মতামত

দূষণ নিয়ে রাজশাহীবাসীর উদ্বেগ : সবুজ সংহতি কমিটি গঠন

রাজশাহী মহানগরী সবুজ, পরিচ্ছন্ন, স্বাস্থ্যকর, দৃষ্টিনন্দন, উন্নত ও বাসযোগ্য পরিবেশবান্ধব হিসেবে খ্যাত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে রাজশাহী মহানগরবাসী পরিবেশের বিভিন্ন দিক দিয়ে কতটুকু নিরাপদে বসবাস করছেন- সেটা পরিবেশবাদীদের ভাবিয়ে তুলেছে। ২০১২ সালের ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের হাতে জাতীয় পরিবেশ পদক তুলে দিয়েছিলেন। ২০০৬ ও ২০০৯ সালে বৃক্ষরোপণে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন জাতীয় পুরস্কার লাভ করে।

Advertisement

২০১৬ সালে বাতাসে ক্ষতিকর ধূলিকণা কমাতে বিশ্বের সেরা শহর নির্বাচিত হয় রাজশাহী। ২০২০ সালে পরিবেশবান্ধব শহর হিসেবে রাজশাহী অর্জন করে "এনভায়রনমেন্ট ফ্রেন্ডলি সিটি অফ দ্য ইয়ার" সম্মাননা।২০২১ সালেও দ্বিতীয়বারের মত রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন পরিবেশ সংরক্ষণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ ক্যাটাগরির প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে জাতীয় পরিবেশ পদক পায়। কিন্তু এইসব অর্জন নিয়ে রাজশাহীবাসি বর্তমানে কী অবস্থায় আছেন, এ বিষয়ে সচেতন হওয়া জরুরি বলে পরিবেশবিদদের অভিমত।

আজ ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস। এই দিবসের লক্ষ্য হচ্ছে পরিবেশ এবং বিশ্বের মানুষকে রক্ষা করা। পরিবেশগত সমস্যা সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা বাড়াতে এবং পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্য ইতিবাচক পরিবেশগত পদক্ষেপ নিতে মানুষকে উৎসাহিত করার জন্য বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালন করা হয় ।২০২৪ সালের এই দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে,"ভূমি পুনরুদ্ধার, মরুকরণ এবং খরা প্রতিরোধ"।

দিন দিন রাজশাহী নগরী এবং সংলগ্ন বরেন্দ্র অঞ্চলের পরিবেশ ও প্রতিবেশ মারাত্মক বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে। এর ভয়াবহতা সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা অতি জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে সরকারি দপ্তরগুলোর ভূমিকা আলোচনা,মানববন্ধন এবং সমাবেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তাই আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে সঠিক পরিবেশে জীবন-যাপন করতে হলে, একটি বাসযোগ্য নগরী গড়তে চাইলে, মানুষকে পরিবেশ-প্রতিবেশ বিনাশী কর্মকান্ড থেকে বিরত রাখতে হলে আমাদের সকলের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের বিকল্প নেই"।

Advertisement

কিন্তু রাজশাহীবাসি এই পরিবেশ নিয়ে বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছে। পরিবেশের দিক দিয়ে রাজশাহী বিশ্বের বুকে যে সুনাম অর্জন করেছিল,তার অবস্থা কী? বিশেষ করে পুকুর ভরাট,পুনরুদ্ধার, মরুকরণ, খরা প্রতিরোধসহ সুপেয় পানি, শব্দদূষণ, প্লাস্টিক দূষণরোধে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তর, ওয়াসা, রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বিএমডিএসহ প্রশাসনের পদক্ষেপের প্রকৃত চিত্র কী? মহানগরবাসী পরিবেশগত দিক দিয়ে কতটুকু সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করছেন?

রাজশাহী মহানগরীকে ধীরে ধীরে যারা নবরূপ দান করেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম বর্তমান নগরপিতা এএইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনকে মনে করেন রাজশাহীবাসী। সরলা, সবুজ, কোলাহলশূন্য,শান্ত, নির্ঝঞ্জাট জনপদ রাজশাহীর শরীরে এই রূপের কারিগর পরিয়ে দিয়েছেন অলঙ্কারের পর অলঙ্কার। বানিয়েছেন আধুনিকা হিসেবে। এই চোখ ধাঁধানো বাহারি অলঙ্কার পরিধান করে রাজশাহী এখন আলো ঝলমলে এক অচেনা শহরে পরিণত হয়েছে এখানকার মানুষগুলোর কাছে। এখন সন্ধ্যা নামলেই রাজশাহী শহর হয়ে ওঠে আলো ঝলমলে এক অত্যুজ্জ্বল এলাকা। দৃষ্টিনন্দন অত্যাধুনিক সড়ক বাতিতে নতুন করে রাতের রাজশাহী হয়ে উঠেছে দেশসেরা আলোর নগরীতে। কিন্তু ঝলমলে এই আলোর দ্যুতি পরিবেশে কতখানি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, সে সম্পর্কে রাজশাহীবাসী কতটুকুই বা জানেন।

International Dark-Sky Association-এর মতে, কৃত্রিম আলোর অনুপযুক্ত বা অতিরিক্ত ব্যবহারই হলো আলোদূষণ। খুব সামান্য আলো হয়তো পরিবেশের তেমন কোন ক্ষতি করেনা, কিন্তু রাস্তা-ঘাটের উজ্জ্বল ল্যাম্পপোস্ট ঐ স্থানের স্বাভাবিক আলোর ভারসাম্য নষ্ট করে। Nature Study Society of Bangladesh-এর তথ্য মতে, এই আলোদূষণের ফলে মানুষের অনিদ্রা, মাথাব্যথা, অবসাদ, চিন্তা, মানসিক অশান্তি প্রভৃতি সমস্যাগুলো দেখা দেয়। নারীদের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে। পাখিদের উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। উদ্ভিদের ফুল ও ফল উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটে। পরাগায়ণও কমিয়ে দেয়।

এই রাজশাহী শহরে একসময় বিঘার পর বিঘা জুড়ে আমবাগান ছিল। বিশাল বিশাল আম্রকাননের ছায়ায় পাটি বিছিয়ে ক্লান্ত শরীরটাকে একটু জিরিয়ে নিতো শহুরের মানুষগুলো। ছিল পুকুরের পর পুকুর। শানবাঁধানো পুকুরে গোসল করার সেই দাপাদাপি দৃশ্য এখন আর চোখে পড়েনা। গরমের সময় দলবেঁধে সেইসব পুকুরে ছোট বড় সকলেই সাঁতার কাটতো। ডুব সাঁতার খেলতো। ঘন্টার পর ঘন্টা গোসল সেরে চোখ লাল করে বাড়িতে ফিরে মায়ের বকুনি খাওয়া- এগুলো রাজশাহীবাসীর এখন স্মৃতিময় অতীত কাহিনি। কিন্তু সেই মায়াভরা রাজশাহীতে নগরায়নের নামে শুরু হলো ধ্বংসযজ্ঞ। পৌরসভা থেকে হলো সিটি কর্পোরেশন। নগর থেকে হলো মহানগর। পরিণত হলো কংক্রিটের এক প্রাণহীন অপরিকল্পিত নগরী।

Advertisement

বর্তমানে অট্টালিকায় অট্টালিকায় ভরে উঠছে রাজশাহী মহানগর। বহুতল ভবনের মাঝে এখন সেই সুনীল আকাশ আর গোধুলি লগনে পাখীদের দলবেঁধে ঘরে ফেরার কাব্যিক দৃশ্য দেখা মেলা ভার। রাতে ঝিঁঝি পোকার একটানা সুর, চামচিকা আর বাদুরের কিচকিচানি, রাতভর ডাহুক-ডাহুকির কান্না, হুতোম পেঁচার গা ছম ছম করা ডাক আর শোনা যায় না। শীতের সময় এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত শিয়ালের চিৎকার শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়া এখন স্বপ্নের মত মনে হয়।ভোরবেলায় শহর সংলগ্ন পদ্মা নদীর তীরে জেলেদের ছাঁকুনি জালে রূপালি ইলিশ ধরার সেই মোহনীয় দৃশ্য আর চোখে পড়েনা।

ভয়ংকর শব্দদূষণে আক্রান্ত দেশের আলোকিত নগরী রাজশাহী। জাতিসংঘের ২০২২ সালে প্রকাশিত বৈশ্বিক প্রতিবেদনে রাজশাহীকে বিশ্বের চতুর্থতম শব্দ দূষণের শহর বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। জলবায়ু ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়েও বিষয়টি যাচাই করেছে। তারাও নিশ্চিত হয়েছে রাজশাহীতে শব্দদূষণের পরিস্থিতি গ্রহণযোগ্য মাত্রার অনেক ওপরে।যেখানে স্বাভাবিক মাত্রা থাকার কথা ৪০-৫০ ডেসিবল, সেখানে গড়ে ১১৯ ডেসিবল পর্যন্ত দেখা গেছে।

পরিবেশ,বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয় থেকে যে জরিপ চালানো হয়েছে,সেখানেও প্রায় একই অবস্থা। ঐ শব্দদূষণে শুধু প্রাপ্তবয়স্ক মানুষই নয়, শিশুরাও শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই শব্দসন্ত্রাসের ফলে রাজশাহী শহরের অধিকাংশ মানুষ কানের সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছে বলে রাজশাহী মেডিক্যালের ইএনটি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।

তারা জানায়, অতিরিক্ত শব্দের কারণে কানের নার্ভ ও রিসেপ্টর সেলগুলো নষ্ট হয়ে যায়। ফলে মানুষ শ্রবণশক্তি হারাতে থাকে। সরকারি নির্দেশনায় সব সিটি কর্পোরেশনকে নিরব এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে। যেখানে হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনিক এলাকা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সব নিরব এলাকা শব্দমুক্ত করার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ পুলিশ, সিটি কর্পোরেশন, বিআরটিএসহ বিভিন্ন সংস্থা একসঙ্গে কাজ করার কথাও সেখানে উল্লেখ আছে।অথচ এই নীরব ঘাতক শব্দদূষণের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কোন দপ্তর তেমন দৃশ্যমান কাজ করেনা বলে অভিযোগ রয়েছে।

রাজশাহীতে পানির অবস্থা বড়ই নাজুক। রাজশাহীর ঐতিহ্যের ধারক পদ্মা নদী দূষণে নাকাল অবস্থা। শহরের কোলঘেঁষা এই নদীর পানিতে নানা কারণে দূষণ বাড়ছে। ফলে পদ্মায় জলজ জীববৈচিত্র্য হুমকির মধ্যে পড়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি গবেষকরা বলছেন, পদ্মায় দূষণের মাত্রা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই দূষিত পানি কৃষিকাজে ব্যবহারে স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়াচ্ছে। তাঁরা বলেন, এই পানি ব্যবহারের ফলে কৃষিজমিতে ধাতব পদার্থের উপস্থিতিও পাওয়া গেছে।

এদিকে রাজশাহী ওয়াসার সরবরাহকৃত পানিতে দূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে বলে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবর থেকে জানা গেছে। এই পানির ৬০ ভাগই বিশুদ্ধ কিংবা নিরাপদ নয়। ২০১৯ সালে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) একদল গবেষক নগরীর ওয়াসার সরবরাহকৃত পানির উপর গবেষণা করেন। গবেষণায় ভয়াবহ এই তথ্য উঠে এসেছে। এই গবেষণায় ল্যাবরেটরি টেস্ট এবং যাবতীয় তথ্য বিশ্লেষণ করে তাঁরা প্রকাশ করে যে, বেশিরভাগ নমুনায় লোহার (আয়রন) উচ্চ ঘনত্ব রয়েছে প্রায় ৯০ ভাগ। প্রায় ৯৫ ভাগ দুর্গন্ধযুক্ত। কিছু নমুনায় চরম মাত্রার ঘোলাটে এবং ক্ষরতা রয়েছে। আয়রনের উচ্চ ঘনত্ব মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করে বলে চিকিৎসকদের মন্তব্য থেকে জানা যায়। তাছাড়া বাসাবাড়ির মূল্যবান সব সামগ্রী নষ্ট হয়। বেসিন, টাইলস,পানির পাইপ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মাথার চুল আঠালো হয়ে যায়। কাপড়-চোপড় ধোয়ার পর সেগুলো লালচে এবং হলুদ বর্ণ ধারণ করে। এই অবস্থা এখনো অব্যাহত।

২০১১ সালে রাজশাহীতে ওয়াসা সৃষ্টির পর তারা কেবলমাত্র পানি সাপ্লাই দেয়ার কাজই করেছে,পানি বিশুদ্ধ করার বিষয়ে কোনো ধরনের কাজ করেনি। যে প্রতিশ্রুতি নিয়ে তারা যাত্রা শুরু করেছিল, আজো তারা তা পূরণ করতে পারেনি। উপরন্তু জনগণকে জিম্মি করে ৩ গুণ পানির কর বৃদ্ধি করেছে। রাজশাহীতে দৈনিক পানির চাহিদা ১১ কোটি ৩২ লাখ লিটার। বিপরীতে ওয়াসা সরবরাহ করে ৯ কোটি লিটার। সুপেয় পানির পরিবর্তে তারা রাজশাহীবাসিকে খাওয়াচ্ছে ক্ষতিকারক উপাদানে ভরপুর অবিশুদ্ধ পানি।

অপরদিকে ২০১১ সালে নগরীর শ্যামপুরে ১০৩ কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপিত এএইচএম কামারুজ্জামান পানি শোধনাগারটি নগরবাসীর তেমন কোন কাজেই আসেনা।মাঝে মাঝে বন্ধ হয়ে থাকে। এই পানি শোধনাগারটি আজও পূর্ণাঙ্গরূপে চালু হতে পারেনি। নগরবাসী বাধ্য হয়ে সেই ক্ষতিকারক পানিই পান করে যাচ্ছে। এতে চক্ষুরোগ, চর্মরোগসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে দীর্ঘদিন ধরে এই গুরুতর সমস্যার সমাধান মিলছে না বলে মনে করেন স্থানীয় বাসিন্দারা ।

এদিকে ওয়াসার সরবরাহকৃত পানিতে বড় ধরনের সমস্যার কারণে এতদাঞ্চলের মানুষ সুপেয় খাবারের পানির বিকল্প হিসাবে হস্তচালিত নলকূপের পানিকেই নিরাপদ মনে করে পান করে আসছেন। কিন্তু সেই নলকূপের পানিতেও আর্সেনিক নামক বিষমিশ্রিত পানি তারা পান করছেন কিনা- সেই আতঙ্কও তাদের মধ্যে রয়েছে। কারণ,রাজশাহীতে প্রায় ২০ বছর আগে নলকূপের পানি পরীক্ষা করে অধিকাংশ নলকূপেই মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিকের উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়।দীর্ঘদিন ধরে রাজশাহীবাসী আর্সেনিক ঝুঁকিতে রয়েছে। অথচ আজ পর্যন্ত তার কোনো স্থায়ী সমাধান করেনি সরকার।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জনবল সংকটের কারণে তারা আর নলকূপের পানি পরীক্ষা করতে পারছে না। প্রতি বছর এই নিরব বিষের কারণে 'আর্সেনিকোসিস' রোগে আক্রান্ত হয়ে এর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবে নানা ধরনের অসুখ-বিসুখ হচ্ছে। ত্বকের ক্যানসার, মুত্রাশয়ের এবং ফুসফুসের ক্যানসারও এই আর্সেনিকের কারণে হয়ে থাকে। কিডনি, লিভার বড় হয়ে যাওয়া, টিউমারও হয় বলে চিকিৎসকদের মতামতে জানা গেছে। আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে তেমন কোনো গবেষণাও হয়নি। এমনকি এই আর্সেনিকের রোগে এ পর্যন্ত কত জন আক্রান্ত হয়েছেন, কত জন মারা গেছেন, তার কোনো সঠিক তথ্যও সরকারের কাছে নেই। ফলে বাধ্য হয়েই এতদাঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ আতঙ্ক নিয়েই আর্সেনিকযুক্ত পানিই পান করছেন।

রাজশাহীকে এক সময় পুকুরের শহর বলা হতো। কিন্তু এখন অধিকাংশ পুকুর বেআইনীভাবে ভরাট করে ফেলা হয়েছে। হেরিটেজ, রাজশাহীর' তথ্য থেকে জানা যায়,১৯৬০ সালে এই শহরে ৪ হাজার ২৩৮টি পুকুর ও জলাশয় ছিল। বোয়ালিয়া ভূমি অফিসের তথ্য মতে, সেই সত্তর দশক থেকে ভরাট হয়ে কমতে কমতে ২০১৪ সালে নগরীতে পুকুরের সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজারের কিছু বেশি,কিন্তু এর মধ্যে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৮শ' পুকুর ভরাট হয়ে গেছে। ২০২৩ সালে আরো কয়েকটি ভরাট হয়েছে। যেগুলো আছে নানা কৌশলে মালিকরা অনৈতিকভাবে সেগুলোর শ্রেণি পরিবর্তন করে ভরাটের প্রক্রিয়া চালাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে।

হিসাব মতে, ৯৮ ভাগ পুকুরই ভরাট হয়ে গেছে। অল্প বৃষ্টিতেই নগরীতে জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ পুকুর কমে যাওয়া। ফলে উত্তপ্ত হচ্ছে রাজশাহী। ঝুঁকি বাড়ছে অগ্নিকান্ডের। নগরীর মার্কেটগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় আরডিএ মার্কেট। অথচ এই মার্কেটটিও ২.১৩ একরের একটি পুকুর ভরাট করে করা হয়েছে। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা দোকানপাটের কারণে এবং আশেপাশে বড় কোনো জলাশয় না থাকায় সুউচ্চ আরডিএ মার্কেটটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে ফায়ার সার্ভিস।

পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন মহানগরীর ১২০টি পুকুরের মধ্যে ২২টি পুকুর ও জলাশয় সংরক্ষণ এবং সংস্কারের একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে অনেকদিন আগে। কিন্তু তার কোনো খবর নেই। ১০৭ ধরনের কাজের বিপরীতে "রাজশাহী মহানগরীর সমন্বিত নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের" নামে ৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ পায় রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন। অনেককে বলতে শোনা যায়, এত টাকা খরচ করার মত রাজশাহীতে জায়গা কোথায়। অথচ দুঃখের বিষয়, অতি গুরুত্বপূর্ণ ২২টি পুকুর সংরক্ষণ প্রকল্পটি কর্তৃপক্ষের কাছে গুরুত্বহীনভাবে মন্থর গতিতে এগুচ্ছে।

অপরদিকে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষও (আরডিএ) 'রাজশাহী মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান'-এর জন্য ১৬৫টি পুকুর ও জলাশয় চিহ্নিত করেছে।এর মধ্যে তারা প্রাথমিকভাবে ১০টি পুকুর সংরক্ষণ ও সংস্কারের বেশ কয়েক বছর হলো একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য,এর অগ্রগতির কোনো আশাব্যঞ্জক খবর তাদের কাছে নেই। গত কয়েক বছর আগে আরডিএ নগরীর পুকুর ভরাটের বিরুদ্ধে বেশ কিছুদিন ধরে প্রচারপত্র বিলি করেই তাদের দায়িত্ব শেষ করে।

প্রচারপত্র বিলির পর আরো কিছু পুকুর ভরাট হয়েছে,কিন্তু তাদের লক্ষণীয় কোনো ভূমিকাই নগরবাসী দেখেনি। একই অভিযোগ পরিবেশ অধিদপ্তরের বিরুদ্ধেও। তাদের কাছে অভিযোগপত্র দেয়া হলেও নানা অজুহাতে তারা দায়িত্ব এড়িয়ে যান। তাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই। এ পর্যন্ত কারো বিরুদ্ধে তারা শক্ত কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে, এ ধরনের তথ্য আমাদের জানা নেই।

পুকুর, জলাধার রক্ষায় ব্যর্থতার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা গেলে অনেকটা সফলকাম হওয়া যাবে বলে অনেকে মনে করেন। এগুলো পর্যালোচনা করে বুঝা যায়, সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা, বিদ্যমান আইন প্রয়োগে দুর্বলতা, অনিয়ম,সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও মনিটরিংয়ের সীমাবদ্ধতা, অদূরদর্শিতার কারণে মহানগরীর অনেক পুকুর ভরাট হয়ে গেছে।

সম্প্রতি রাজশাহী মহানগরীর প্রতিবেশব্যবস্থার উপর একটি আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা পরিচালিত হয়।ঐ গবেষণার ফলাফলে নগরীর প্রতিবেশব্যবস্থা ধ্বংসের পরিমাণ দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে জানানো হয়।গবেষণায় বলা হয়েছে, গত ৩০ বছরের মধ্যে এখানে জলাশয় অর্থাৎ পুকুর,দিঘি,খাল,বিল ডোবা কমেছে; জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়েছে।পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। এতে করে এখানকার মানুষ কোটি কোটি টাকার সেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, অষ্ট্রেলিয়ার নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা রাজশাহীসহ ঢাকা, চট্টগ্রাম,খুলনা ও সিলেট নগরের উপর গবেষণা করে এমন তথ্য পেয়েছেন। আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী 'ইকোলজিক্যাল ইনফরমেটিকস্'-এ এই গবেষণা প্রকাশিত হয় (তথ্য: প্রথম আলো)।এতে শহরগুলোতে দ্রুত তাপমাত্রা বাড়ছে ও বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠছে বলে গবেষণায় জানানো হয়।

রাজশাহী মহানগরীর পরিবেশ বিপর্যয়ের ভয়াবহ পরিণতির দিক লক্ষ্য করে মহামান্য হাইকোর্ট গত বছরের ৮ আগস্ট এক যুগান্তকারি রায় দিয়েছেন। রায়ে নগরীর ৯৫২ পুকুর অক্ষত ও প্রকৃত অবস্থায় রেখে সংরক্ষণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে আদালত সেখানে যাতে আর কেউ কোনো পুকুর দখল বা মাটি ভরাট করতে না পারে তা সিটি কর্পোরেশন, বন বিভাগ, পরিবেশ, আরডিএ, জেলা প্রশাসনসহ পুলিশ কমিশনার এবং অন্যান্য বিবাদিদের নিশ্চিত করতে বলেছেন। এমনকি রাজশাহীর অনেক পুরাতন দিঘির দখলকৃত অংশ পুনরুদ্ধার করে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে এনে সংরক্ষণের নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই নির্দেশের কোনো বাস্তব প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে না।

পরিবেশ অধিদপ্তরের উপাত্ত থেকে জানা যায়, বায়ুদূষণের অন্যতম উপাদান সালফার ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি আছে রাজশাহীর বাতাসে। মূলত সালফার ডাই-অক্সাইডের উপস্থিতি বাতাসকে বিষাক্ত করে। রাজশাহীর বাতাসে এ উপাদান বেশি থাকার কারণ হিসেবে মূলত এখানকার ইটভাটাকে দায়ি করা হয়।ইটভাটার পোড়ানো কয়লা থেকে এ ক্ষতিকর উপাদান বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে।ইটভাটার সংখ্যার দিক থেকে ঢাকার পরে দ্বিতীয় স্থানে রাজশাহী। তাছাড়া বড়পুকুরিয়ার কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সৃষ্ট সালফার ডাই-অক্সাইড এই অঞ্চলের বাতাসে মিশছে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন।বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় এ উপাদান বাতাসেই ভেসে থাকছে বলে তারা জানান।

ক্লিন সিটি বলে রাজশাহীকে যারা আখ্যা দিয়েছে,তা কত ভাগ সঠিক,তার ব্যাখ্যার প্রয়োজন রয়েছে।আসলে বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার চেয়ে রাস্তাঘাট কিছুটা পরিষ্কার-এটা বলা যায়।রাতের বেলায় ঝাড়ুদাররা শুধুমাত্র কাগজের বড় বড় টুকরা,প্লাস্টিক, পলিথিন,গাছের ঝরা পাতা, দোকানের সামনে ফেলে রাখা ময়লা আবর্জনা ঝাড়ু দিয়ে রাস্তার পাশে রেখে দেয়।পরে ভ্যান কিংবা ছোট ট্রাক এসে সেগুলো তুলে নিয়ে যায়।ঝাড়ুদাররা ধুলোবালি পরিষ্কার করে না। একটু বাতাস হলেই এসব ধুলোবালি পথচারীদের নাকে, চোখেমুখে ঢুকে যায়।ঐসব ট্রাক কিংবা ভ্যান বিভিন্ন ওয়ার্ডের ডাস্টবিন থেকে পচা দুর্গন্ধযুক্ত আবর্জনা পরিবহন করে শহরের মধ্যেই রাস্তার ধারে নির্দিষ্ট কয়েকটি ময়লার কেন্দ্রে ফেলে।

এর মধ্যে কয়েকটি উন্মুক্ত।সেগুলো থেকে তীব্র দুর্গন্ধ বের হয়ে আশেপাশের পরিবেশ নষ্ট করে।পথচারীদের নাকে রুমাল দিয়ে চলতে হয়।কয়েক মাস পর পর শহরের ড্রেনগুলো থেকে জমে থাকা দুর্গন্ধযুক্ত কালো রংয়ের কাদাপানি মিশ্রিত ময়লা শ্রমিকরা উত্তোলন করে রাস্তার ধারে স্তূপাকারে মাসের পর মাস ফেলে রাখে।এগুলো শুকিয়ে যাওয়ার পর তা ট্রাকে করে নিয়ে গিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলে।এর মধ্যে যদি বৃষ্টি হয়,তাহলে রাস্তাগুলো কাদা পানিতে সয়লাব হয়ে চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে।

রাজশাহীর পরিবেশের এই ভয়াবহতা উপলব্ধি করে এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনের অবহেলা এবং জনগণকে সচেতন করার লক্ষ্য নিয়েই গঠিত হয়েছে গ্রিন কোয়ালিশন বা সবুজ সংহতি কমিটি। রাজশাহী নগরিতে যেসব প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন পরিবেশ এবং নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করে তাদের সমন্বয়ে গত ৩ জুন সোমবার "রাজশাহীর প্রকৃতি ও পরিবেশ সুরক্ষায় নাগরিক ভাবনা ও সবুজ সংহতি বিষয়ক" এক আলোচনা ও মতবিনিময় সভায় এই কমিটি ঘোষণা করা হয়।কমিটির আহ্বায়ক নির্বাচিত হয়েছেন নদী ও পরিবেশ বিষয়ক গবেষক ও লেখক মাহবুব সিদ্দিকী এবং সদস্য সচিব নির্বাচিত হয়েছেন পরিবেশ আন্দোলন ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল ইসলাম রাজু।

সভায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়,"দিন দিন রাজশাহী নগরী এবং সংলগ্ন বরেন্দ্র অঞ্চলের পরিবেশ ও প্রতিবেশ মারাত্মক বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে। এর ভয়াবহতা সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা অতি জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে সরকারি দপ্তরগুলোর ভূমিকা আলোচনা,মানববন্ধন এবং সমাবেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তাই আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে সঠিক পরিবেশে জীবন-যাপন করতে হলে, একটি বাসযোগ্য নগরী গড়তে চাইলে, মানুষকে পরিবেশ-প্রতিবেশ বিনাশী কর্মকান্ড থেকে বিরত রাখতে হলে আমাদের সকলের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের বিকল্প নেই"।

লেখক: গোলাম সারওয়ার,সাবেক সভাপতি,রাজশাহী, প্রেসক্লাব।golamss636@gmail.com

এইচআর/এএসএম