ফিচার

বঙ্গদেশে চা পান শুরু হয় যেভাবে

চা জড়িয়ে আছে বাঙালির প্রতিক্ষণে। সারাদিন নানান স্বাদের চায়ে তৃষ্ণা মেটান চা প্রেমীরা। দুধ, চিনি দিয়ে চা খান অনেকে।সকালে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে দিন শুরু করেন অনেকে। এরপর কাজের ফাঁকে নিজেকে চাঙ্গা রাখতে এক-দুই কাপ রং অথবা দুধ চা খান। সন্ধ্যায় বন্ধুদের আড্ডায় কিংবা সারাদিনের ক্লান্তি দূর করতে চায়ের জুড়ি মেলা ভার।

Advertisement

কিন্তু জানেন কি? বাঙালির প্রতিটিক্ষণ রঙিন করে যে চা তা কিছু আবিষ্কার হয়েছিল সুদূর চীনে। সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারের সেই জনপ্রিয় পানীয় বাঙালির কাছে এলো কীভাবে। চীনে চায়ের ব্যবহার শুরু হয় ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। তবে তা পানীয় হিসেবে নয়, সেসময় চায়ের পাতা ব্যবহার হতো কেক তৈরিতে। সেটাও আবার মৃতদের জন্য।

এই চা চীনাদের থেকে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল। ষোড়শ শতকে ডাচরা চীন থেকে প্রচুর পরিমাণে চা নিয়ে আসে ইউরোপে। এরপর সেখানে চায়ের ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়। পৃথিবীব্যাপী চায়ের ব্যাপক বিস্তৃতির জন্য অনেকেই একজন পর্তুগিজ নারীকে কৃতিত্ব দেন, তিনি রানি ক্যাথেরিন অব ব্রাগানজা। রানি ক্যাথেরিন ছিলেন চায়ের অসম্ভব ভক্ত। ১৬৬১ সালে তার সঙ্গে ব্রিটেনের রাজা দ্বিতীয় চার্লসের বিয়ে হয়। ব্রিটিশ রাজপরিবারে চায়ের প্রবেশ ঘটে। এরপর ব্রিটিশদের হাত ধরে চা আছে বঙ্গদেশে।

আরও পড়ুন

Advertisement

১২ হাজার বছর আগেও গৃহপালিত প্রাণির দুধ পান করত মানুষ 

বিশ্বব্যাপী ব্রিটিশরা বিশাল উপনিবেশ সৃষ্টি করার পাশাপাশি সেসব স্থানে চায়ের প্রচলনও ঘটায়। ব্রিটিশরা প্রথমে রুপার বিনিময়ে চীন থেকে চা নিয়ে আসতো। কিন্তু পরবর্তীতে বিনিময় মাধ্যম হিসেবে তারা আফিম ব্যবহার শুরু করে। এই বিষয়টি চীনে সমস্যা সৃষ্টি করে, কারণ প্রচুর মানুষ আফিমে আসক্ত হয়ে পড়ে তখন। এজন্য ১৮৩৯ সালের দিকে এক চীনা কর্মকর্তার নির্দেশে আফিম ভর্তি সব ব্রিটিশ জাহাজ ধ্বংস করে দেওয়া হয়। এই ঘটনা থেকেই মূলত ইতিহাসখ্যাত আফিম যুদ্ধের সূত্রপাত! চিং রাজবংশের সময় এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

বঙ্গ প্রদেশে কালো চায়ের চাষ ব্রিটিশ শাসনামলের সময় শুরু হয়েছিল। ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা ১৮৪০ সালে এই উপমহাদেশের সর্বপ্রথম চা বাগান বন্দর নগরী চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠা করে, যখন কলকাতা বোটানিক্যাল গার্ডেন থেকে চীনা চায়ের গাছ এনে চট্টগ্রাম ক্লাবের পাশে রোপণ করা হয়।

এর আগে অবশ্য চীনের চা উৎপাদনের একচেটিয়া আধিপত্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে ব্রিটিশরা প্রথম ১৮২৪ সালে ভারতে বাণিজ্যিকভাবে চা ফসল চালু করে। এরপর থেকে এটি দার্জিলিং, নীলগিরি এবং আসামজুড়ে প্রচুর পরিমাণে চাষ করা হয়।

বাংলাদেশে চায়ের উৎপাদন শুরু ১৮৪৩ সালে। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তীরে প্রথম চা তৈরি এবং পান করা হয়। বাণিজ্যিকভাবে প্রথম চা চাষ শুরু হয় ১৮৫৭ সালে সিলেটের মালনীছড়া চা বাগানে। সিলেট অঞ্চলের সুরমা নদী উপত্যকা পূর্ব বাংলার চা উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পায়। চা চাষ নিম্ন ত্রিপুরা (বর্তমান কুমিল্লা) এবং উত্তর বঙ্গের পঞ্চগড়েও শুরু হয়।

Advertisement

১৯৫৭ সালের ৪ জুন থেকে ১৯৫৮ সালের ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত চা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনিই ছিলেন চা বোর্ডের প্রথম বাঙালি চেয়ারম্যান। তিনি সেসময় চা শিল্পের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। পরবর্তীতে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত চা শিল্পের পুনর্বাসনে অসামান্য অবদান রাখেন তিনি।

এর প্রেক্ষিতে ৪ জুন জাতীয় চা দিবস পালনের উদ্যোগ বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। শুধু তাই নয়, দেশের অর্থকারী ফসলের মধ্যে চা অন্যতম। দেশে প্রতি বছর ৯ কোটি কেজির বেশি পরিমাণে চা উৎপাদন হয়। এর বেশিরভাগই বিক্রি হয় দেশিয় বাজারে। ২০২০ সালে ১৯টি দেশে চা রপ্তানি করে প্রায় ৩৫ কোটি টাকা আয় করেছে দেশ। চা বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বাধিক ব্যবহৃত পানীয়। কিছু মানুষের কাছে চা তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। দেশে চাষ হয় এবং খুব সহজলোভ্য হওয়ার পর থেকে ঘরে ঘরে চা পানের অভ্যাস তৈরি হয়। অতিথি এলে চা দেওয়া ছিল সেসময় আভিজাত্যের অংশ।

বর্তমানে দেশে বিভিন্ন ধরনের চা জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মটকা চা বা তন্দুরি চা। এই চা বানানো হয় টিন, সিমেন্টে বানানো ড্রামের মতো দেখতে বিশেষ চুলায়। আবার কোথাও কোথাও মাটির চুলাতে এই চা বানাতে দেখা যায়। এর মধ্যে কয়লার আগুনে পুড়ছে মাটির ছোট্ট মটকা। পাশেই স্টিলের কেটলিতে রাখা বাড়িতে বানানো বিশেষ মশলার দুধ চা। ক্রেতার ফরমাশ এলে তামার পাত্রে জ্বলন্ত মটকা রেখে তাতে চা ঢালা হয়। মটকার তাপে চা ফুটতে থাকে, বের হয় ধোঁয়াটে সুবাস। এভাবেই ভিন্ন স্বাদের মটকা চা বানাতে দেখা যায় দেশের বিভিন্ন জায়গায়। এছাড়া মাল্টা চা, কাঁচা মরিচের চা, তেঁতুলের চা সহ বিভিন্ন স্বাদের চা রসনা মেটাচ্ছে বাঙালির।

আরও পড়ুন

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঐতিহ্যবাহী পুতুল নাচ  বিশ্বে তামাক সেবনের কারণে বছরে ৮০ লাখ মানুষ মারা যায় 

কেএসকে/জিকেএস