দেশে দুধের উৎপাদন দিন দিনই বাড়ছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে চাহিদা। এ কারণে আমদানিনির্ভরতাও কমছে না। তবে তরল দুধের তুলনায় দুগ্ধজাত খাদ্যপণ্যের প্রতি মানুষ বেশি আগ্রহী হয়ে উঠছে। দেশের মানুষ তরল দুধ পান করছে কম। আবার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও খাদ্য মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্নআয়ের অনেকে নিয়মিত দুধ কিনে পান করতে পারেন না। যদিও ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে দেশজ উৎপাদিত দুধের দৈনিক মাথাপিছু প্রাপ্যতা ২৩৬ গ্রামে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে সরকার। তবে সে লক্ষ্য এখনো অর্জিত হয়নি।
Advertisement
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মানদণ্ড অনুযায়ী, একজন মানুষের দৈনিক গড়ে ২৫০ মিলিলিটার দুধ পান করা উচিত। বাংলাদেশের সরকারি হিসাব বলছে, এখন দেশের মানুষ মাথাপিছু দৈনিক ২২২ মিলিলিটার দুধ পাচ্ছে। তবে হিসাব আর ব্যস্তবতা পুরোপুরিই ভিন্ন।
এ নিয়ে সম্প্রতি অনেকের সঙ্গেই কথা হয় জাগো নিউজের। যাদের অধিকাংশই বলতে পারেননি, শেষ কবে এক গ্লাস দুধ পান করেছিলেন। সরকারি দপ্তরের বাইরে পুষ্টিবিদ, অর্থনীতিবিদ ও ডেইরি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, এ দেশের মানুষ এখনো প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম দুধ পান করে। দুধের অপ্রাপ্যতা, আর্থসামাজিক নাজুক অবস্থা, দুধের চড়া দাম এবং নিয়মিত দুধ খাওয়ার অভ্যাস না থাকায় এ হার অনেক কম। তাই প্রয়োজনের তুলনায় দুধের প্রাপ্যতার ক্ষেত্রে সরকারি তথ্যের সঙ্গে মাঠ পর্যায়ের তথ্যের কোনো মিল দেখছেন না তারা।
শহরে বসবাসকারী একজন মানুষের দৈনিক দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য গ্রহণের হার ৩৮ দশমিক ৫ মিলিলিটার। যা গ্রামের মানুষের মধ্যে আরও কম, ৩২ দশমিক ১ মিলিলিটার। -বিবিএসের জরিপ
Advertisement
আসলে দেশের মানুষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ডের নিরিখে কতটুকু দুধ পাচ্ছে, সেই হিসাবে ফারাক আছে। এমনকি সরকারি একাধিক দপ্তরের দেওয়া তথ্যেও রয়েছে ভিন্নতা।
আরও পড়ুন
সংকটের মুখে সম্ভাবনার দুগ্ধশিল্প দুধ জ্বাল দেওয়ার ভুলে পুষ্টিগুণ নষ্ট হচ্ছে না তো? ভাবতে অবাক লাগে, শিশুদের দুধও ভেজাল হচ্ছেপ্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের (ডিএলএস) তথ্য বলছে, দেশে গত বছর দুধের উৎপাদন হয়েছে এক কোটি ৪০ লাখ টন। যেখানে মাথাপিছু দৈনিক গড়ে ২২২ মিলিলিটার দুধ পান করছে মানুষ। ডব্লিউএইচওর মানদণ্ড অনুযায়ী, মাথাপিছু দৈনিক ২৫০ মিলিলিটার দুধ পান করা হলে দেশে দুধের চাহিদা দাঁড়াবে এক কোটি ৫৮ লাখ টনে। সে হিসাবে দুধের বার্ষিক ঘাটতি মাত্র ১৮ লাখ টন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ ২০২২ সালে করা খানা আয়-ব্যয় জরিপে দেখা গেছে, শহরে বসবাসকারী একজন মানুষের দৈনিক দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য গ্রহণের হার ৩৮ দশমিক ৫ মিলিলিটার। যা গ্রামের মানুষের মধ্যে আরও কম, ৩২ দশমিক ১ মিলিলিটার। ডেইরি সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর মতে, বাংলাদেশে মাথাপিছু দৈনিক দুধ পানের পরিমাণ ৫০ মিলিলিটারের বেশি হবে না।
Advertisement
গত বছর দেশে তরল দুধের চাহিদা ছিল ১ কোটি ৫৬ লাখ ৭০ হাজার টন। চাহিদার মাত্র ৬৫ শতাংশ দেশীয়ভাবে উৎপাদনের মাধ্যমে পূরণ করা সম্ভব হয়েছে।-ড. মহি উদ্দিন
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) অ্যানিমেল নিউট্রিশন বিভাগের শিক্ষকদের জোট ইন্টিগ্রেটেড ডেইরি রিসার্চ নেটওয়ার্ক (আইডিআরএন)। এটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্প। এ জোট জার্মানিভিত্তিক আইএফসিএন-ডেইরি রিসার্চ নেটওয়ার্কের সঙ্গে কাজ করে। উভয় প্রতিষ্ঠানের কাজ দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের দাম, বৈশ্বিক বাজার, ভোক্তা, উৎপাদন নিয়ে গবেষণা করা।
অ্যানিমেল নিউট্রিশন বিভাগের চেয়ারম্যান ও আইডিআরএনের পরিচালক ড. মোহাম্মদ মহি উদ্দিন বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা গবেষণায় দেখেছি, দেশে মাথাপিছু দৈনিক দুধ পান ৫০ থেকে ৬০ মিলিলিটারের বেশি নয়।’
সম্প্রতি এক কর্মশলায় দেশে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদনের যে পরিসংখ্যান প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর দেখিয়েছে তা ‘অতিরঞ্জিত’ বলে দাবি করেছে আইডিআরএন। ‘ওয়ার্কশপ অন ডেইরি ইন্ডাস্ট্রি অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওই কর্মশালায় জানানো হয়, দেশে গত বছর (২০২৩ সালে) মোট দুধ উৎপাদন হয়েছে এক কোটি এক লাখ ৮২ হাজার টন। অথচ সেটিকে বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে।
ড. মহি উদ্দিনের ভাষ্য, গত বছর দেশে তরল দুধের চাহিদা ছিল ১ কোটি ৫৬ লাখ ৭০ হাজার টন। চাহিদার মাত্র ৬৫ শতাংশ দেশীয়ভাবে উৎপাদনের মাধ্যমে পূরণ করা সম্ভব হয়েছে। যদিও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত বছর প্রায় ৯৭ শতাংশ দুধের চাহিদা নিজেদের উৎপাদনের মাধ্যমে পূরণ হয়েছে। ফলে স্বয়ম্ভরতার তথ্য নিয়ে এখানেও রয়েছে বেশ গরমিল।
বর্তমানে দেশে যে পরিমাণ দুধের উৎপাদন, তার একটি বড় অংশ দুগ্ধজাত খাবার তৈরিতে ব্যবহার হচ্ছে। মহি উদ্দিন বলেন, ‘গত বছর চিজ, বাটার, দধিসহ অন্যান্য দুগ্ধজাত পণ্যের চাহিদার মাত্র ৫৬ শতাংশ দেশে উৎপাদিত দুধের মাধ্যমে পূরণ করা হয়েছে।’ তবে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বলছে, এক্ষেত্রে প্রায় ৮৩ শতাংশ চাহিদা দেশের দুধে পূরণ হয়েছে। তথ্যের ভিন্নতা পাওয়া যায় এখানেও।
দুগ্ধশিল্পে তথ্যের গড়মিল প্রসঙ্গে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (উৎপাদন) ড. এ. বি. এম. খালেদুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘দেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলা থেকে প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে এ পরিসংখ্যান তৈরি করা হয়। এতে সামান্যই তারতম্য হতে পারে। তবে মোটাদাগে সঠিক তথ্যই রয়েছে।’
দুধের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে উৎপাদন বাড়ানোর বিকল্প নেই। নিম্নমানের গুঁড়ো দুধ আমদানিতে শুল্ক-কর বাড়িয়ে আমদানিতে নিরুৎসাহিত করা দরকার। এছাড়া গো-খাদ্যের দাম কমাতে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।-বিডিএফএ সভাপতি
আইডিআরএন-এর তথ্য প্রসঙ্গে খালেদুজ্জামান বলেন, তথ্য বা পরিসংখ্যানে যদি পার্থক্য হয়, তা স্যাম্পলিং টেকনিক বা মেথলজি অব স্যাম্পলিংয়ের মতো বিভিন্ন কারণে হতে পারে।
আরও পড়ুন
কমছে দুধের দাম, পথে বসছেন খামারিরা গো-খাদ্যের চড়া দামের প্রভাব পড়ছে দুধ উৎপাদনেচাহিদার তুলনায় প্রাপ্যতা নিয়ে ফারাক থাকলেও সব উৎসই বলছে, দেশে মাথাপিছু দৈনিক দুধ পানের পরিমাণ বাড়াতে উৎপাদন বাড়াতে হবে। এর জন্য খামারিদের উন্নয়ন দরকার। পাশাপাশি উৎপাদিত দুধের টেকসই বিপণন চেইন তৈরি ও দুধ আমদানি নিরুৎসাহিত বা সীমিত করা দরকার। একই সঙ্গে গো-খাদ্য সহজলভ্য করতে হবে। খামার থেকে ভোক্তা পর্যায়ে যেতে বিশাল মধ্যস্বত্বভোগীদের তৎপরতা রয়েছে, এটি সবার আগে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। সর্বোপরি খামারিদের উৎপাদিত দুধের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) সভাপতি মোহাম্মদ ইমরান হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘দুধের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে উৎপাদন বাড়ানোর বিকল্প নেই। নিম্নমানের গুঁড়ো দুধ আমদানিতে শুল্ক-কর বাড়িয়ে আমদানিতে নিরুৎসাহিত করা দরকার। এছাড়া গো-খাদ্যের দাম কমাতে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।’
বাংলাদেশে দুধের মাথাপিছু দৈনিক প্রাপ্যতা যেমন কম, তেমনই উৎপাদনও কম। মাথাপিছু দুধ পানের হার কম হওয়ার নেপথ্যে দুগ্ধখাত সংশ্লিষ্টরা দুধের কম উৎপাদনকে কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করছেন।
আইডিআরএন ও আইএফসিএন-ডেইরি রিসার্চ নেটওয়ার্কের তথ্যানুসারে, বৈশ্বিকভাবে খামারপ্রতি দুধের উৎপাদন সাত টন। বাংলাদেশে এ হার দুই টন। সে হিসাবে বাংলাদেশে খামারি পর্যায়ে ৭১ শতাংশ ঘাটতি রয়েছে। অন্যদিকে, দেশে গাভিপ্রতি বার্ষিক দুধ উৎপাদন হয় ১ দশমিক ১ টন। আর বিশ্বে এ উৎপাদন দ্বিগুণ। বিশ্বে মাথাপিছু দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের বার্ষিক ব্যবহার ১১৬ কেজি ৫০০ গ্রাম। সেখানে বাংলাদেশে এ হার মাত্র ৪৯ কেজি।
এনএইচ/এমকেআর/এমএমএআর/এএসএম