দেশজুড়ে

ঘাস চাষে কোটিপতি গফুর মিয়া

অন্যের জমিতে কামলা খেটে কোনো রকম সংসার চালাতেন গফুর মিয়া। একসময় একবেলা খাবার জুটলেও অন্য বেলা জুটতো না। এলাকায় ঘাস চাষে বদলে গেছে তার ভাগ্য। ঘাস চাষ করে তিনি এখন কোটিপতি। কৃষি উন্নয়নে উজ্জ্বল দৃষ্টান্তের জন্য ২০১৪ সালে পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার। গ্রামে এখন অনেক ঘাসচাষির প্রদর্শকও তিনি।

Advertisement

গাইবান্ধা জেলার পলাশবাড়ী উপজেলা শহর থেকে তিন কিলোমিটার পশ্চিমে সুলতানপুর বড়ইপাড়া গ্রাম। এ গ্রামে গফুর মিয়ার বাড়ি। গ্রামটিতে প্রবেশ করেই চোখে পড়ে সবুজের সমরোহ। মাঠের পর মাঠ ঘাসের ক্ষেত। কেউ ঘাস কাটছেন, কেউ আঁটি বেঁধে ভ্যানে করে বাজারে বিক্রির জন্য নিয়ে যাচ্ছেন।

২০০৩ সালে সাত হাজার টাকা ঋণ নিয়ে একটি ছোট গাভি কেনেন তিনি। পরদিনই উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ে গিয়ে সেখান থেকে নেপিয়ার জাতের ঘাসের চারা সংগ্রহ করেন। কাটিং পদ্ধতিতে প্রথমে নিজের ৫ শতক বসতভিটায় ঘাস লাগান। এক মাস পর পর তিন বছর পর্যন্ত ঘাস কাটা যায়।

এদিকে গাভিটি একটি বাছুর দেয়। প্রথমে নিজের গাভিকে ঘাস খাওয়ানো শুরু করেন তিনি। গাভির দুধ বাড়তে থাকে। একদিকে দুধ, অন্যদিকে ঘাস বিক্রির আয়। ব্যবসা বেশ লাভজনক হতে থাকে। ধীরে ধীরে ঘাস চাষের পরিমাণ বাড়তে থাকে তার।

Advertisement

বর্তমানে ২২ বিঘা জমিতে নেপিয়ার জাতের ঘাস রোপণ করেছেন তিনি। এর মধ্যে ১০ বিঘা নিজের, ১২ বিঘা বন্ধক নেওয়া। এক বিঘা জমিতে উৎপাদন খরচ পড়েছে ১২ হাজার টাকা। এক বিঘা জমি থেকে তিন বছর ঘাস পাওয়া যায়। তিন বছরে আয় হবে তিন লাখ টাকা। প্রতি মাসে খরচ বাদে ঘাস বিক্রি করে মাসিক আয় লাখ টাকার ওপরে।

তিনি জানান, আগে ছিল ১০ শতক বসতভিটা। এখন ঘাস ব্যবসার আয় দিয়ে ২০ শতক বসতভিটার মালিক তিনি। বাড়িতে এখন ১০৫ হাত দৈর্ঘ্যের আধা পাকা ঘর। এ ঘরের তিনটি কক্ষে গরুর খামার। বর্তমানে খামারে ফ্রিজিয়ান জাতের ১৫টি গাভি আছে। এছাড়া হাঁস-মুরগি, ছয়টি ছাগল, চারটি ভেড়া আছে।

গফুর মিয়া বলেন, আমি একসময় দিনমজুরের কাজ করতাম। প্রতিদিন কাজ পেতাম না। গ্রামে গ্রামে কাজ খুঁজেছি। কাজ করলে মজুরি পেতাম দৈনিক ১০০ টাকা। তা দিয়ে সাত সদস্যের সংসার চলত না। কিন্তু এখন আমি কোটিপতি।

তিনি বলেন, ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের কথা। একদিন আমার গ্রামের এক গৃহস্থের সঙ্গে পলাশবাড়ী উপজেলা শহরের একটি হোটেলে চা খেতে যাই। সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম, হোটেল মালিক দুলু ভাইয়ের গরুর খামারের দুধ দিয়ে হোটেল চলে। দুলু ভাই নেপিয়ার জাতের ঘাস চাষও করেন। ওই দিনই তার গরুর খামার ও ঘাসের জমি দেখতে যাই।

Advertisement

ওই দিন রাতে বাড়ি ফিরে ঘাস চাষের কথা ভাবতে থাকি। ঘাস চাষ করলে গরু খাবে, গরু খেলে দুধ বেশি হবে, দুধ বিক্রি করলে টাকা হবে। প্রতিজ্ঞা করি, দুলু ভাই পারলে আমি কেন পারবো না। আমিও মানুষ। আর অনুভব করি ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়ে কোটিপতি হওয়ার লোভ আমাকে দিনমজুর বানিয়েছে।

বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগি চাষের মাধ্যমে কৃষি উন্নয়নে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য ২০১৪ সালে আমি বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার পান তিনি। পুরস্কার হিসেবে একটি সনদ ও একটি রৌপ্যপদক দেওয়া হয়। তার এ সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে সুলতানপুর বড়ইপাড়া ও আশপাশ গ্রামের অর্ধশতাধিক কৃষক ঘাস চাষ করেন। তারাও স্বাবলম্বী হয়েছেন।

তাদের মধ্যে সুলতানপুর বড়ইপাড়া গ্রামের কৃষক মাসুদ মিয়া আমার সাফল্য দেখে তিন বছর ধরে এক বিঘা জমিতে ঘাস চাষ করছেন। প্রতি মাসে তার সাত হাজার টাকা আয় হচ্ছে। একই গ্রামের কৃষক সিরাজুল ইসলাম গত বছর দুই বিঘা জমিতে ঘাস চাষ করেন। নিজের গাভিকে খাওয়ানোর পরও তিনি প্রতি মাসে প্রায় ১৪ হাজার টাকার ঘাস বিক্রি করছেন।

ওই গ্রামের অন্য কৃষক আবদুর রশিদ আগে ভেবেছিলেন, আমি নাকি পাগলামি করছি। পরে আমার আয়ের কথা শুনে চার বছর আগে তিনি তিন বিঘা জমিতে ঘাস চাষ করেন। ঘাস বিক্রির আয় দিয়ে সংসারের দায়-দেনা মিটিয়ে এক বিঘা জমি বন্ধক নিয়েছেন তিনি।

পার্শ্ববর্তী কাশিয়াবাড়ী গ্রামের দেলোয়ার হোসেন আমার পরামর্শে দুই বিঘা জমিতে ঘাস চাষ করেন। নেপিয়ার জাতের ঘাস খাওয়ানোর কারণে তিনি দুই বছর ধরে তার গাভি থেকে বেশি দুধ পাচ্ছেন। পাশাপাশি তিনি ঘাস বিক্রি করেও টাকা আয় করছেন।

এমনকি জয়পুরহাট ও লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রামের অনেক কৃষক আমার সাফল্য দেখে গিয়ে তারাও ঘাস চাষ করছেন। এখনোও অনেকেই ঘাস চাষের পরামর্শের প্রতিদিন অনেকেই আসেন।

আনোয়ার হোসেন শামীম/এমআইএইচএস/জেআইএম