দেশে প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহারযোগ্য (রিসাইকেলিং) করা যায় ৩৬ শতাংশ। এছাড়া ৩৯ শতাংশ ভাগাড়ে জমা হচ্ছে এবং ২৫ শতাংশ নদী-নালাসহ মাটিতে যাচ্ছে। তবে প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহারের হার আগের তুলনায় বেড়েছে।
Advertisement
বিশ্বব্যাপী এ হারের গড় ১০ শতাংশের নিচে। যদিও ইউরোপের দেশে আবার এ হার ৭০ শতাংশের ওপরে। তবে পুনর্ব্যবহারের মাত্রা আরও বাড়াতে হবে। মূলত বাসাবাড়ি ও ভাগাড় থেকে সঠিকভাবে সংগ্রহ না হওয়ায় ব্যবহৃত প্লাস্টিকের বড় অংশই পুনর্ব্যবহারযোগ্য করা যায় না। পাশাপাশি এই খাতের বিকাশে নেই প্রয়োজনীয় সরকারি সহায়তাও।
বুধবার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটের অডিটোরিয়ামে ‘টেকসই প্লাস্টিক বর্জ্য পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিনিয়োগ’ শীর্ষক এক সেমিনারের এসব কথা বলেন বক্তারা।
পরিবেশ দিবস উপলক্ষে প্লাস্টিক প্রোডাক্ট বিজনেস প্রমোশন কাউন্সিল (পিপিবিপিসি) এবং বাংলাদেশ প্লাস্টিক দ্রব্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিজিএমইএ) যৌথ উদ্যোগে এ সেমিনার হয়।
Advertisement
সেমিনারের মূল প্রবন্ধে জানানো হয়, দেশে বর্তমানে ৪০ হাজার কোটি টাকার প্লাস্টিক পণ্যের বাজার রয়েছে। আর নাগরিকেরা বছরে মাথাপিছু ৯ কেজির বেশি প্লাস্টিক ব্যবহার করেন। রপ্তানি হচ্ছে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। এ খাতে সাড়ে পাঁচ হাজার কারখানা রয়েছে, যেখানে সরাসরি ২০ লাখের বেশি কর্মসংস্থান হয়েছে। এভাবে চললে ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বের ৪০তম শীর্ষ প্লাস্টিক রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হবে বাংলাদেশ।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাণিজ্য সচিব সেলিম উদ্দিন। বিশেষ অতিথি ছিলেন বিজনেস প্রোমোশন কাউন্সিলের (বিপিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নাহিদ আফরোজ, এফবিসিসিআই’র সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আমিন হিলালী। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বুয়েট কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের প্রফেসার ড. কাজী বায়েজিদ কবীর। সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন বিপিজিএমইএ সভাপতি সামিম আহমেদ।
বাণিজ্য সচিব বলেন, দেশের প্রত্যেকে এখন প্লাস্টিকের ব্যবহারকারী, এর বিকল্প নেই। যে কারণে এ খাতকে টেকসই করতে হবে। যেসব সমস্যা রয়েছে, সেগুলোকে সম্ভাবনায় পরিণত করতে হবে। সেজন্য সঠিক নীতি সহায়তা প্রয়োজন। সঠিক পলিসি দরকার। এ শিল্পের সঙ্গে সরকারের একাধিক সংস্থা ও মন্ত্রণালয় জড়িত। সবার একসঙ্গে হয়ে কাজ করতে হবে।
আরও পড়ুন:
Advertisement
তিনি বলেন, প্লাস্টিকের সমস্যা সমাধান করতে হলে সবার আগে রিসাইকেলিংয়ের হার উন্নত দেশের জায়গায় নিতে হবে। পাশাপাশি যারা বাসাবাড়ি ও ভাগাড় থেকে প্লাস্টিক পণ্য সংগ্রহ করেন, তাদের জীবনমান উন্নয়নেও জোর দিতে হবে। সেজন্য যারা এ সেক্টরে বিনিয়োগ করেছেন তাদের আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করতে হবে।
বিপিসি প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নাহিদ আফরোজ বলেন, উন্নত বিশ্ব প্লাস্টিক বন্ধ করছে। তবে আমরা এ খাত নিয়ে বড় রপ্তানির সম্ভাবনা দেখছি। ফলে এ খাতকে পুরপুরি কম্পাইন্সের মধ্যে আনতে হবে। আর এ বিষটি ব্যয়বহুল। রাতারাতি করা যাবে না। এজন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা দরকার।
অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচনায় ইউনিলিভার বাংলাদেশের পরিচালক শামীমা আখতার বলেন, সহজলভ্য, দীর্ঘস্থায়ী ও এরমধ্যে পণ্য ভালো থাকার কারণে কোম্পানিগুলোর মোড়কজাতে প্লাস্টিক জনপ্রিয় হচ্ছে। আমরা সবসময় আমাদের বিক্রিত প্লাস্টিক সংগ্রহ করে আবার ফিরে আনতে চাই। তবে একটি উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে দেখেছি, চট্টগ্রামে আমরা ১০ শতাংশ প্লাস্টিক সংগ্রহ করতে পেরেছি। কিন্তু উৎপাদিত প্লাস্টিকের চেয়ে অধিক পরিমাণে প্লাস্টিক সংগ্রহ করার প্রচেষ্টা আমাদের।
তিনি বলেন, দেশে প্লাস্টিক রিসাইকেলিং খাতে যারা কাজ করছেন, যারা সংগ্রহ করছেন, এটি কোনো ভালো পেশা হিসেবে দেখা হচ্ছে না। কারণ তাদের জীবনমান উন্নয়ন হয় না। স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে। এ বিষয়ে প্রচুর কাজ করা দরকার। সেখানে বেশিভাগ নারী, তাদের জীবনমান ও কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের টেকসই অর্থায়ন বিভাগের সাবেক পরিচালক খোন্দকার মোরশেদ মিল্লাত বলেন, ছোট ছোট প্লাস্টিক কারখানায় অর্থায়নের সমস্যার কথা বলা হয়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক মোট মেয়াদি ঋণের ৫ শতাংশ পরিবেশবান্ধব খাতে বিতরণের জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে। টেকসই প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে কৃষি, সিএমএসএমই, পরিবেশবান্ধব কারখানা, সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল প্রকল্পে অর্থায়ন।
আরও পড়ুন:
সবাই মিলে করি পণ, বন্ধ হবে প্লাস্টিক দূষণতবে এসব ফান্ড পেতে সমস্যায় পড়েন কাস্টার সিএমএসএমই খাতের উদ্যোক্তারা। কারণ এ দেশে কোনো তথ্য নেই কে কোন সেক্টরের ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ীও সেটা জানেন না। ফলে তারা সুবিধা নিতে পারছেন না। গত আট বছরে ব্যবসায়ীরা শ্রেণিভূক্ত হননি।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (করপোরেট অ্যাফেয়ার্স) মেজর জেনারেল নজরুল ইসলাম বলেন, প্রকৃতপক্ষেই যাদের সুবিধা প্রয়োজন তারা জানেন না কি ধরনের সুবিধা সরকারি খাতে পাওয়া সম্ভব। যে কারণে এসবের বাস্তবায়ন নেই। এখন খুঁজে দেখা দরকার, সুবিধাগুলো কেন বাস্তবায়ন হয় না, সেটা কাদের জন্য ছিল। ব্যবসায়ীদের নিয়ে ফিনান্সিয়াল ইনিস্টিটিউটগুলো বসুন। আপনারা যে সুবিধা দিচ্ছেন, সেটা যেন সঠিক উদ্যোক্তা নিতে পারেন।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের সিএসআর প্রতিষ্ঠান টেল প্লাস্টিকের নির্বাহী পরিচালক কামরুল হাসান বলেন, আগে বলা হতো ‘স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল’। আমি বলবো পরিবেশ এখন বাঁচার মূল। এমন উপলব্ধি থেকে টেল প্লাস্টিক রিসাইকেলিং খাতে কাজ করে যাচ্ছে। ২০১২ সালে এই টেল প্লাস্টিক যাত্রা শুরু করে। এটার উদ্দেশ্যেই ছিল পরিবেশ রক্ষায় কাজ করা। আমাদের প্রাণ-আরএফএল এর প্রয়াত চেয়ারম্যান আমজাদ খান চৌধুরী জানতেন, একটা সময় এই প্লাস্টিক পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। যেহেতু আমরা প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদন করি। তিনি এটাও জানতেন পরিবেশ রক্ষায় একটা সময় ব্যাপক আলোচনা হবে। টেলের প্রতিটি পণ্য থেকে দুই টাকা এ খাতের উন্নয়নে ব্যয় করা হচ্ছে।
বিল্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ফেরদৌস আরা বেগম বলেন, পুরোনো প্লাস্টিক সমস্যা সমাধানে বিল্ড প্লাস্টিক থেকে কীভাবে টেক্সটাইলের সুতা তৈরি করা যায়, সেটি নিয়ে কাজ করছে। আমাদের এ পোশাক শিল্প ধরে রাখতে গেলে ম্যান মেড ফাইবারের বিকল্প নেই। সেখানে সম্ভাবনাময় প্লাস্টিক খাতকে যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
বিপিজিএমইএ সভাপতি সামিম আহমেদ বলেন, দেশে প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। ব্যবহৃত প্লাস্টিক পণ্য আলাদা করে সংগ্রহ সমস্যার কারণে রিসাইকেল প্লাস্টিক পণ্যের অনেক চাহিদা থাকলেও সেটা পূরণ করা যাচ্ছে না। প্লাস্টিক খাতের উন্নয়নের দায়িত্ব কেবল বেসরকারি খাতের একার নয়। এজন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজ করতে হবে।
এনএইচ/জেডএইচ/এমএস