জাতীয়

বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতি করে বহির্বিশ্বের কাছে টাকা চাইলে তো হবে না

জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। এতে ভয়াবহ ক্ষতির পাশাপাশি দেশ হারাচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য ব্যবস্থা রয়েছে আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থায়নের। বাংলাদেশ এই তহবিল পেয়ে আসছে দীর্ঘদিন।

Advertisement

তবে এসব তহবিল কাজে লাগিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কতটুকু সফল হচ্ছে বাংলাদেশ? ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে পর্যাপ্ত ফান্ড পাচ্ছে কি না, পেলেও সেগুলোর যথাযথ ব্যবহার কতটুকু করছে- এসব নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেন জলবায়ু অর্থায়ন বিশেষজ্ঞ ও চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এম জাকির হোসেন খান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রায়হান আহমেদ।

জাগো নিউজ: বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় যে অর্থ পাচ্ছে সেটি আমাদের জন্য পর্যাপ্ত কি না?

এম জাকির হোসেন খান: জলবায়ু তহবিলের কথা বলতে গেলে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অর্থায়ন বেশি পেয়েছে জাতিসংঘের গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড (জিসিএফ) থেকে। বর্তমানে বিদেশি অর্থায়নে ৯টি প্রকল্প চলমান। সব মিলিয়ে গত ১২-১৩ বছরে আন্তর্জাতিক উৎস থেকে এক বিলিয়ন ডলারের মতো পেয়েছে। কিন্তু আমাদের দরকার বছরে কমপক্ষে ১০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ।

Advertisement

ফান্ড পাওয়ার পর উপযুক্ত প্রকল্প প্রণয়ন এবং অর্থায়ন কৌশল না থাকা অন্যতম। বহির্বিশ্বের কার্বন নিঃসরণের প্রভাবে আমরা যে পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি অভিযোজন বা সহনশীলতা বৃদ্ধির জন্য সে পরিমাণ অর্থ পাচ্ছি না। অনেক ক্ষেত্রে যথাযথ ঝুঁকি যাচাই না করায় অভিযোজন অর্থায়নকে ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পে ব্যবহার করা হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে টেকসই ফলাফলের পরিবর্তে অবকাঠামো নির্মাণকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। অথচ ক্লাইমেট ফাইন্যান্সের মূল লক্ষ্য জীবন ও প্রকৃতির সুরক্ষা দিতে হবে।

জাগো নিউজ: এই অভিযোজন প্রকল্পে যে পরিমাণ অর্থ পাচ্ছে তা সঠিক ব্যবহার হচ্ছে কি না?

এম জাকির হোসেন খান: জলবায়ু অভিযোজনে যে ফান্ড পাচ্ছে তার ব্যবহার যথাযথ হচ্ছে না। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ যত ফান্ড পেয়েছে তার যথাযথ ব্যবহার হলে রিমালসহ অন্য ঘূর্ণিঝড়ের কারণে আমাদের এত ক্ষয়ক্ষতি হতো না। প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করলেই জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলা করা যায় না। শুধু বাঁধ তৈরি করা বা রক্ষার কথাই যদি বলি, একই জায়গায় বারবার প্রজেক্ট নেওয়া হচ্ছে। ৮-১২ ফুট জলোচ্ছ্বাস হলেই নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। লাখ লাখ মানুষ ঘরছাড়া হয়।

যখন দেখবে দেশের নদীগুলো মরে যাচ্ছে, নদীদূষণ হচ্ছে, বন উজাড় হচ্ছে, তখন ফান্ড পাওয়ার প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এই যে রিমাল এলো, এটার জন্য আমরা ক্লেম করতে পারি। কিন্তু উপকূলে বাঁধ নির্মাণের দুর্নীতি করে পরের বছর আবার সেই বাঁধ নির্মাণের জন্য বহির্বিশ্বের কাছে টাকা চাইবে সেটা তো হবে না।

Advertisement

জলবায়ু ফান্ডের প্রজেক্ট যারা বাস্তবায়ন করে বেশিরভাগই আইএনজিও (আন্তর্জাতিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা)। একই প্রজেক্টে দু-তিনটা এনজিও কাজ করে কিন্তু তাদের মধ্যে কো-অর্ডিনেশন নেই। টাকা কিন্তু নষ্ট হচ্ছে। আইএনজিওগুলো আবার স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। তারা পানি উন্নয়ন বোর্ড, এলজিইডির সঙ্গে সমন্বয় করতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হয়।

জাগো নিউজ: বিদেশি তহবিলে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কতটুকু সফল হচ্ছে বাংলাদেশ?

এম জাকির হোসেন খান: দেশে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ফান্ড নেওয়ার জন্য যে প্রজেক্ট প্ল্যান নেওয়া সেটি শুধু বর্তমান ক্ষয়ক্ষতি দেখে নেওয়া হয়। দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই উন্নয়নের চিন্তা করে প্রপোজাল তৈরি হয় না। এরপর সেই ফান্ড আসতে আসতে তিন থেকে পাঁচ বছর লাগে। এখন এই পাঁচ বছরে ক্ষতি আরও বেড়ে যায়। টাকার অংক কিন্তু চার বছর আগের প্ল্যান অনুযায়ী আসে। ওই ফান্ড দিয়ে পুরোপুরি সমস্যা মোকাবিলা সম্ভব হয় না। ফলে প্রজেক্টগুলোও সফল হয় না।

আরও পড়ুন

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিশ্বের সহায়তা প্রয়োজন: পরিবেশমন্ত্রী যুদ্ধে নয়, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অর্থ ব্যয় করুন কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তন ও কীটনাশকের হুমকি!

যদি অনুমানের ওপর প্রজেক্ট করা হয়, এরপর যখন দুর্যোগ বাড়বে তখন তো আর ফান্ড চাওয়া যাবে না। কমিউনিটি লেভেলে গিয়ে রিয়েল টাইমে প্রজেক্ট নিতে হবে। কোটি কোটি টাকার এ প্রজেক্টের জন্য আমাদের দেশে গবেষণা করা হয় না। আগামী ১০ থেকে থেকে ২০ বছর পর জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কী কী চ্যালেঞ্জ আসবে, এর ডেটা আমাদের কাছে নেই। ফলে প্রজেক্টের উপকার জনগণ ঠিকভাবে পাচ্ছে না।

জাগো নিউজ: বাংলাদেশ অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে পর্যাপ্ত অর্থ না পাওয়ার কারণ কী?

এম জাকির হোসেন খান: কোনো স্টেট যদি ইকোসিস্টেম ধ্বংস করে, পরিবেশের ক্ষতি করে মানুষের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে ফেলে বিদেশের কাছে সহায়তা চায়, তখন পর্যাপ্ত অর্থ পাওয়া যায় না। কারণ ইকোসিস্টেমের ক্ষতি করে আন্তর্জাতিক সহায়তা পাওয়ার জন্য আপনি আইনিভাবে নিজেদের দুর্বল করছেন।

গ্লোবালি যখন দেখা হচ্ছে ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষে থাকছে, শব্দদূষণ হচ্ছে, মানুষ রোগাক্রান্ত হচ্ছে, তাহলে কীভাবে ঢাকার জন্য ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড পাবে।

যখন দেখবে দেশের নদীগুলো মরে যাচ্ছে, নদীদূষণ হচ্ছে, বন উজাড় হচ্ছে, তখন ফান্ড পাওয়ার প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এই যে রিমাল এলো, এটার জন্য আমরা ক্লেম করতে পারি। কিন্তু উপকূলে বাঁধ নির্মাণের দুর্নীতি করে পরের বছর আবার সেই বাঁধ নির্মাণের জন্য বহির্বিশ্বের কাছে টাকা চাইবে সেটা তো হবে না।

জাগো নিউজ: জলবায়ু ফান্ড পেতে তাহলে কীভাবে প্রজেক্ট ডিজাইন করা উচিত?

এম জাকির হোসেন খান: প্রজেক্ট ডিজাইনের সময় অবশ্যই স্থানীয় জনগণকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। স্টেকহোল্ডাররা যেভাবে চাইবে সে পরামর্শ নিতে হবে। উপকূল বা নিম্নাঞ্চলে সাইক্লোন শেল্টার হবে, সেক্ষেত্রে নদীর কোথায় ভাঙন কম হয়, কোথায় সাইক্লোন শেল্টার করলে বেশি টেকসই হবে সেটা কিন্তু নদীপাড়ের মানুষই জানে। কারণ তারা সেখানে শত বছর ধরে অবস্থান করছে। তারা জানে কোথায় বাঁধ দিতে হবে, কোন পাশ দিয়ে নদীর পাড় ভাঙতে পারে। তাই প্রজেক্ট ডিজাইন করার ক্ষেত্রে অবশ্যই কমিউনিটি লেভেল মানুষকে গুরুত্ব দিতে হবে, না হলে প্রজেক্ট সফল হবে না।

সামনে আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ পানির সংকট। সেই সংকট কীভাবে দূর করবে কোনো প্ল্যান কি করা আছে আমাদের? নাকি সংকট শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সারাবিশ্বে সাহায্যের জন্য দৌড় শুরু করবো।

জাগো নিউজ: জলবায়ু অভিযোজন প্রক্রিয়ায় বিদেশি অর্থ আসতে সীমাবদ্ধতা কোথায়?

এম জাকির হোসেন খান: জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলো যে ফান্ড পায় সে প্রসেসটাও স্লো। কর্মপরিকল্পনা সাবমিট হওয়ার তিন থেকে চার বছর পর ফান্ড মঞ্জুর হয়। এর মধ্যে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যায়, দরিদ্রতা বেড়ে যায়, মাইগ্রেশন হয়ে শহরে মানুষ বাড়ে। ডলারের মূল্যও বেড়ে যায়। কিন্তু অর্থ আগের মতোই দেওয়া হয়। ফলে সমস্যার সমাধান হয় না।

এখানে পুরো চেইনটায় স্বচ্ছতা প্রয়োজন। না হলে অভিযোজনের নামে প্রজেক্ট নিয়ে শুধু টাকা নষ্ট। কারণ প্যারিস চুক্তিতে বলা আছে এটা সম্পূর্ণ স্বচ্ছ হতে হবে। একই সঙ্গে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। বন্ধ করতে হবে দুর্নীতি।

জাগো নিউজ: জলবায়ু অভিযোজন করতে বিদেশি তহবিল পেতে ও ব্যবহার করতে আপনার পরামর্শ কী?

এম জাকির হোসেন খান: প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে বলা আছে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর ফান্ড পাওয়ার প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ স্বচ্ছ হতে হবে। একই সঙ্গে স্টেকহোল্ডারদের পরামর্শ করতে হবে। এখন কমিউনিটি যদি বলে দেবে কোনটা তাদের জন্য ইমিডিয়েট আর কোনটা লংটার্ম। তখন গুরুত্ব অনুযায়ী ফান্ড আসবে।

প্রত্যেকটা সেক্টর ধরে এগোতে হবে। যেমন কৃষিক্ষেত্রে সামনে কী চ্যালেঞ্জ আসবে, কী পরিবর্তন হবে সেটা বুঝতে হবে। যেমন সামনে আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ পানির সংকট। সেই সংকট কীভাবে দূর করবে কোনো প্ল্যান কি করা আছে আমাদের? নাকি সংকট শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সারাবিশ্বে সাহায্যের জন্য দৌড় শুরু করবো।

এই যে আমাদের মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে, দরিদ্রতা বাড়ছে, উৎপাদন কমে যাচ্ছে, কিন্তু সে অনুযায়ী ক্লাইমেট ফান্ডের জন্য ফিগার দাঁড় করানো হয় না। ফান্ড পেলেও স্বচ্ছতা বজায়ের জন্য সেখানে বিভিন্ন এনজিও বা পরিবেশবাদী সংস্থা রাখা যেতে পারে, যারা কাজের তদারকি করবে।

আরএএস/এএসএ/এমএস