অর্থনীতি

চিনি-চলচ্চিত্রে কমবে লোকসান, বিলুপ্ত পাট করপোরেশনে আসবে মুনাফা

আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রাষ্ট্রায়ত্ত ১৫টি চিনিকলের লোকসান ২৮১ কোটি টাকা কমবে বলে মনে করছে সরকার। চিনিকলের পাশাপাশি লোকসান কমবে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) খাতেও। নতুন অর্থবছরে বিএফডিসির লোকসান কমবে প্রায় এক কোটি টাকা। একই সময়ে বিলুপ্ত প্রায় বাংলাদেশ পাট করপোরেশন (বিজেসি) থেকে মুনাফা করবে সরকার। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে এমন প্রাক্কলন করা হতে পারে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।

Advertisement

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৫৭ সালের ১৫ নম্বর অ্যাক্ট অনুযায়ী বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) প্রতিষ্ঠিত হয়। করপোরেশন চলচ্চিত্র শিল্পের সার্বিক উন্নয়নে সহায়তা দেওয়ার লক্ষ্যে চলচ্চিত্র নির্মাণ, স্টুডিও প্রতিষ্ঠা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ব্যক্তি বা কোম্পানিকে ঋণ দেয়া, করপোরেশন কর্তৃক নিজেদের স্টুডিও স্থাপন এবং ভাড়ার বিনিময়ে চিত্র নির্মাতাদের স্টুডিও ব্যবহারের সুযোগ দিয়ে থাকে। এছাড়া বিএফডিসি বিভিন্ন উপায়ে চলচ্চিত্র শিল্পের বিকাশ ও উন্নয়নে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সহায়তা করে।

তবে লোকসানের মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত এ প্রতিষ্ঠানটি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে বিএফডিসির নিট লোকসানের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হতে পারে ২০ কোটি ৬২ লাখ টাকা। যা চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় ৮১ লাখ টাকা কম। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে বিএফডিসির নিট লোকসান নির্ধারণ করা হয় ২১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা।

২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে বিএফডিসির নিট লোকসানের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হতে পারে ২০ কোটি ৬২ লাখ টাকা। যা চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় ৮১ লাখ টাকা কম। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে বিএফডিসির নিট লোকসান নির্ধারণ করা হয় ২১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা

Advertisement

এছাড়া ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিএফডিসির বিক্রয় রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হতে পারে ৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা। বিপরীতে মোট পরিচালন ব্যয় ধরা হতে পারে ২৪ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। ফলে পরিচালন লোকসান হবে ২০ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। অর্থবছরটিতে বিএফডিসির অ-পরিচালন আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হতে পারে দুই কোটি দুই লাখ টাকা এবং অপরিচালন ব্যয় ধরা হতে পারে দুই কোটি ২০ লাখ টাকা।

আরও পড়ুন

ভারতীয় ‘চোরাই’ চিনিতে সয়লাব বাজার বাংলাদেশে চিনির দাম ভারতের আড়াই গুণ

বিএফডিসির এ চিত্র তুলে ধরা হলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর জাগো নিউজকে বলেন, এফডিসিতে কিছু অনুদান দেওয়া হয় আর্ট ফিল্ম তৈরির জন্য। আমি মনে করি এখানে আরও একটু বিনিয়োগ করলে খারাপ হয় না। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি তুলে ধরা এবং সমাজে সচেতনতা বাড়ানো সংক্রান্ত ফিল্ম তৈরিতে উৎসাহিত করা দরকার। এখানে ৪০-৫০ কোটি টাকা খরচ করলে কিছু আসবে, যাবে না।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের অধীন বর্তমানে ১৫টি মিল আছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এই ১৫টি মিলের বিক্রয় রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ১ হাজার ২৯৮ কোটি ৮৪ লাখ টাকা ধরা হতে পারে। যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ৪৯৪ কোটি ৫১ লাখ টাকা বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে এ প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বিক্রয় রাজস্ব নির্ধারণ করা হয়েছে ৮০৪ কোটি ৩৩ লাখ টাকা।

Advertisement

অন্যদিকে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এ প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ১ হাজার ১৯৫ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ধরা হতে পারে। এর মধ্যে উৎপাদন ব্যয় ১ হাজার ৮৮ কোটি ৮৯ লাখ টাকা এবং অন্যান্য পরিচালন ব্যয় ১০৬ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। ফলে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোর পরিচালন মুনাফা হবে ১০৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা।

বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের অধীন বর্তমানে ১৫টি মিল আছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এই ১৫টি মিলের বিক্রয় রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ১ হাজার ২৯৮ কোটি ৮৪ লাখ টাকা ধরা হতে পারে। যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ৪৯৪ কোটি ৫১ লাখ টাকা বেশি

২০২৪-২৫ অর্থবছরে চিনিকলগুলো পরিচালন মুনাফা করলেও অ-পরিচালন ব্যয়ের কারণে বড় লোকসান গুনতে হবে। আগামী অর্থবছরে মিলগুলোর অ-পরিচালন ব্যয় হবে ৫২৫ কোটি ৮৪ লাখ টাকা এবং অ-পরিচালন আয় হবে ১৩২ কোটি ২৮ লাখ টাকা। এতে আগামী অর্থবছরে চিনকলগুলোর নিট লোকসানের লক্ষ্যমাত্রা ২৯০ কোটি ২০ লাখ টাকা ধরা হতে পারে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এ মিলগুলোর লোকসান ধরা হয় ৫৭১ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এ হিসাবে চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরে চিনিকলগুলোর লোকসান ২৮১ কোটি ৩৮ লাখ টাকা কমবে।

এদিকে, ১৯৮৩ সালে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ১৯৮৫ সালে ৩০ নম্বর অধ্যাদেশ বলে পাঁচটি সংস্থা- বাংলাদেশ জুট মার্কেটিং করপোরেশন, বাংলাদেশ জুট ট্রেডিং করপোরেশন, বাংলাদেশ জুট এক্সপোর্ট করপোরেশন, এপিসি (রেলি) এবং বিশেষ সম্পত্তি (পাট) সেলকে একত্রিত করে ‘বাংলাদেশ জুট করপোরেশন (বিজেসি)’ গঠন করা হয়। এ করপোরেশনের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল পাট চাষিদের উৎপাদিত পাটের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা, চোরাচালান রোধে সীমান্তবর্তী এলাকায় পাট ক্রয় ও গুদামজাতকরণ, পাটের বাজারমূল্য স্থিতিশীল রাখা এবং বিদেশে পাট রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন।

সরকারের বিরাষ্ট্রীয়করণ নীতিমালার আলোকে ১৯৯৩ সালের ১২ অক্টোবর এ করপোরেশনের যাবতীয় কার্যক্রম বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ লক্ষ্যে সংস্থার যাবতীয় সম্পত্তি দেখাশোনা, রক্ষণাবেক্ষণ ও বিক্রয় করার জন্য শুধু ২৪৪ জনবলের একটি বিলুপ্ত সেল গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। এই বিলুপ্ত বিজেসি থেকে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে নিট ৪৯ লাখ ৪৪ হাজার টাকা মুনাফার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হতে পারে।

আরও পড়ুন

ঘুরে দাঁড়াতে সরকারের সহযোগিতা চান পাটশিল্প ব্যবসায়ীরা চলচ্চিত্র নির্মাণের অনুদানে আরও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে সরকার

নিট মুনাফা হলেও বিজেসির পরিচালন লোকসানে থাকবে। কারণ, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এর আয় থাকবে শূন্য। বিপরীতে পরিচালন ব্যয় হবে ৪ কোটি ৫৭ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। ফলে পরিচালন লোকসানও দাঁড়াবে ৪ কোটি ৫৭ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। তবে ৫ কোটি ৭ লাখ টাকা অ-পরিচালন আয় করবে বিজেসি। ফলে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে নিট মুনাফা হবে ৪৯ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে বিজেসির নিট মুনাফা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭৭ লাখ ৯৪ হাজার টাকা। এ হিসাবে চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরে বিজেসির নিট মুনাফা ২৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা কম হবে।

রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় লোকসানের কারণ সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। তারা এটিকে পালন করছে নিজেদের স্বার্থে। সরকারি কর্মকর্তারা এখানে পদাধিকার বলে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছে। এখানে একটা দুষ্টচক্র কাজ করছে এবং সরকার এটিকে পুষছে।- আহসান এইচ মনসুর

বিলুপ্ত বিজেসি থেকে মুনাফা করার লক্ষ্যমাত্রা ধরার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে আহসান এইচ মনসুর জাগো নিউজকে বলেন, অ-পরিচালন আয় নিয়ে আমাদের প্রশ্ন আছে। কোন সোর্স থেকে এ আয় আসছে, সেটি বাজেটে পরিষ্কার করা উচিত। কারণ, পরিচালন ব্যয়ের চেয়ে সার্বিক আয় কখনো বেশি হতে পারে না। পরিচালনাতেই লোকসান, তাহলে তো এই প্রতিষ্ঠান কখনো ভালো হতে পারে না।

তিনি বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় লোকসানের কারণ সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। তারা এটিকে পালন করছে নিজেদের স্বার্থে। সরকারি কর্মকর্তারা এখানে পদাধিকার বলে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছে। এখানে একটা দুষ্টচক্র কাজ করছে এবং সরকার এটিকে পুষছে।

‘এতো টাকা কেন দেবে সরকার। গত ৫০ বছর ধরে তো দিয়ে আসছে। কত লাখ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে, সরকার সে হিসাবটা করুক। এত টাকার বিনিময়ে কী পেয়েছে দেশের মানুষ। কিছু তো পায়নি। এগুলো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এমনিতেই করতে পারে’- যোগ করেন আহসান এইচ মনসুর।

এমএএস/এমকেআর/এমএস