে সেটা আর তেমন দেখা যায় না। এই বইয়ে জোনাকি পোকার বিষয়ে বিস্তারিত লেখা হয়েছে যেগুলো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ইতিহাস হয়ে থাকবে।

বইয়ের ভাষায়, ‘অনেকক্ষণ হলো সন্ধ্যা মিলিয়েছে। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখছি—শত শত জোনাকি পোকা, জ্বলছে নিভছে। কী যে আশ্চর্য হচ্ছি। জোনাকি পোকা আগে দেখি নি তা না। অনেক দেখেছি। কিন্তু এত জোনাকি পোকা এক সঙ্গে কখনো দেখিনি। মনে হচ্ছে থোকায় থোকায় আলোর ফুল ফুটেছে। ফুলগুলো উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। চঞ্চল অস্থির কিছু ফুল। পৃথিবীতে কত অদ্ভুত দৃশ্যই না আছে।’ এই উপন্যাসে ভালোবাসার স্বরূপ সন্ধানে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। অনেক গুণীজন এটা নিয়ে ভেবেছেন। হিসেব নিকেষ করেছেন—— থিওরী বের করেছেন, হাইপোথিসিস দাঁড় করিয়েছেন। ফলাফল শূন্য। কেউ কেউ বলেছেন ভালবাসার বাস মনে। মন যেহেতু আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। ভালবাসাও তাই।

বৈজ্ঞানিকদের কোনো যন্ত্রে ভালোবাসাকে ধরা ছোঁয়া যাবে না। অন্য একদল বললেন— মন আবার কী? মস্তিষ্কই মন। মানুষের যাবতীয় আবেগের একমাত্র নিয়ন্ত্রক মস্তিষ্ক। মস্তিষ্ক ধরা ছোঁয়ার বাইরে নয়— কাজেই ভালবাসাও ধরা ছোঁয়ার বাইরে নয়। ব্রেইনের টেম্পোরাল লোবে ভালবাসা বাস করে। টেম্পোরাল লোবে অসংখ্য নিওরোনের ভেতর দিয়ে ইলেকট্রিক ইম্পালসের বিশেষ ধরনের আদান প্রদানই ভালোবাসা।

Advertisement

আরও পড়ুন

প্রবাসীর বোবা কান্না সিডনির স্বর্গীয় বুশ ওয়াক

আরেকদল বললেন, কিছুই হয়নি। মানুষের আবেগ, ভয়, ভীতি সব কিছুর মূল নিয়ন্ত্রক পিটুইটারী গ্লান্ড। একটা মেয়ে যখন একটি ছেলের প্রেমে পড়ে তখন ছেলেটিকে দেখামাত্র পিটুইটারী গ্লান্ড থেকে বিশেষ এক ধরনের এনজাইম বের হয়। সেই এনজাইমের কারণে ছেলেটি তখন যা করে তাই ভালো লাগে। তা দেখেই হৃদয়ে দোলা লাগে। ছেলেটি যদি ফেং শব্দ করে হাতের মধ্যে নাক ঝেড়ে সিকনিতে হাত ভর্তি করে ফেলে তখনও মনে হয়— আহারে কী সুন্দর করেই না নাক ঝাড়ছে। পৃথিবীতে তার মত সুন্দর করে কেউ নাক ঝাড়তে পারে না।

ভালোবাসার সর্বশেষ থিওরিটি এমন— প্রকৃতির প্রধান ইচ্ছা তার সৃষ্ঠ জীবজগৎ যেন টিকে থাকে। জীব জগতের কোনো বিশেষ ধারা যেন বিলুপ্ত না হয়। জীব জগতের একটা প্রধান ধারা হচ্ছে হোমোসেপিয়ানস মানব জাতি। মানবজাতিকে টিকে থাকতে হলে তাদের সন্তান হতে হবে, এবং উৎকৃষ্ট সন্তান হতে হবে। সন্তান হবার জন্যে মানব-মানবীকে খুব কাছাকাছি আসতে হবে। কাজেই তাদের ভেতর একের জন্যে অন্যের একটা প্রবল শারীরিক আকর্ষণ তৈরি করতে হবে। সেই শারীরিক আকর্ষণের একটা রূপ হচ্ছে ভালবাসা। সেই ভালবাসার তীব্রতারও হের ফের হয়। প্রকৃতি যখন দেখে দুটি বিশেষ মানব-মানবীর মিলনে উৎকৃষ্ট সন্তান তৈরির সম্ভাবনা তখন তাদের ভালোবাসাকে অতি তীব্র করে দেয়। যেন তারা একে অন্যকে ছেড়ে যেতে না পারে। কোনো বাধাই তাদের কাছে তখন বাধা বলে মনে হয় না। ছেলেরা রূপবতী মেয়েদের প্রেমে পড়ে কারণ প্রকৃতি চায় পরবর্তী প্রজন্ম যেন সুন্দর হয়। গুণী মানুষদের প্রেমে মেয়েরা যুগে যুগে পাগল হয়েছে। কারণ প্রকৃতির সেই পুরানো খেলা, প্রকৃতি চাচ্ছে পুরুষদের গুণ যেন পরবর্তী প্রজন্মে ডি এন এর মাধ্যমে প্রবাহিত হয়। প্রকৃতি প্রাণপণে চাচ্ছে মানব সম্প্রদায়ের গুণগুলো যেন নষ্ট না হয়ে যায় যেন প্রবাহিত হতে হতে এক সময় পূর্ণ বিকশিত হয়। তৈরি হয় একটা অসাধারণ মানব সম্প্রদায়।

আমাদের জীবনের আসলে গন্তব্য কোথায় আমরা কি তা জানি না কি সারাজীবন তারই অনুসন্ধান করে বেড়াই। সবার জীবন যেমন এক না আবার লিঙ্গভেদেও জীবনের স্বরূপ ভিন্ন। মেয়েদের মধ্যে মাতৃভাব প্রবল। তাদের কাছে সব খেলনাই সন্তানের মতো। যে কোনো খেলনা মেয়েদের হাতে দিলে তারা সেটা কোলে নিয়ে ঘুরে। জীবনের স্বরূপ সন্ধানী একটা গানের উল্লেখ আছে এই বইতে-

‘‘Down the wayWhere the nights are gayAnd Sun Shines daily on the mountain top.I took a tripOn a sailing shipAnd when I reached Jamaica I made a stop.But I am sad to sayI am on my waywont be back for many a day’’

সব মানুষের আবার জীবনকে দেখার দৃষ্টভঙ্গিও আলাদা। সব মানুষের সৌন্দর্য দেখার এবং ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা আলাদা। সৃষ্টিশীল মানুষের মধ্যে এটা প্রকটভাবে থাকে। প্রকৃতি হয়ত খুব স্বাভাবিকভাবেই এই ক্ষমতা দিয়ে দেয়। যারা এই ক্ষমতাটা পায় তারাও খুব স্বাভাবিকভাবেই নেয়। ক্ষমতার মাত্রা সম্পর্কে তাদের ধারণা থাকে না। তারা চেখ সব সময় খোলা রাখে। অতি তুচ্ছ দৃশ্য ও তাদের চোখ এড়িয়ে যায় না! বইয়ের শেষ কটা লাইন দিয়ে লেখাটা শেষ করতে চাই – ‘বৃষ্টি পড়ছে। ঝড় শুরু হয়েছে। সোমেশ্বরী নদী গর্জাচ্ছে। নদী তার অলৌকিক গলায় ডাকছে— এসো। এসো। সেই আহ্বান সবাই শুনতে পায় না। কেউ কেউ পায়।’ হুমায়ূন আহমেদ নিশ্চয়ই সেই আহবান শুনতে পেতেন।

এমআরএম/এমএস