জাতীয়

পরিবেশের ওপর বারবার আঘাত হানছে মানুষ

• মরুময়তা রুখতে প্রয়োজন সম্মিলিত প্রয়াস• পলিসি শক্তিশালী হলেও বাস্তবায়ন এখনো দুর্বল• কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলো থেকে নিতে হবে ক্ষতিপূরণ

Advertisement

দ্রুত বদলাচ্ছে চেনা পৃথিবী। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পড়ছে পরিবেশ ও প্রাণ-প্রকৃতির ওপর। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষার চরিত্র পাল্টে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উষ্ণ হয়ে উঠছে পৃথিবীর শরীর। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) কোপার্নিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিসের বিশ্লেষণে দেখানো হয়েছে, ২০২৩ সাল ছিল পৃথিবী নামের গ্রহটির সবচেয়ে উষ্ণতম বছর। এমনকি গত এক লাখ বছরের মধ্যেও গত বছরের মতো এতটা উষ্ণ হয়নি পৃথিবী। আশঙ্কা করা হচ্ছে, দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে অদূর ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও বিপর্যয়কর হতে পারে।

কিন্তু কেন এতটা উষ্ণ হচ্ছে পৃথিবী? এক কথায় বলা যায়, মনুষ্যসৃষ্ট কারণে। অর্থাৎ, মানুষই পৃথিবীকে মানুষের বসবাসের অনুপযোগী করে তুলছে। প্রকৃতি ও পরিবেশের ওপর বারবার আঘাত হানছে মানুষ। প্রকৃতিও সেই আঘাতের জবাবে প্রতিশোধ নিচ্ছে। বিশ্বজুড়ে দিন দিন কার্বন ডাই-অক্সাইডের নিঃসরণ বিপজ্জনক হারে বাড়ায় জলবায়ু সংকট আরও প্রকট হচ্ছে। এতকিছুর পরও কার্বন নিঃসরণ কমানো যাচ্ছে না। যার ফলে উষ্ণতা বৃদ্ধি মোকাবিলার যে বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা সেটিও এক অর্থে ব্যর্থ হচ্ছে।

বিশ্বজুড়ে দিন দিন কার্বন ডাই-অক্সাইডের নিঃসরণ বিপজ্জনক হারে বাড়ায় জলবায়ু সংকট আরও প্রকট হচ্ছে। এতকিছুর পরও কার্বন নিঃসরণ কমানো যাচ্ছে না। যার ফলে উষ্ণতা বৃদ্ধি মোকাবিলার যে বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা সেটিও এক অর্থে ব্যর্থ হচ্ছে

Advertisement

‘করবো ভূমি পুনরুদ্ধার, রুখবো মরুময়তা; অর্জন করতে হবে মোদের খরা সহনশীলতা’- এ প্রতিপাদ্য নিয়ে এবছর বিশ্ব পরিবেশ দিবস-২০২৪ পালিত হচ্ছে। এরই মধ্যে ঘন ঘন তাপপ্রবাহে অতিষ্ঠ বাংলাদেশের মানুষ। মাঝেমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টির দেখা মিললেও তাপমাত্রা কিছুতেই সহনীয় পর্যায়ে আসছে না। অন্যদিকে, তীব্র গরমে পানিশূন্যতা, হিটস্ট্রোক, শ্বাসকষ্ট, মাথাব্যথা, বমি ভাব, ত্বকে ফুসকুড়ি এবং মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকিসহ নানা রোগের প্রাদুর্ভাবও বাড়ছে।

আরও পড়ুনকার্বন নিঃসরণ কমাতে ধনী দেশগুলোর দ্রুত পদক্ষেপ প্রয়োজনকার্বন নিঃসরণ কমাতে উন্নত বিশ্বকে মনোযোগ দিতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী

খরা প্রতিরোধ এবং মরুময়তা রোধে বৃক্ষরোপণ বড় ভূমিকা রাখতে পারে। সরকারি-বেসরকারিভাবে এ বিষয়ে মানুষকে উৎসাহিত করা উচিত। অথচ এক্ষেত্রে বাংলাদেশের চিত্র অনেকটাই ভিন্ন। এখানে নির্বিচারে চলছে গাছ কাটা। উজাড় করা হচ্ছে বনাঞ্চল। সে তুলনায় গাছ লাগানোর হার একেবারেই কম।

প্রকৃতির এমন বিপর্যয়ের পেছনে মানুষের দায়কেই বড় করে দেখছেন গবেষকরা। এ পরিস্থিতিতে পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক রাখতে কার্বন নিঃসরণ কমানোর তাগিদ তাদের। একই সঙ্গে বিদ্যমান নীতিমালার বাস্তবায়ন এবং কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ে এককভাবে নয়, বরং ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বানও জানাচ্ছেন গবেষক ও পরিবেশবিদেরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের অতিবৃষ্টি, অতি খরা হচ্ছে। আমাদের পদ্মা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্রের মতো নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। নদী শুকিয়ে যাওয়ার পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনই শুধু নয়, বরং উজান তথা ভারতে নির্মিত বিভিন্ন বাঁধও কিন্তু দায়ী।

Advertisement

একটা শহরে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ বনায়ন, গ্রিন জোন থাকতে হয়। কিন্তু আমাদের শহরে পাঁচ থেকে ছয় শতাংশ বনায়ন আছে, সেগুলোও কেটে ফেলছে।-ড. মনিরুজ্জামান

‘বাঁধের কারণে নদীগুলোতে স্বাভাবিক নাব্য নেই। যখন যতটুকু পানি থাকা দরকার তা থাকছে না। ফলে পরিবেশে মরুময়তা দেখা দিচ্ছে। ‘ঝুঁকি সমাজ’ বা ‘রিস্ক সোসাইটি’ নামে একটি বিখ্যাত থিওরি আছে। এই ‘ঝুঁকি সমাজ’র কারণে শহরের তাপমাত্রা অধিক হারে বেড়েছে। আমাদের জন্য একসময় ঝুঁকি ছিল বন্যা, অতি পানি। কিন্তু এখন ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে উল্টোটা, আমাদের এখন পানি নেই।’

তিনি বলেন, বুড়িগঙ্গায় যে পানির প্রবাহ থাকার কথা সেটা নেই। এটা কি শুধু জলবায়ুগত পরিবর্তন? এর বাইরেও একটা বড় কারণ হলো ‘ঝুঁকি সমাজ’। পরিবেশের এ দুরবস্থার পেছনে বড় দায় মানবসমাজের পরিবেশবিরোধী কর্মকাণ্ড। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে মরুময়তা, শুষ্কতা, অতিবৃষ্টি, তাপপ্রবাহ ও খরা ইত্যাদি বিষয়গুলো যতটা না প্রাকৃতিক তার চেয়েও বেশি মানবসৃষ্ট।

আরও পড়ুনবিশ্বের ১ শতাংশ ধনী ৬৬ শতাংশ গরিবের চেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণ করেএশিয়ায় কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামানো কি সম্ভব?

‘ফারাক্কা বাঁধ কিন্তু প্রাকৃতিক নয়, মানুষের তৈরি। একই ভাবে বুড়িগঙ্গা ধ্বংস হচ্ছে, তিস্তায় পানি থাকে না, নদীগুলোর নাব্য কমছে। এগুলো তো মানুষের কর্মকাণ্ডেরই প্রতিফলন। ছোটবেলায় দেখতাম বাংলাদেশে ছয় ঋতু। কিন্তু এখন গ্রীষ্ম, বর্ষা আর সামান্য কিছুদিন শীত ছাড়া আর কোনো কিছু চোখে পড়ে না। তাহলে বাকি তিনটি কোথায় গেল?’

ড. মনিরুজ্জামানের ভাষ্য, ঢাকা শহরে কোকিল ডাকবে কোথায়, পাখির নীড় কোথায়? গাছও তো নেই। আমি পাখির ডাক শুনলে বুঝি বসন্ত। কিন্তু এখন বসন্ত হবে কোথায়, বসন্ত তো জাদুঘরে চলে গেছে। একটা শহরে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ বনায়ন, গ্রিন জোন থাকতে হয়। কিন্তু আমাদের শহরে পাঁচ থেকে ছয় শতাংশ বনায়ন আছে, সেগুলোও কেটে ফেলছে। আমাদের কাছে উন্নয়নই মূল জিনিস হয়ে দেখা দিয়েছে। কিন্তু শিল্পায়ন পরিবেশকে সংরক্ষণ করেও করা যায়। আমাদের পলিসি যে নেই তা নয়, আমাদের পলিসি আছে, কিন্তু তার বাস্তবায়ন নেই।

এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, যে পলিসি তৈরি করে সে-ই সবার আগে ভায়োলেট করে। তাহলে বাস্তবায়নের জায়গাটা এক্সিকিউট করবে কে? পরিবেশের যে মেকানিজম, বায়ো ডাইভার্সিটি বা ব্যালেন্স ইকোলজি আছে, সেটি নষ্ট হওয়ার ফলে ভারসাম্য হারাচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে মরুময়তা বিষয়টি প্রাকৃতিক মনে হলেও এটি প্রকৃতির নামে মানুষই সৃষ্টি করছে।

এ সংকট থেকে উত্তরণের উপায় কী, তা নিয়েও কথা বলেন ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। তার কথায়- আমাদের পলিসি কিন্তু আছে, সেটার শুধু বাস্তবায়ন দরকার। ঢাকা শহরে কিন্তু একসময় প্রচুর বনায়ন ছিল, তখনকার পলিসি কিন্তু এখনকার চেয়েও অনেক দুর্বল ছিল। এখন পলিসি শক্তিশালী হয়েছে, কিন্তু বাস্তবায়ন না থাকায় সংকটের সমাধান হচ্ছে না।

‘কোন সমস্যা সমাধান করতে হলে সমস্যাটা কী আগে সেটা বুঝতে হবে। ঢাকা শহরের সমস্যাগুলো সৃষ্টির পেছনে দায় কার আমরা সবাই জানি। যারা পলিসি মেকার তারাই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। ফলে পলিসি থাকা সত্ত্বেও সেটার ইমপ্লিমেন্ট নেই। এত তাপমাত্রা, এত অনাবৃষ্টি এগুলোর সমাধান একটি জায়গায়ই। যে পলিসিগুলো আছে সেগুলো শক্তভাবে বাস্তবায়ন করলেই আমরা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে সক্ষম হবো’- যোগ করেন তিনি।

কার্বন নিঃসরণ, জলবায়ু পরিবর্তন, উষ্ণতা বৃদ্ধি তথা বিপর্যস্ত প্রাণ-পরিবেশ নিয়ে কথা হয় সবুজ আন্দোলনের পরিচালক বাপ্পি সরদারের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, মরুময়তা সৃষ্টি হয় মূলত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বড় রাষ্ট্রগুলোর শিল্পকারখানায় অতিরিক্ত মাত্রায় কার্বন নিঃসরণের কারণে। কার্বন নিঃসরণ বাড়ায় বিশ্বজুড়ে স্বাভাবিক যে জলবায়ু পরিবর্তন হওয়ার কথা তাতে বিঘ্ন ঘটছে। যার ফলশ্রুতিতে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ভূমিকম্পসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটছে।

মরুময়তা সৃষ্টি হয় মূলত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বড় রাষ্ট্রগুলোর শিল্পকারখানায় অতিরিক্ত মাত্রায় কার্বন নিঃসরণের কারণে। কার্বন নিঃসরণ বাড়ায় বিশ্বজুড়ে স্বাভাবিক যে জলবায়ু পরিবর্তন হওয়ার কথা তাতে বিঘ্ন ঘটছে।- বাপ্পি সরদার

‘উন্নত রাষ্ট্রগুলো যদি কার্বন নিঃসরণ বন্ধ না করে তাহলে এ মরুময়তা রোধ করার সুযোগ নেই। শুধু গাছ লাগানোই সমাধান নয়, উন্নত রাষ্ট্রগুলোকে কার্বন নিঃসরণ কমাতে হবে। বৃক্ষরোপণের ক্ষেত্রে একটি দেশে কী ধরনের গাছ উপকারী সেটি বুঝে দেশীয় প্রজাতির গাছ লাগাতে হবে।’

তিনি বলেন, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল, স্বল্পোন্নত ও অনুন্নত রাষ্ট্রগুলো এই কার্বন নিঃসরণের জন্য দায়ী নয়। অথচ এসব দেশের নাগরিকরাই, আমরাই কিন্তু এর ফলাফল ভোগ করছি। সেক্ষেত্রে উন্নত রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে আমরা জলবায়ু তহবিল আদায় করতে পারি। সে তহবিল থেকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দেশের ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা দেওয়া যেতে পারে। আমরা চাইলেই উন্নত রাষ্ট্রগুলোকে কার্বন নিঃসরণ থেকে বিরত রাখতে পারি না। কিন্তু জলবায়ু তহবিল আদায় তো করতেই পারি।

আরও পড়ুন২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ কমাতে সম্মত ৬০ দেশকার্বনমুক্ত ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে বিকল্প হতে পারে গ্রিন হাইড্রোজেন

একই কথা উঠে এসেছে সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর বক্তব্যে। সহমত জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদও। এ দুই মন্ত্রীর ভাষ্য, জলবায়ু পরিবর্তনের পেছনে মূলত পুঁজিবাদী উন্নত রাষ্ট্রগুলো দায়ী। অতএব সেসব সমাধানের দায়িত্বও তাদেরই।

গত ১২ মে সাবের হোসেন চৌধুরী ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির ‘ক্লাইমেট অ্যাকশন প্ল্যান’ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বলেন, বাংলাদেশের কার্বন নিঃসরণ দশমিক ৪৬ শতাংশ। সারা বিশ্বে যে কার্বণ নিঃসরণ সেটাতো আমরা তৈরি করিনি। তার দায়ও তো আমাদের নেওয়ার কথা না। কিন্তু কী করবো? আমরা স্বল্পোন্নত দেশ হওয়ায় আমাদের ওপর যা খুশি তা চাপিয়ে দিতে পারে। আজকে যদি কোনোভাবে বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ হতো, তাহলে একটার পর একটা নিষেধাজ্ঞা দিত। আমাদের সবাইকে একসঙ্গে হয়ে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কাজ করতে হবে।

গত ২২ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয় রিনিউয়েবল এনার্জি সম্মেলন ও গ্রিন এক্সপোর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের মতো ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর দুর্যোগ ঝুঁকি কমাতে আর্থিক সহায়তা দিতে উন্নত বিশ্বের নেতাদের প্রতি আহ্বান জানাই। কার্বন নিঃসরণের জন্য মূলত উন্নত দেশগুলোই বেশি দায়ী। তাই বৈশ্বিক পরিবেশ রক্ষায় তাদের মুখ্য ভূমিকা রাখতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি এড়াতে পেশাজীবী ও গবেষকদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।

এমএইচএ/এমকেআর/জেআইএম