জাতীয়

পাহাড় কাটা-পুকুর ভরাটে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য

চার দশক আগেও চট্টগ্রামে পুকুর-জলাশয় ছিল প্রায় ২৫ হাজার। বর্তমানে টিকে থাকা এক হাজারের কিছু বেশি জলাশয়ও দখল-দূষণে জর্জরিত। একই সঙ্গে নিয়ম না মেনে কাটা হচ্ছে পাহাড়। দখলদারও কম নয়। এই পাহাড় কাটা ও পুকুর ভরাটের ফলে চট্টগ্রামের পরিবেশে পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব।

Advertisement

অতিবৃষ্টিতে পাহাড় ধসে ঘটছে প্রাণহানি। জেলাসহ নগরীর বেশিরভাগ পুকুর ভরাট হওয়ায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তাৎক্ষণিক পানি মিলছে না, আবার বর্ষাকালে সামান্য বৃষ্টিতে নগরজুড়ে সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। গ্রীষ্মে বাড়ছে তাপমাত্রা।

আইনি দুর্বলতার কারণে ধারাবাহিকভাবে চলছে পাহাড় কাটা ও পুকুর ভরাট। অভিযোগের শুনানি শেষে পরিবেশগত ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিয়েও এসব ঘটনার সুরাহা করতে পারে না পরিবেশ অধিদপ্তর। বিশেষ করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে চট্টগ্রামে এ পর্যন্ত কোনো নজির স্থাপন করতে পারেনি সংস্থাটি।

অনিয়ন্ত্রিত পাহাড় কাটায় বাড়ছে প্রাণহানিপরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণে বিগত সময়ে বর্ষায় চট্টগ্রাম মহানগরীতে পাহাড়ধসে অসংখ্য প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। তারপরও থেমে নেই পাহাড় কাটা, পাদদেশে বসতি স্থাপন করে বসবাস। তথ্য অনুযায়ী, গত ১৬ বছরে চট্টগ্রামে পাহাড়ধসে মারা গেছে তিন শতাধিক মানুষ। সবশেষ গত বছরের ২৭ আগস্ট নগরীর ষোলশহর এলাকায় পাহাড়ধসে বাবা-মেয়ের প্রাণহানি ঘটে।

Advertisement

সরেজমিনে দেখা যায়, নগরীর বায়েজিদ-ফৌজদারহাট সংযোগ সড়ক লাগোয়া জঙ্গল সলিমপুর, জাফরাবাদ, জালালাবাদ, আরেফিন নগর এলাকার সবুজ পাহাড়গুলো কেটে সাবাড় করা হচ্ছে। লালখানবাজার মতিঝরনা পাহাড়, আকবর শাহ এলাকার রেলওয়ের পাহাড় ঝিল-১, ঝিল-২, গরিব উল্লাহ শাহ আবাসিক এলাকার পেছনে অপরূপ হাউজিং সোসাইটি লাগোয়া পাহাড় দখল করে, কেটে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি তৈরি করা হয়েছে। নগরীর ম্যানোলা পাহাড়, নাগিন পাহাড়, আসকারদিঘি পাড়ের গ্রিন্ডলেস ব্যাংকের পাহাড়েও পড়েছে প্রভাবশালীদের কুদৃষ্টি।

চট্টগ্রামে বিগত কয়েক বছরে পাহাড় কাটা কিংবা পুকুর ভরাটের বিষয়ে পরিবেশ আদালতে অসংখ্য মামলা করা হয়েছে। কিন্তু আইনের নানান ফাঁকফোঁকরে অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছেন। তারপরও পরিবেশ রক্ষায় পরিবেশ অধিদপ্তর থেমে নেই।- পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের পরিচালক হিল্লোল বিশ্বাস

৪০ বছরে ভরাট ২৪ হাজার পুকুর-জলাশয়বিগত ৪০ বছরে চট্টগ্রামে কমপক্ষে ২৪ হাজার পুকুর-জলাশয় ভরাট করা হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর ১৯৮১ সালের এক পরিসংখ্যানে উল্লেখ করে, চট্টগ্রামে প্রায় ২৫ হাজার পুকুর-জলাশয় রয়েছে। চার দশকের ব্যবধানে দখল-দূষণে হারিয়ে গেছে বেশিরভাগ পুকুর-জলাশয়। ১৯৯১ সালে মৎস্য অধিদপ্তরের এক জরিপে ১৯ হাজার ২৫০টি পুকুর-জলাশয় ছিল। ২০০৬ সালে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের এক জরিপে ৪৫২৩টি পুকুর-জলাশয় পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন

Advertisement

‘দেশে যে উন্নয়ন চলছে তার বেশিরভাগ পরিবেশের বিপক্ষে’ শীর্ষ দূষণের শহর ঢাকা বসবাসেরও অযোগ্য এক কোটি টনের বেশি প্লাস্টিকে দূষিত হচ্ছে সমুদ্র

জমির মূল্য অস্বাভাবিক হারে বাড়ার কারণে নব্বইয়ের দশক থেকে চট্টগ্রামে পুকুর-জলাশয় ভরাটের মহোৎসব শুরু হয়। রাতারাতি পুকুর ভরাট করে তৈরি হয়েছে অগণিত স্থাপনা। ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক মোরশেদ হোসেন মোল্লার এক সমীক্ষায় চট্টগ্রাম শহরে ১২৪৯টি জলাশয়ের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এখন তাও নেই।

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী বলুয়ারদিঘি দখল-দূষণ এবং আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। চারদিকে তৈরি হয়েছে স্থায়ী স্থাপনা। আশকার দিঘিও দখলে অস্তিত্বের লড়াই করছে। দিঘির চারদিকে উঠেছে বহুতল স্থাপনাও। দখল-দূষণে সংকুচিত হচ্ছে এনায়েত বাজার এলাকার রানীর দিঘি, পাহাড়তলীর পদ্মপুকুর, বড় মিয়ার মসজিদ পুকুর, হালিশহরের খাজা দিঘি, চান্দগাঁওয়ের মুন্সি পুকুর, বাকলিয়ার আবদুল্লাহ সওদাগর পুকুর, আগ্রাবাদ ঢেবা, আগ্রাবাদের দাম্মো দিঘি, কর্নেল হাট দিঘি, হাজারীর দিঘি, কারবালা পুকুর, ভেলুয়ার দিঘি, কাজীর দিঘি ও রামপুর বড় পুকুর।

পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের পরিচালক হিল্লোল বিশ্বাস জাগো নিউজকে বলেন, ‘আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে পুলিশ কিংবা প্রশাসন যেভাবে প্রয়োগ করতে পারে, সেভাবে পরিবেশ অধিদপ্তর পারে না। চট্টগ্রাম মহানগরীতে ৬০ লাখ বাসিন্দা রয়েছে। এত বড় শহরে পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত করার বিষয়ে, বিশেষ করে পাহাড় কাটা, পুকুর ভরাট, খাল-নদী দূষণ যে হারে হচ্ছে, তা নিবারণের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা পরিবেশ অধিদপ্তরের নেই। জনবলেরও সীমাবদ্ধতা রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামে বিগত কয়েক বছরে পাহাড় কাটা কিংবা পুকুর ভরাটের বিষয়ে পরিবেশ আদালতে অসংখ্য মামলা করা হয়েছে। কিন্তু আইনের নানান ফাঁকফোঁকরে অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছেন। তারপরেও পরিবেশ রক্ষায় পরিবেশ অধিদপ্তর থেমে নেই।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. দানেশ মিয়া বলেন, ‘বড় বড় প্রভাবশালী পাহাড় কাটছে, পুকুর ভরাট করছে। আবার অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্যও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো পাহাড় কাটছে। এ ধরনের ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন থাকলেও একটি প্রকল্পের জন্য কী পরিমাণ পাহাড় কাটতে হবে সেজন্য কোনো স্ট্যাডি প্রতিষ্ঠানগুলোর থাকে না। সড়ক তৈরির জন্য পাহাড় কাটতে হলে ২২ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে পাহাড় কাটতে হয়, কিন্তু এখানে খাঁড়াভাবে পাহাড় কাটা হচ্ছে। এতে পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে প্রাণহানি হচ্ছে।’

যারা পুকুর ভরাট করেন কিংবা পাহাড় কাটেন তারা প্রভাবশালী লোকজন। পাহাড় কাটলে কিংবা পুকুর ভরাট হলে অনেক সময় পরিবেশ অধিদপ্তর মামলা করে। কিন্তু মামলার বিচারে কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড একত্রে দেওয়ার সুযোগ আইনে দেওয়া হয়নি।- বাপা চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক এ বি এম আবু নোমান

তিনি বলেন, ‘পাহাড় কাটার কারণে পরিবেশের ইকো সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখন পাহাড় কাটা, পুকুর ভরাট কিংবা পরিবেশ দূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তরকে আরও কার্যকর করতে হবে। আইনি যেসব সীমাবদ্ধতা রয়েছে, সেগুলোও সংশোধনের জন্য সরকারিভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। তাছাড়া নতুন করে পরিবেশকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। ইকো সিস্টেমগুলো কীভাবে কার্যকর করা যায়, সেজন্য উদ্যোগী হতে হবে। পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষায় সাধারণ মানুষকেও সচেতন হতে হবে।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের অধ্যাপক এ বি এম আবু নোমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘পরিবেশ রক্ষায় পরিবেশ সংরক্ষণ আইন রয়েছে, পরিবেশ আদালত রয়েছে। কিন্তু ১৯৯৫ সালের যে আইন, সেটিতেও অনেক দুর্বলতা রয়েছে। যেসব দুর্বলতার কারণে ভূমিদস্যু কিংবা পাহাড়খেকোরা পার পেয়ে যাচ্ছেন।’

তিনি বলেন, ‘যারা পুকুর ভরাট করেন কিংবা পাহাড় কাটেন তারা প্রভাবশালী লোক। পাহাড় কাটলে কিংবা পুকুর ভরাট হলে অনেক সময় পরিবেশ অধিদপ্তর মামলা করে। কিন্তু মামলার বিচারে কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড একত্রে দেওয়ার সুযোগ আইনে দেওয়া হয়নি। যে কারণে শুধু জরিমানা দিয়েই অপরাধীরা মামলা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। এক্ষেত্রে পরিবেশ রক্ষা করতে হলে পরিবেশ আইনকে শক্তিশালী করতে হবে।’

আইনের এই শিক্ষক বলেন, ‘পাহাড় কাটা কিংবা পুকুর ভরাটসহ পরিবেশ দূষণ বন্ধে পুলিশ প্রশাসন, জেলা প্রশাসন, সিটি করপোরেশন, পৌরসভাসহ স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা প্রয়োজন। এজন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের সঙ্গে সরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয় প্রয়োজন।’

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট রয়েছে। নারী-শিশুকে সহায়তার জন্য কুইক রেসপন্স ইউনিট আছে। কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটসহ বিশেষায়িত কয়েকটি ইউনিট আছে। এ ধরনের পরিবেশ পুলিশ ইউনিটও থাকা উচিত। পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্তের কোনো অভিযোগ এলে পরিবেশ অধিদপ্তর চাইলেই যাতে দ্রুততম সময়ে পরিবেশ পুলিশ ইউনিট সহযোগিতা দিতে পারে।’

ইকবাল হোসেন/এএসএ/এমএস