জাতীয়

‘দেশে যে উন্নয়ন চলছে তার বেশিরভাগ পরিবেশের বিপক্ষে’

‘বাংলাদেশ মনে করছে উন্নয়ন করতে গেলে তাকে পরিবেশ ধ্বংস করতেই হবে। মানুষকে একটা ধাঁধায় ফেলে দেওয়া হয়েছে। আর তা হলো উন্নয়ন চাইলে পরিবেশের বিষয়টা বিসর্জন দিতে হবে। এ কথাটা মোটেও সত্য নয়। বাংলাদেশের যে উন্নয়ন চলছে তার কিছুটা জনগণের কাজে লাগলেও বেশিরভাগ কিন্তু চলে যাচ্ছে পরিবেশের বিপক্ষে।’

Advertisement

বলছিলেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নির্বাহী প্রধান সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।

পাহাড় কাটা, বন ধ্বংস, জলাশয় ভরাট রোধসহ পরিবেশ রক্ষায় আইনিভাবে পাশে দাঁড়ান। এসব কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি পরিবেশের সবচেয়ে সম্মানজনক আন্তর্জাতিক পুরস্কার ‘গোল্ডম্যান’, এশিয়ার নোবেল খ্যাত ম্যাগসেসেসহ বহু পুরস্কার পেয়েছেন।

দূষণ নিয়ন্ত্রণে আমি তো সরকারকে এখনো কার্যকরী ও সুনির্দিষ্ট কিছু করতে দেখলাম না। আমার একটা আশার জায়গা হলো আমাদের নতুন পরিবেশমন্ত্রী। বিশাল সরকারি বাহিনীর একজন ব্যতিক্রমী ব্যক্তি হিসেবে তিনি কিছু করতে পারেন কি না দেখি।

Advertisement

৫ জুন, বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক মুসা আহমেদ।

জাগো নিউজ: বাসযোগ্য শহরের তালিকায় তলানিতে ঢাকা। আপনি ঢাকা শহরের স্থায়ী বাসিন্দা। এখানে আপনি কেমন আছেন?

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: এদেশের মানুষ যখন হাসপাতালে থাকে, তখনও কেউ কেমন আছেন জিজ্ঞেস করলে বলে, ভালো আছি। অভ্যাসগত কারণে আমিও বলবো ভালো আছি। কিন্তু আপনার প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করলে ভালো আছি বলার সুযোগ নেই। এই শহরকে আমি ভালোবাসি। তাই এর হত্যাকাণ্ডের প্রস্তুতি দেখলে, একে ধ্বংস করার তাণ্ডব দেখলে ক্ষুব্ধ হই। আমার ঢাকা যখন সবচেয়ে দূষিত বাতাস আর বসবাসের অযোগ্য নগরীর উপাধি পায়, তখন আমার ক্ষোভ আরও বেড়ে যায়।

জাগো নিউজ: ঢাকাসহ জেলা শহরগুলোতে বায়ুদূষণের হার ক্রমেই বাড়ছে। এ দূষণ কমাতে সরকারের ভূমিকা কী হওয়া উচিত?

Advertisement

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: সরকারের সদিচ্ছা অনেক পরের ব্যাপার, ইচ্ছা আছে কি না তা নিয়েই তো আমার সন্দেহ হয়। দূষণ নিয়ন্ত্রণে আমি তো সরকারকে এখনো কার্যকরী ও সুনির্দিষ্ট কিছু করতে দেখলাম না। আমার একটা আশার জায়গা হলো আমাদের নতুন পরিবেশমন্ত্রী। বিশাল সরকারি বাহিনীর একজন ব্যতিক্রমী ব্যক্তি হিসেবে তিনি কিছু করতে পারেন কি না দেখি।

জাগো নিউজ: ঢাকা শহরকে বাসযোগ্য করা কি সম্ভব?

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: ঢাকা শহরকে বাসযোগ্য করা অসম্ভব নয়। এজন্য দরকার একটি স্বচ্ছ নগর দর্শন, যেখানে ভূমি ব্যবস্থাপনাকে সাম্যভিত্তিক আর জনমুখী করতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনৈতিক আর আমলাতান্ত্রিক প্রভাবের বাইরে রাখতে হবে। সেখানে নিরপেক্ষ পেশাজীবী নিয়োগ দিতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নিয়ে তবেই রাজউকের ক্ষমতা আর দায়িত্বে পরিবেশ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

আমাদের নগরগুলোতে নতুন কর্তারা এলেই গাছ লাগানোর নামে পুরাতন গাছ কাটে আর সৌন্দর্য বৃদ্ধির নামে নতুন করে সড়ক বিভাজক তৈরি করে। যারা সুন্দরের নামে গাছ কাটে তাদের রুচি প্রশ্নবিদ্ধ।

এই প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি। প্রভাবশালীদের পক্ষে রাজউককে আর কোনো নতুন ভূমি বরাদ্দ প্রকল্প করতে দেওয়া যাবে না। দরিদ্রদের আবাসন নিয়ে ভাবতে হবে। আমাদের ভূমিদস্যুদের অভয়ারণ্য রাজউক। ভূমিদস্যুতার বিরুদ্ধে যুদ্ধের মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে। ড্যাপ কেন ব্যর্থ হয় তা থেকে শিক্ষা নিয়ে একটি কর্মসূচি হাতে নিতে হবে বাস্তবায়নের। আমাদের মানদণ্ড লাগবে, সভ্য শহরে যা থাকে তার সব আমাদের একই মানে বা পরিমাণে না থাকলেও কাছাকাছি মান আর পরিমাণে আনতে হবে।

আরও পড়ুনবছরে ছয়বার ভূমিকম্প আমাদের জন্য বিশেষ সতর্কবার্তাঢাকাবাসীর আয়ু গড়ে ৮ বছর কমছে‘গাছ কাটা বন্ধে সিটি করপোরেশন-রাজউকের উন্নয়ন দর্শন বদলানো উচিত’

জনগণের অংশগ্রহণ নিয়ে ঢাকা পুনরুদ্ধারের কাজ এখনই শুরু করতে হবে। দক্ষিণ কোরিয়া যদি পারে, ঢাকাবাসী কেন পারবে না? দক্ষিণ কোরিয়ার মতো নেতৃত্ব থাকলে তবেই ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।

জাগো নিউজ: অবকাঠামো উন্নয়নের নামে সিটি করপোরেশনসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা সড়ক বিভাজক, ফুটপাতের গাছ সাবাড় করছে। তাদের বিষয়ে আপনার কী বলার আছে?

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: আমাদের নগরগুলোতে নতুন কর্তারা এলেই গাছ লাগানোর নামে পুরাতন গাছ কাটে আর সৌন্দর্য বৃদ্ধির নামে নতুন করে সড়ক বিভাজক তৈরি করে। যারা সৌন্দর্যের নামে গাছ কাটে তাদের রুচি প্রশ্নবিদ্ধ। এসব তারা করে কেবল নিজের দলের রাজনৈতিক কর্মীদের পুরস্কৃত করতে। এর সঙ্গে নগরের পরিবেশ রক্ষার বাস্তবতা সাংঘর্ষিক।

জাগো নিউজ: পরিবেশ রক্ষায় ভবিষ্যতে কি চ্যালেঞ্জ আরও বাড়বে?

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপপ্রবাহ, অনিয়মিত বৃষ্টিপাতসহ নানা দুর্যোগ বাড়ে দেশব্যাপী। অভিবাসীর সংখ্যা বাড়বে এই নগরীতে যদি উন্নয়ন বিকেন্দ্রীকরণ না হয় আর স্থানীয় পর্যায়ে অভিযোজন পর্যাপ্ত না হয়। একই সঙ্গে পরিবেশ বিপর্যয়ের ধারা না থামালে ঢাকা হয়তো এক পর্যায়ে পরিত্যক্তও হয়ে যেতে পারে, বিশেষজ্ঞরা এমন আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না।

জাগো নিউজ: এখন ঢাকায় প্রায় দুই কোটি মানুষ বাস করেন। মানুষের ঢাকামুখী প্রবণতা কীভাবে কমানো যায়?

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: ঢাকায় যে দুই কোটি মানুষ বসবাস করেন, তার মধ্যে একটি বড় অংশ বস্তিবাসী। ঢাকা তাদের পছন্দের আবাস নয়, নদীভাঙনের শিকার হয়ে কিংবা রোজগার আর কোনো কর্মসংস্থান না পেয়ে তারা বস্তির জীবন বেছে নিয়েছে। তাদের যদি সঠিক পুনর্বাসন করা যায় আর জলবায়ু অভিযোজন সঠিকভাবে করা যায়, তবে তারা গ্রামে ফিরে যাবে। ঢাকায় নিজস্ব ঠিকানা নেই এমন মানুষ ও উন্নয়ন বিকেন্দ্রীকরণ হলে ফিরে যাবেন নিজের আদি ভূমিতে।

আমরা ঈদের সময়ই দেখতে পাই ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়া জনস্রোত আর বসবাসের উপযোগী ঢাকা। সুতরাং, বিকেন্দ্রীকরণের সঠিক পরিকল্পনা আর বাস্তবায়ন হলে ঢাকা থেকে মানুষ স্বেচ্ছায় চলে যাবে বলেই আমার বিশ্বাস। ঢাকা থেকে সরকারি দপ্তরগুলো মালয়েশিয়ার আদলে নিকটবর্তী কোনো একটি শহরে নেওয়া এখন সময়ের দাবি। ঢাকার সঙ্গে পার্শ্ববর্তী শহরগুলোর যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত হলে সাভার, কেরানীগঞ্জ, গাজীপুর এসব এলাকা থেকেও লোকে সকালে এসে অফিস করে চলে যেতে পারে।

জাগো নিউজ: দেশে পাহাড় কাটা, নদী দখল চলছেই…

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: আমি মনে করি না যে পাহাড় আর নদী রক্ষায় সরকারের অঙ্গীকার শক্ত নয়, যা আছে তা প্রতিশ্রুতি। যদি অঙ্গীকারই থাকতো, তবে নদীখেকো কীভাবে নির্বাচনে মনোনয়ন পায় আর পাহাড়খেকো কীভাবে কাউন্সিলর হয়? আর বড় প্রকল্প মানেই অঙ্গীকার নয়, অঙ্গীকার তখনই মানুষের সমর্থন পাবে যখন তাতে সততা থাকবে আর মানুষের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকবে।

জাগো নিউজ: জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ দূষণ রোধে কার্বন নিঃসরণ কমানোর বিষয়টি এখন বিশ্বজুড়ে আলোচনার বিষয়। সে জায়গায় বাংলাদেশ কেন পিছিয়ে?

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: বাংলাদেশ মনে করছে উন্নয়ন করতে গেলে তাকে পরিবেশ ধ্বংস করতেই হবে। মানুষকে একটা ধাঁধায় ফেলে দেওয়া হয়েছে। আর তা হলো উন্নয়ন চাইলে পরিবেশের বিষয়টা বিসর্জন দিতে হবে। এ কথাটা মোটেও সত্য নয়। বাংলাদেশের যে উন্নয়ন চলছে তার কিছুটা জনগণের কাজে লাগলেও বেশিরভাগ কিন্তু চলে যাচ্ছে পরিবেশের বিপক্ষে।

ট্যানারি শিল্প বাঁচাতে গিয়ে সরকারের নদীগুলো বিসর্জন দেওয়ার যে মনস্তত্ত্ব তা বিচার করলেই বোঝা যায় সরকার আসলে শিল্পের নামে, রাস্তাঘাটের নামে বন, পাহাড়, নদীগুলো বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রকোপ থেকে বাঁচতে সরকারকে কিন্তু প্রাকৃতিক সম্পদ সুরক্ষায় মনোনিবেশ করতে হবে। তার কারণ হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে পরিবর্তনগুলো হবে, যে অভিযোজন হবে সেগুলোর জন্য যদি উন্নত বিশ্ব অর্থ সহায়তা না দেয় তাহলে এই প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করেই কিন্তু টিকে থাকতে হবে।

বাংলাদেশকে দেখা যাচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে উন্নত বিশ্ব থেকে টাকা পেতে যতটা আগ্রহী, টাকাটা সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে কিংবা প্রাকৃতিক সম্পদভিত্তিক অভিযোজনের বিষয়টা সুরক্ষিত রাখতে ততটা আগ্রহী নয়। বাংলাদেশ এখন মেগা প্রজেক্টের দিকে বেশি মনোযোগী এবং বাংলাদেশ সরকারি পর্যায়ের মনস্তত্ত্ব দেখতে পাচ্ছি উন্নয়ন মানেই মেগা প্রজেক্ট। এই মেগা প্রজেক্টগুলোও যে পরিবেশবান্ধব করা যায়, সে দৃষ্টিভঙ্গি, বিশ্বাস সরকারের মধ্যে একেবারে নেই।

জাগো নিউজ: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: জাগো নিউজকেও ধন্যবাদ।

এমএমএ/এএসএ/জেআইএম