অর্থনীতি

বিদ্যুতে বড় লোকসান, পানি বেচে আসবে লাভ

আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের লোকসান বেড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২৪) তুলনায় এ লোকসানের পরিমাণ হবে তিনগুণ বেশি। তবে এসময়ে বিদ্যুতে বিপুল লোকসান হলেও পানি বিক্রি করে বড় মুনাফা করবে সরকার।

Advertisement

নতুন অর্থবছরে চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ, ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ, খুলনা ওয়াসা এবং রাজশাহী পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে প্রায় ৩৩৮ কোটি টাকা মুনাফা হবে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে এমন প্রাক্কলন করা হচ্ছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।

আগামী ৬ জুন জাতীয় সংসদে প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। ওই বাজেট প্রস্তাবনায় রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের চিত্রও তুলে ধরা হবে।

আরও পড়ুন

Advertisement

সীতাকুণ্ডে দুই মাস ধরে ওয়াসার পানির তীব্র সংকট জুলাই থেকে পানির দাম ১০ শতাংশ বাড়ালো ঢাকা ওয়াসা

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হতে পারে ৪ লাখ ১ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে পরিচালন রাজস্ব ৩ লাখ ৫৩ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা ও অ-পরিচালন আয় ৪৮ হাজার ১৩৬ কোটি টাকা। বিপরীতে মোট ব্যয় হবে ৪ লাখ ২৯ হাজার ৭৩৬ কোটি টাকা। ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিট লোকসান হবে ২৮ হাজার ৪৭ কোটি টাকা।

চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে বিউবোর লোকসান ধরা হয়েছে ৬ হাজার ১১৭ কোটি ১৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরের বাজেটে বিউবোর লোকসান বাড়ছে ১১ হাজার ৯৮৯ কোটি ১১ লাখ টাকা

চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর লোকসানের পরিমাণ ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা। এ হিসাবে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় নতুন অর্থবছরে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর লোকসানের পরিমাণ বাড়বে ২২ হাজার ৫৮ কোটি টাকা বা ৪ দশমিক ৬৮ গুণ।

রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর এই বিপুল লোকসানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিউবো)। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিউবোর লোকসান বেড়ে ১৮ হাজার ১০৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় এই লোকসানের পরিমাণ প্রায় ৬ গুণ বেশি। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে বিউবোর লোকসান ধরা হয়েছে ৬ হাজার ১১৭ কোটি ১৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরের বাজেটে বিউবোর লোকসান বাড়ছে ১১ হাজার ৯৮৯ কোটি ১১ লাখ টাকা।

Advertisement

বিউবো বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগের অধীন একটি সেবামূলক জনহিতকর প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য নিরবচ্ছিন্ন ও গুণগত মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের মাধ্যমে দেশের আর্থ-সামজিক ও মানবসম্পদ উন্নয়নে সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা। বিউবো সবার জন্য সাশ্রয়ী দামে বিদ্যুৎ সরবরাহের লক্ষ্যে ঢাকাসহ চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ ও সিলেটের শহরাঞ্চলসহ কিছু কিছু গ্রামীণ এলাকায়ও বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্ব পালন করছে।

বর্তমানে বিউবো নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি সিঙ্গেল বায়ার (একক ক্রেতা) হিসেবে সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনছে। এছাড়াও ডিপিডিসি, ডেসকো, ওজোপাডিকো, নেসকো, আরইবি ও নিজস্ব বিতরণ অঞ্চলেও বিদ্যুৎ বিক্রি করছে বিউবো।

চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে পানি বিক্রি করে মুনাফার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২৯৮ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। এ হিসাবে চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরে পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশনের মাধ্যমে ৩৮ কোটি ৫৬ লাখ টাকা বেশি নিট মুনাফা করবে সরকার

আগামী অর্থবছরের বাজেটে বিউবোর লোকসানের লক্ষ্যমাত্রা উল্লেখ করা হলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর জাগো নিউজকে বলেন, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরও এতো লোকসান হবে। পাবলিকের মাথায় একেবারে বাঁশ মারছে সরকার। এমন সব চুক্তি করছে পয়সা খেয়ে…।

তিনি বলেন, আমি মনে করি সরকারের উচিত বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বসে চুক্তিগুলো পুনর্বিবেচনা করা। বলতে হবে আমরা এই দাম দিতে পারবো না, ন্যায্য দাম ঠিক করতে। তাদের (কোম্পানির) দাবি-দাওয়া কমিয়ে ফেলতে হবে। ক্যাপাসিটি চার্জ জিরো করতে হবে। সব রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট বন্ধ এবং ভারতীয় কোম্পানি আদানির সঙ্গে চুক্তি পুনর্বিবেচনা করাও উচিত।

আরও পড়ুন

বকেয়া বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের তাগিদ দিলো আদানি গ্রুপ বাজেটে জনপ্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটবে কি?

‘রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় লোকসানের কারণ সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। তারা এটিকে পালন করছে নিজস্ব স্বার্থে। সরকারি কর্মকর্তারা এখানে পদাধিকার বলে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছে। এখানে একটা দুষ্টচক্র কাজ করছে এবং সরকার এটি পুষছে। এতো কোটি টাকা কেন দেবে সরকার। গত ৫০ বছর ধরে দিয়ে আসছে। কত লাখ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে, হিসাব করুক সরকার। এখান থেকে কী পেয়েছে দেশের মানুষ, কিছু তো পায়নি। এগুলো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এমনিতেই করতে পারে’- এ প্রসঙ্গে যোগ করেন আহসান এইচ মনসুর।

বিদ্যুতে বড় লোকসান হলেও চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরে পানি বিক্রি করে বেশি মুনাফা করবে সরকার। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ, ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ, খুলনা ওয়াসা এবং রাজশাহী পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ৩৩৭ কোটি ৯০ লাখ টাকা মুনাফা করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

ওয়াসা প্রফিটে আছে। সরকারের উচিত হবে পানির দাম আর না বাড়ানো। ওয়াসা তো প্রফিট অর্গানাইজেশন নয়, সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। মুনাফা করা তো এ প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য নয়।- পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর

চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এ চার কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে মুনাফার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২৯৮ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। এ হিসাবে চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরে পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশনের মাধ্যমে ৩৮ কোটি ৫৬ লাখ টাকা বেশি নিট মুনাফা করবে সরকার।

এর মধ্যে ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আগামী অর্থবছরে ২৩৫ কোটি ৮৮ লাখ টাকা নিট মুনাফা করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হতে পারে। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এ কর্তৃপক্ষটির নিট মুনাফার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২১৪ কোটি ৯২ লাখ টাকা। অর্থাৎ, ঢাকা ওয়াসা চলতি বছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরে ২০ কোটি ৯৬ লাখ টাকা বেশি নিট মুনাফা করবে।

ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ একটি সেবামূলক স্বায়ত্তশাসিত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, যা ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সংস্থা পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ আইন-১৯৯৬ অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমানে ঢাকা ওয়াসা প্রায় ৩৬০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় প্রায় ২০ মিলিয়ন জনগণকে দৈনিক প্রায় দুই হাজার ৮৫০ মিলিয়ন লিটার পানি সরবরাহ করছে।

চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষের নিট মুনাফার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৭৫ কোটি ৭১ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এ কর্তৃপক্ষটির নিট মুনাফা ধরা হয়েছে ৫৮ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ, চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরে চট্টগ্রাম ওয়াসা ১৬ কোটি ৯৭ লাখ টাকা বেশি মুনাফা করবে।

খুলনা ওয়াসার নিট মুনাফার লক্ষ্যমাত্রা আগামী অর্থবছরের জন্য ৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হতে পারে। চলতি অর্থবছরে এ কর্তৃপক্ষটির নিট মুনাফার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ, খুলনা ওয়াসার মাধ্যমে চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরে ২২ লাখ টাকা কম মুনাফা করা হবে।

রাজশাহী পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আগামী অর্থবছরে ২২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা নিট মুনাফা করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হতে পারে। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এ কর্তৃপক্ষটির মাধ্যমে নিট মুনাফার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২০ কোটি ৮০ লাখ টাকা। অর্থাৎ, রাজশাহী ওয়াসা চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরে ১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা বেশি মুনাফা করবে।

ওয়াসার মাধ্যমে মুনাফার লক্ষ্যমাত্রার বিষয়টি উল্লেখ করা হলে আহসান এইচ মনসুর জাগো নিউজকে বলেন, ওয়াসা প্রফিটে আছে। সরকারের উচিত হবে পানির দাম আর না বাড়ানো। পানির দাম যেন আগামী দিনগুলোতে আর না বাড়ে সেটা সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে। ওয়াসা তো প্রফিট অর্গানাইজেশন নয়, সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। মুনাফা করা তো এ প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য নয়। যে টাকা বিনিয়োগ করবে, সেটুকু তুলতে আনবে, এটুকুই।

এমএএস/এমকেআর/এমএস