ডা. মো. নাজমুল হক
Advertisement
‘বৈশ্বিক পুষ্টিতে দুধ অপরিহার্য’ প্রতিপাদ্য নিয়ে আজ ১ জুন, ২০২৪ বিশ্বব্যাপী উদযাপিত হচ্ছে ‘বিশ্ব দুগ্ধ দিবস-২০২৪’। এরই ধারাবাহিকতায় ‘প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পে’র সহযোগিতায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উদ্যোগে দেশের ৬১টি জেলায় একযোগে ‘বিশ্ব দুগ্ধ দিবস-২০২৪’ উদযাপিত হচ্ছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘খাদ্য শুধু চাল, আটা নয়। মাছ মাংস, ডিম, দুধ, তরিতরকারিও আছে। কঠোর পরিশ্রম করে উৎপাদন বাড়াতে হবে।’ এই দুধের উৎপাদন বৃদ্ধি, দুধ বিক্রি করে খামারিদের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি, দুধের ভ্যালু চেইন সৃষ্টি, দুধ প্রক্রিয়াজাতকরণে নানান দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন নিয়ে কাজ করছে প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প।
আমরা জানি যে, দুধ একটি স্বর্গীয় আদর্শ খাদ্য। মায়ের পেটের সন্তানের জন্য প্রথম যে খাদ্য মহান আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি করেন, তা হলো এই দুধ। দুধে রয়েছে প্রায় সব ধরনের ভিটামিন ও মিনারেল, যা শরীরের ইমিউনিটি ইম্প্রুভ করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। দুধের রাসায়নিক উপাদানও বেশ চমকপ্রদ। এতে রয়েছে প্রায় ৮৭.৮ শতাংশ পানি, যা শরীরের ডিহাইড্রেশন প্রতিরোধ করে এবং শরীরকে সতেজ রাখে।
Advertisement
প্রতি ১০০ গ্রাম গরুর দুধে ল্যাকটোজ (শর্করা) রয়েছে ৪.৮ গ্রাম, যা শিশুর ব্রেইন ডেভেলপমেন্ট করে ও স্মৃতিশক্তি বাড়ায়। এছাড়া প্রোটিন রয়েছে ৩.২ গ্রাম। দুধের ৮০ শতাংশ প্রোটিনই ক্যাজিন প্রোটিন, যা দাঁতের এনামেলের ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের ক্ষয়রোধ করে এবং দাঁত মজবুত করে। দুধে ০.১ শতাংশ পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড রয়েছে, যা কোলেস্টেরলকে নিয়ন্ত্রণে রেখে হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। দুধে অন্য মিনারেলের পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম রয়েছে, যা ১০০ গ্রাম গরুর দুধে প্রায় ১২০ মিলিগ্রাম। এসব মিনারেল শরীরের হাড় গঠন ও বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে এবং দেহের বিভিন্ন জয়েন্টের ক্ষয়রোধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। দুধে রয়েছে প্রচুর এনার্জি (১০০ গ্রাম গরুর দুধে প্রায় ৬৬ কিলো ক্যালরি), যা রক্ত সঞ্চালন বাড়িয়ে শরীরের ক্লান্তি দ্রুত দূর করে এবং শরীর, মন ও মস্তিষ্ক চাঙ্গা করে। এসব নানাবিধ উপকারের জন্য দুধকে বলা হয় একটি কমপ্লিট সুপার ফুড।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সূত্র অনুযায়ী, দেশে গরু রয়েছে প্রায় ২ কোটি ৪৯ লাখ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সারাদেশে প্রায় ১৫৮ লাখ মেট্রিক টন দুধের চাহিদার বিপরীতে প্রায় ১৪১ লাখ মেট্রিক টন দুধ উৎপাদিত হয়েছে। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কিছুটা কম থাকলেও গত ১০ বছরে দুধের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ২৩১ শতাংশ। এতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অবদান অপরিসীম। এই অধিদপ্তরের আওতায় ‘প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প’ দুধের প্রকৃত ভ্যালু চেইন সৃষ্টির লক্ষ্যে সারাদেশে নির্মাণ করতে যাচ্ছে ২০টি ডেইরি হাব, আর প্রত্যেকটি ডেইরি হাবের অধীনে থাকবে প্রায় ২০ টি করে ভিলেজ মিল্ক কালেকশন সেন্টার (ভিএমসিসি), যেখানে দুগ্ধ উৎপাদনকারী খামারিরা সহজে ন্যায্য মূল্যে দুধ বিক্রি করতে পারবে। এছাড়া উদ্যোক্তাদের ম্যাচিং গ্রান্টের আওতায় আনা হচ্ছে এই প্রকল্পের মাধ্যমে। প্রশিক্ষণ প্রদান ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের (মিল্কিং মেশিন, মিল্ক ক্রিম সেপারেটর মেশিন ইত্যাদি) মাধ্যমে দুগ্ধ খামারিদের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর।
দুধ উৎপাদনে সমৃদ্ধ নওগাঁ জেলা। এ জেলাতে প্রায় ২৫ হাজার গাভির খামার রয়েছে এবং ৫৫ টি হাটে এসব গাভির দুধ বিক্রি করা হয়। এখানে দধি-মিষ্টির কারখানা রয়েছে ৪৪ টি এবং মাঠা কারখানা রয়েছে ৮ টি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নওগাঁ জেলায় ইতোমধ্যে দুধ উদ্বৃত্ত রয়েছে প্রায় ১০ হাজার মেট্রিক টন। দুধ প্রক্রিয়াকরণ করে বিভিন্ন পণ্য যেমন: দধি, মিষ্টি, সন্দেশ, মাঠা, পনির, ঘি, লাবান, গুঁড়ো দুধ ইত্যাদি তৈরি করা হয়।
নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে সহযোগিতা করছে জেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর, নওগাঁ। যেমন : নওগাঁ সদরের একজন নারী উদ্যোক্তা আম্বিয়া আক্তার। তিনি ‘মিল্ক পার্লার’ নামে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে প্রতিদিন প্রায় ১০০ লিটার দুধ প্রক্রিয়াকরণ করে ১৮ রকমের দুগ্ধজাত বিভিন্ন পণ্য তৈরি করে থাকেন। তিনিই প্রথম নওগাঁ জেলায় দুধ জ্বাল দিয়ে ফেরি করে গরম দুধ বিক্রির উদ্যোগ নেন। তার পরিশ্রমের স্বীকৃতিতে প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্যোগে তাকে ‘ডেইরি আইকন’ পুরস্কার দেওয়া হয়। আরেকজন উদ্যোক্তা আব্দুল মান্নান। তিনি নওগাঁর রাণীনগর উপজেলায় প্রায় ৫০ বিঘা জমিতে গড়ে তুলেছেন ডেইরি খামার, গাড়ল খামার, ছাগলের খামার, দেশি মুরগির খামার ও মিল্ক পার্ক। তিনি মাঠা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছেন। কাজের স্বীকৃতিতে তিনিও পেয়েছেন ‘ডেইরি আইকন’ পুরস্কার।
Advertisement
নওগাঁ জেলা দুধ উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ ও বাজারজাতকরণে সমৃদ্ধ। এ জেলার বদলগাছী উপজেলার বালুভরা ইউনিয়নের দই প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী, যা স্বাদে ও গুণে অনন্য। এখানে বেশ কয়েকজন নবীন উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছেন, যারা মাঠা উৎপাদন করে সারাদেশে বিক্রি করেন।
এছাড়া দুধের রাজ্য বলা হয় মান্দা উপজেলাকে। এখানে গড়ে উঠেছে দুধের বিশাল হাট। প্রতিদিন প্রায় ১৫ হাজার লিটার দুধ তিনটি হাটে লেনদেন হয়। মান্দায় রয়েছে ছোট বড় প্রায় দুই হাজার দুধের খামারি। প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের সহযোগিতায় নওগাঁ জেলা সদরে নির্মিত হচ্ছে ডেইরি হাব। যার অধীনে নির্মিত হবে ২০ টি ভিএমসিসি। এভাবে নওগাঁ জেলা একটি দুধের শিল্পোনগরী হিসেবে অচিরেই গড়ে উঠবে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর শিশুদের মানসিক বিকাশ ও পুষ্টি নিশ্চিতকরণে প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের সহযোগিতায় দেশে বিভিন্ন স্কুলে পর্যায়ক্রমে বিনামূল্যে ‘স্কুল মিল্ক ফিডিং প্রোগ্রাম’ চালু করেছে। এ ধরনের নানান মহতী উদ্যোগ নিয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কাজ করে চলেছে। সেই দিন বেশি দূরে নয়, যেদিন আমরা আবার বলতে পারবো ‘দুধে ভাতে বাঙালি’ ইনশাআল্লাহ। বিশ্ব দুগ্ধ দিবস-২০২৪ সফল হোক, এই প্রত্যাশা করি।
লেখক : ডা. মোঃ নাজমুল হক, বিপিএএ, উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার, বদলগাছী, নওগাঁ। জাতীয় বঙ্গবন্ধু জনপ্রশাসন পদক ২০২৩ (স্বর্ণপদক) প্রাপ্ত ‘মডেল লাইভস্টক সার্ভিস’ উদ্যোক্তা।
আরও খবর
বিশ্ব দুগ্ধ দিবস আজ সংকটের মুখে সম্ভাবনায় দুগ্ধশিল্প দৈনিক কতটুকু দুধ পান করা উচিত দুগ্ধ খামারিদের লাভের গুড় যাচ্ছে পশুখাদ্যের দামে বদলগাছীতে প্রথম সার্বক্ষণিক ভেটেরেনারি জরুরিসেবা চালু শ্রেষ্ঠ শুদ্ধাচার পুরস্কার পেলেন বদলগাছী প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাএমএমএআর/এএসএম