শ্রী গোবিন্দ চন্দ্র সরকার (৪৭)। বাড়ি গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার দামোদপুর ইউনিয়নের জামোডাঙ্গা গ্রামে। অভাবী বাবার সংসারে জন্ম তার। বেঁচে থাকার তাগিদে ১৫ বছর বয়সে চলে আসেন জেলা শহরে। এখানে এসে রমেষ ঘোষের মিষ্টান্নর দোকানে কাজ শুরু করেন মেচিয়ারি হিসেবে।
Advertisement
শুরু থেকে রমেশ ঘোষের দোকানের রসগোল্লা খুবই জনপ্রিয়। মিষ্টির দোকানের সঙ্গেই ছিল রসগোল্লা তৈরির কারখানা। দোকানে কাস্টমারের চাপ কম থাকলেই গোবিন্দ চলে যেতেন রসগোল্লা তৈরি দেখতে। এক পর্যয়ে রসগোল্লা তৈরির জন্য তার মনে প্রবল আগ্রহ জন্মে। তিনি কাজের ফাঁকে রসগোল্লা বানানো শুরু করেন। এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে তিনি রসগোল্লা বানানো শিখে যান। এরপর মালিক তাকে কারখানায় রসগোল্লা তৈরির কাজ দেন। রমেশ ঘোষের দোকানে প্রায় ৩২ বছর থেকে আজ পর্যন্ত তিনি রসগোল্লা তৈরির কারিগর হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। এখানকারই বিখ্যাত একটি মিষ্টি রসমঞ্জুরী। বর্তমানে গোবিন্দর হাতের স্পর্শ ছাড়া যেন রসমঞ্জুরীর স্বাদ বসে না। শ্রী গোবিন্দ চন্দ্র সরকার বলেন, দীর্ঘ ৩২ বছর থেকে রসমঞ্জুরী তৈরি করে আসছি। অনেকেই এসেছেন আবার চলেও গেছেন। আমি এখানেই আছি। বর্তমানে রসমঞ্জুরীর গুটির কাজ মেশিনেই হয়। ফলে আগের মতো আর লোক লাগে না। এক সময় ৬০-৭০ জন কর্মচারী লাগতো গুটি বানাতে এখন আর লাগে না। তবে রসমঞ্জুরী তৈরির বাকি কাজে খুব কম সংখ্যক কর্মীর দরকার হয়।
এই রসমঞ্জুরী তৈরির প্রধান উপাদান দুধ। গোয়ালরা প্রতিদিন সকালে প্রত্যন্ত গ্রামের বিভিন্ন কৃষক ও খামারিদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করেন। বিকেল নাগাদ এগুলো রসমঞ্জুরী তৈরির কারখানায় পৌঁছে দেন।
কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক কেজি রসমঞ্জুরী তৈরি করতে আড়াই কেজি দুধ, ১০০ গ্রাম চিনি, ২৫ গ্রাম ময়দা, ২০০ গ্রাম দুধের ছানা ও এলাচি লাগে। প্রথমে ছানার সঙ্গে ময়দা মিশিয়ে গুটি গুটি রসগোল্লা তৈরি করতে হয়। ছোট ছোট মার্বেল আকৃতির এই মিষ্টি দুধ জ্বাল দিয়ে ক্ষীরের মতো ঘন করে তাতে মেশাতে হয়। এভাবে তৈরি হয় সুস্বাদু রসমঞ্জুরী।
Advertisement
১৯৪৮ সালে শহরের সার্কুলার রোডের রমেশ সুইটসের কর্ণধার রমেশ চন্দ্র ঘোষ জেলায় সর্বপ্রথম রসমঞ্জুরী তৈরি করেন। সেসময় ভারতের উড়িষ্যা থেকে কারিগর এনে তিনি এই মিষ্টি তৈরি করতেন। পরবর্তীতে এক দশকের মধ্যেই রসমঞ্জুরীর স্বাদ জেলার গণ্ডি পেরিয়ে দেশব্যাপী মানুষকে আকৃষ্ট করে। ভোজনরসিক কেউ গাইবান্ধায় এলে রসমঞ্জুরীর স্বাদ পেতে চান। যাওয়ার সময় সঙ্গে করে নিয়েও যান।
রমেশ ঘোষ মিষ্টান্ন ভান্ডারের ব্যবস্থাপক শ্রী বাদল ঘোষ জাগো নিউজকে বলেন, রসমঞ্জুরীর চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে তাদের দোকানের বিক্রয়কেন্দ্র বাড়ানো হয়েছে। তবে দুধ ও চিনির দাম বাড়ার কারণে উৎপাদন খরচ বেড়েছে।
বিভিন্ন দোকানের মালিকরা বলেন, প্রতি কেজি রসমঞ্জুরী বানাতে সব মিলিয়ে ৩৫০ টাকার মতো খরচ হয়। বর্তমানে বাজারে প্রতি কেজি রসমঞ্জুরি ৩৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
এ বিষয়ে গাইবান্ধা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি মকছুদার রহমান জাগো নিউজকে বলেন, একসময় রসমঞ্জুরীর স্বাদ শুধু এই জেলার মানুষই পেতেন। এরপর সেই স্বাদ ছড়িয়ে পড়ে দেশের অন্য জেলাগুলোতেও। এখনতো দেশের বাইরেও যাচ্ছে রসমঞ্জুরী।
Advertisement
এছাড়া গাইবান্ধা জেলাকে পরিচিত করতে তিনটি পণ্যকে দিয়ে ব্র্যান্ডিং করছে জেলা প্রশাসন। পণ্য তিনটি হলো রসমঞ্জুরী, মরিচ ও ভুট্টা। তিনটি পণ্য নিয়ে স্লোগানও তৈরি করা হয়েছে ‘স্বাদে ভরা রসমঞ্জুরীর ঘ্রাণ, চরাঞ্চলের ভুট্টা-মরিচ গাইবান্ধার প্রাণ’।
এফএ/এএসএম