পাবনা জেলায় গত এক দশকে ঘাস চাষে বিপ্লব ঘটেছে। জেলার অধিকাংশ সড়কের দুপাশের পতিত জমিতে নেপিয়ার, জাম্বু বা পরা জাতের ঘাস চাষ হচ্ছে। এর প্রধান কারণ বৃহত্তর পাবনায় গাভি পালন বেড়েছে। এতে জেলায় দুধের চাহিদা মিটে বছরে সাড়ে ৪ লাখ মেট্রিক টন দুধ অন্য জেলাতেও সরবরাহ করা হয়। সবুজ ঘাসের প্রাচুর্যই এ অঞ্চলে দুধের নহর বইয়ে দিচ্ছে।
Advertisement
জানা গেছে, পাবনা জেলায় মোট ৬৩৯১টি গাভির খামার রয়েছে। এছাড়া এখানকার গো বাথানগুলোতেও পালিত হয় লাখ লাখ গরু। এ অঞ্চলে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উন্নতজাতের গাভি পালন বাড়ছে। জেলায় বছরে সাড়ে ৯ লাখ মেট্রিক টন দুধ উৎপাদিত হয়। আর বছরে চাহিদা ৫.২ লাখ মেট্রিক টন দুধ। বছরে উদ্বৃত্ত থাকছে ৪.৫ লাখ মেট্রিক টন।
এভাবে দুধ উৎপাদনকারী গাভি পালন যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে গো-খাদ্যের চাহিদা। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দিন দিন গো খাদ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। গোখাদ্যের চাহিদা পুরণের জন্য বাথানের জায়গা সংকুচিত হয়েছে। অন্যদিকে বোনা আমনের পরিবর্তে উফশী বা হাইব্রিড জাতের ধান চাষ বেড়ে যাওয়ায় খড়ের উৎপাদন কমে গেছে।
গো-খাদ্যের সংকট বেড়েছে। সে সংকট মোকাবিলায় বিভিন্ন জাতের ঘাসের বাণিজ্যিক উৎপাদন বাড়ছে। ফলে নদীর কিনারা থেকে শুরু করে ধানের চাতালের ছাইয়ের ঢিবিতে পর্যন্ত ঘাসের চাষ হচ্ছে। মাঠের পর মাঠ জুড়েও সবুজ ঘাসের ক্ষেত। লাভজনক বিবেচনা করে অনেকে সবুজ এ ঘাসকে ‘সবুজ সোনা’ বলে হয়ে থাকে।
Advertisement
নিজের খামারের গরুর জন্য কেউ কেউ ঘাস চাষ করেন আবার কেউ কেউ বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ঘাস চাষ করছেন। এমন অনেক সফল ঘাস চাষি রয়েছেন যাদের নিজের কোনো সম্পত্তিই নেই। অন্যের জমি লিজ নিয়ে ঘাস চাষ করে অনেকে সাফল্যের মুখ দেখেছেন।
পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলায় যে হারে ঘাস চাষ বাড়ছে তাতে অনেকেই অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়ে উঠছেন। পাবনাতেই কয়েকশ’ একর জমিতে নেপিয়ার ঘাস চাষ হচ্ছে।
পশুসম্পদ বিভাগের কর্মীরা জানান, নেপিয়ার ঘাসের বীজ আসে নিউজিল্যান্ড থেকে। বহুবর্ষজীবী এ ঘাসের চারা একবার রোপণ করে বা বীজ বপন করে ওই জমি থেকে সাত-আটবার ঘাস সংগ্রহ করা যায়। বীজ বপনের ৫০ দিনের মধ্যে ঘাস বাজারজাতকরণের উপযোগী হয়ে ওঠে। একবার ঘাস কাটার পর মোথা থেকে আবার প্রায় দেড় মাসের মধ্যে কাটার উপযোগী হয়ে ওঠে।
চাষিরা জানান, সারা বছরই ঘাস উৎপাদন সম্ভব। পানি সেচের ব্যবস্থা থাকলে ১২ মাসে ১৪ বার ঘাস কাটা যায়। প্রতি কাটায় বিঘা প্রতি লাভ হয় দশ-বার হাজার টাকা। ফলন বাড়ানোর জন্য ইউরিয়া, পটাশ বা ফসফেট সার ব্যবহার করা হয়।
Advertisement
পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার নাগডেমরার তফিজ সেখ, ধুলাউড়ির আব্দুল আজিজ, ঘুঘুদহ বিলপাড়ের বাসিন্দা জগলুল করিমের মত অনেকে যেমন ঘাস চাষ করে লাখপতি হয়েছেন তেমনি ঘাস কেনা-বেচার জন্য বাজার গড়ে ওঠায় বহু লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। ঘাসের বীজ বিক্রির জন্য অনেক দোকান গড়ে উঠেছে।
চাষিরা জানান, এখন ঘাসের যে দর তাতে এক বিঘা জমি থেকে বছরে এক লাখ টাকা আয় করা সম্ভব। কীভাবে সম্ভব? এ প্রশ্নে বেড়া উপজেলার হাতিগাড়া গ্রামের চাষি লোকমান হোসেন জানান, তিনি ঘাসের চারা বপনের ৪৫ দিনের মধ্যে ১৫ হাজার টাকার ঘাস বিক্রি করেছেন, তার দেড় মাস পর ১৪ হাজার টাকা, এর দেড় মাস পর ১০ হাজার টাকার ঘাস বিক্রি করতে পেরেছেন। অর্থাৎ মাত্র সাড়ে চার-পাঁচ মাসের মধ্যে ৩৯ হাজার টাকার ঘাস বিক্রি করেছেন। এভাবে বছরে এক লাখ টাকার ঘাস অনায়াসে বিক্রি করা সম্ভব। বিষয়টি সরল করে বললে-মাত্র এক বিঘা ঘাস আবাদে এক বছরে লাখপতি হওয়া যায়।
ঘাসচাষ চাষির জন্য যেমন লাভজনক তেমনি খামার মালিকদের জন্যও সাশ্রয়ী। এ প্রসঙ্গে ঘাস চাষিরা জানান, খৈল ভুষি কুড়ার দামের তুলনায় কাঁচা ঘাসের দাম খুব কম। এটি উৎপাদক এবং ক্রেতা উভয়ের জন্যই লাভজনক।
বেশ কয়েকজন খামারমালিক জানালেন, যেভাবে গোখাদ্য দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে তাতে করে কাচা ঘাস বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত না হলে গাভি পালন করাই কষ্ট হয়ে যেত।
চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দিন দিন গো খাদ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। খামারিদের চাহিদা মেটাতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ঘাস চাষও বেড়ে যাচ্ছে। বৃহত্তর পাবনা (পাবনা ও সিরাজগঞ্জ) জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে সরেজমিন খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে গ্রামে-গ্রামে ঘাস চাষির সংখ্যা আশাতীত হারে বাড়ছে। চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা সুইট, পরা, নেপিয়ার, জার্মানি, জাম্বু জাতের ঘাস চাষ করে থাকেন।
এসব ঘাসচাষি হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ পায়নি। তাদের প্রশিক্ষিত করা গেলে অল্প জমিতে আরও অধিক পরিমাণ ঘাস পাওয়া সম্ভব। সরকারের দায়িত্বশীল মহলগুলো এগিয়ে এলে আরও বেশি পরিমাণে কাঁচা ঘাস উৎপাদন সম্ভব।
ঘাস চাষে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা কত দুর্বল তা বোঝানোর জন্য পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার উদাহরণ দেওয়া যায়। এখানে উন্নতমানের গবাদিপশু প্রায় এক লাখ। আর সারাবছরে উপজেলায় প্রায় ২৫ হাজার মে.টন ঘাস উৎপাদিত হয়। অথচ এখানে সরকারিভাবে বছরে মাত্র ১১০-১২০ কেজি উন্নতমানের ঘাসের বীজ সরবরাহ করা হয়।
জেলার সফল খামারি আমিরুল ইসলাম ও সবুজ আহমেদ জানান, বিগত ৫-৬ বছরে যে হারে দানাদার গো-খাদ্যের দাম বেড়েছে তাতে গাভি পালন অলাভজনক হয়ে উঠছে। এ ক্ষেত্রে কাঁচা ঘাসই খামার টিকিয়ে রেখেছে।
পাবনা ডেইরি ফার্মাস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আব্দুল হামিদ জানান, বৃহত্তর পাবনা জেলায় প্রতিদিন প্রায় আড়াই লাখ লিটারের বেশি দুধ উৎপাদন হয়। দুগ্ধ উৎপাদনকারীরা পাবনার ভাঙ্গুড়া ক্রয় কেন্দ্র, সিরাজগঞ্জের লাহিড়ী মোহনপুর ও বাঘাবাড়ি মিল্কভিটায় প্রতিদিন প্রায় দেড় লাখ লিটার দুধ সরবরাহ করেন। এ অঞ্চলে প্রায় এক হাজার দুগ্ধ উৎপাদনকারী। সমিতির মাধ্যমে এ দুধ সরবরাহ হয়। সমিতিভুক্ত মোট সদস্যের সংখ্যা ৫০ হাজার।
তিনি জানান, কাচা ঘাষের চাষ বাড়ায় এত সংখ্যক খামারি টিকে আছেন। দানাদার খাদ্যের ওপর নির্ভরশীল হলে সব খামার বন্ধ হয়ে যেত।
পাবনা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা গৌরাংগ কুমার তালুকদার জানান, পাবনায় ঘাসের প্রাচুর্য রয়েছে। এখানে ঘাসের অভাব নেই। জেলায় প্রায় ৮ হাজার হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ঘাস চাষ করা হয়। তবে দানাদার খাদ্যের দাম কিছুটা বেশি। এজন্য তারা খামারিদের দানাদার খাদ্যে নিরুৎসাহিত করে গাভিকে কাচা ঘাস খাওয়াতে উৎসাহিত করেন। এতে দুধের উৎপাদন খরচ কমে যায়। এতে ক্ষুদ্র চাষি বা খামারিরা লাভবান হতে পারছেন।
এআইজে/এমআইএইচএস/জেআইএম