অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর প্রথম বাজেট-বক্তৃতাটি শোনার পর মনে হতেই পারে যে, এই হলো নানা রকমের শব্দজাল। বাজেট-ভাষণে ভাষার মাধুর্য বেড়েছে, কিন্তু অংক কঠিন হয়ে গেছে। শব্দজাল তৈরি করে দেশের সমস্যা ও সংকট থেকে মানুষের দৃষ্টি সরিয়ে দেওয়ার এক বাজেট দিয়েছেন জনাব আলী।
Advertisement
চরম মূল্যস্ফীতি, ব্যাপক দুর্নীতি, বৈদেশি মুদ্রার রিজার্ভ সংকট, ডলার সংকট, বিনিয়োগ স্থবিরতা, ব্যাংক ও আর্থিক খাতে উচ্ছৃঙ্খলতার মধ্যেই নতুন অর্থ বছরের জন্য বাজেট দিল সরকার। অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ‘সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকার’ শীর্ষক বাজেট প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেছেন যার আকার ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। বিদায়ী অর্থবছরের বাজেট ছিল ৭ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট ৪ দশমিক ৬ শতাংশ বাড়বে। চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরের বাজেট সংশোধন করে ৭ লাখ ১৪ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা করা হয়েছে।
এই বাজেট জিডিপির ১৪ শতাংশের সামান্য বেশি। সাধারণত মধ্যম আয় বা উন্নয়নশীল দেশে বাজেটের আকার জিডিপির ২০ শতাংশের ওপরে থাকে। কোথাও কোথাও ২৫ বা ৩০ শতাংশও থাকে। বছর কয়েক ধরে বাজেটের আকার ১২ থেকে ১৪ শতাংশ পর্যন্ত ফুলে ফেঁপে ওঠার প্রবণতাতে এবার রাশ টানা হয়েছে।
আগের মতোই বাজেটের প্রায় পাঁচ কোটি টাকা বরাদ্দের দুই-তৃতীয়াংশ যাবে অনুৎপাদনশীল খাতে, বেতন, প্রণোদনা, ভাতা ও ভর্তুকি পরিশোধ বাবদ। এছাড়া বিল, বন্ড ও সঞ্চয় সরঞ্জামের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে সরকারের নেওয়া ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ভর্তুকি পাচ্ছে বিদ্যুৎ-জ্বালানি ও কৃষিখাত। বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী ভাতার পরিমাণও কিছুটা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
Advertisement
নিত্যপণ্যের বাড়তি দামের কারণে কষ্টে আছে মানুষ। মে মাসেও মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ শতাংশের কাছাকাছি। সরকারি কর্মচারীরা মূল্যস্ফীতি সমন্বয়সহ তাদের বেতনের সঙ্গে ৫ শতাংশ প্রণোদনা পাবেন, অন্যদিকে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরাসরি রাজস্ব ব্যবস্থা এবারও দৃশ্যমান হয়নি।
প্রস্তাবিত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আসন্ন ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার উচ্চাভিলাষী রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পেয়েছে। আসন্ন বাজেটে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। যার মধ্যে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা এনবিআর সংগ্রহ করবে এবং বাকি রাজস্ব আসবে করবহির্ভূত উৎস থেকে। এনবিআরকে আদায় করতে হবে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২৪) বাজেট লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫০ হাজার কোটি টাকা বেশি। রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৭০ হাজার কোটি টাকা বেশি।
এবারের বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে বৈদেশিক উৎস থেকে ৯০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা সংস্থান করা হবে। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আসবে এক লাখ ৬০ হাজার ৯০০ টাকা। থেকে প্রায় ২ লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।
বিদায়ী অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশ ধরা হলেও এবার তা ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০১৩-১৪ অর্থবছরের পর থেকে ঘাটতি সবসময়ই ৪ দশমিক ৯ শতাংশের বেশি ছিল। লাগামহীন মূল্যস্ফীতিকে বশ মানানোই হবে নতুন অর্থমন্ত্রীর আসল চ্যালেঞ্জ। কেননা সংকোচনমূলক নীতি মেনে চলার পরও দুই বছর ধরে ভোগাচ্ছে মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতি আগামী অর্থবছর শেষে সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার কঠিন লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে সরকার, যদিও শেষ পর্যন্ত তা কতটা পারবেন সেটা সময়ই বলবে।
Advertisement
অর্থনীতি পরোক্ষ করের খড়্গ থেকে বের হতে পারছে না বহু বছর। রাজস্ব আয়ে ভালো প্রবৃদ্ধি নেই। লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ১০ মাসে (জুলাই–এপ্রিল) ঘাটতি আছে ২৬ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব ব্যর্থতা ঢাকতে এবার আরও বেশি আগ্রাসী হয়েছে এনবিআর। সাধারণ মানুষের পকেট থেকে যেভাবে পেরেছে সেভাবে কর বসিয়েছে। প্রতিদিনের জীবনযাপনে ব্যবহৃত হয় এ রকম নানা পণ্য ও সেবার ওপর বাড়তি কর বসেছে। মোবাইল ফোনে কথা বলায় খরচ বাড়ছে, বাড়ছে ইন্টারনেটের খরচ। এলইডি বাতি, এসি, ফ্রিজ, পানি শোধন যন্ত্র, সিসি ক্যামেরা, জুসের দাম সব বাড়তি। মুঠোফোনে কথা বলা ও ইন্টারনেট সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে টকটাইম ও ইন্টারনেট সেবার ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ আছে। এটি আরও ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছে।
মানুষের জীবনধারণ যখন ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে, তখন স্বস্তি দেওয়ার জন্য সাধারণত করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হয়। কিন্তু এবার তা–ও বাড়ছে না। তবে অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থকে বৈধ করার সুযোগ রেখেছে বাজেট। উত্তরাধিকার সম্পদ হস্তান্তরে কর নেই যা ধনী ব্যক্তিদের জন্য সহায়ক। ফ্ল্যাট-প্লট কেনা ও নগদ টাকায় ‘কালোটাকা সাদা’ করার সুযোগও দেওয়া হয়েছে বাজেটে। এই বাজেট তাহলে অবৈধ পথে ধনী হওয়া ব্যক্তিদের জন্যই ভাবনাটা রেখেছে। ধনীদের দিকে নজর রাখতে গিয়ে মূল বিলাসবহুল ক্ষেত্রকে কর কাঠামোর আওতা থেকে বাদ দিয়ে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-আয়ের উপার্জনকারীদের ওপর করের বোঝা বেশি চাপানো হয়েছে।
বাজেট প্রস্তাবনা দেখে মনে হচ্ছে সরকার উচ্চ জিডিপির মোহ থেকে বেরিয়ে এসেছে। বছরের পর বছর উচ্চহারের প্রবৃদ্ধি ধরার রীতি ভেঙে সেই লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে দেশের অর্থনীতি বর্তমানে কিছুটা চাপের মুখে থাকলেও প্রাজ্ঞ ও সঠিক নীতিকৌশল বাস্তবায়নের ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত আছে। ২০০৯-১০ অর্থবছর হতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৭১ শতাংশ; এটি ছিল সেই সময় বিশ্বের যেকোনো দেশের মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ।
অর্থমন্ত্রী বলেন, প্রবৃদ্ধির এই গতিধারা বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্তর্নিহিত শক্তির পরিচয় দেয়। জিডিপি প্রবৃদ্ধির এ গতি আগামী দিনে ধরে রাখার লক্ষ্যে কৃষি ও শিল্প খাতের উৎপাদন উৎসাহিত করতে সব ধরনের যৌক্তিক সহায়তা অব্যাহত রাখা হবে। সেই সঙ্গে প্রয়োজনীয় সব ধরনের নীতি সহায়তা বজায় রাখা হবে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার মধ্যমেয়াদে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশে পৌঁছাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
এইচআর/এমএস