খেলাধুলা

‘ব্যাটিংয়ে একটু ডিসিপ্লিন্ড হলে গ্রুপ পর্বে ভালো করা সম্ভব’

বিশ্বকাপের আগে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ। বিশ্বকাপের জন্য বাংলাদেশের প্রস্তুতি কোন পর্যায়ে তা পরখ করে দেখার দারুণ এক সুযোগ। কিন্তু প্রথমবারের মত এই দলটির মুখোমুখি হয়েই সিরিজ হারতে হলো নাজমুল হোসেন শান্তর দলকে। প্রথম দুই ম্যাচ হারের পর শেষ ম্যাচে জেগেছিলো হোয়াইটওয়াশের শঙ্কা। তবে, ওই ম্যাচে বেশ দাপট দেখিয়ে, নিজেদের আসল রূপ প্রদর্শণ করে ১০ উইকেটের জয় তুলে নেয় টাইগাররা।

Advertisement

বিশ্বকাপের আগে আনকোরা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এই ভরাডুবির কারণে কতটা ব্যাকফুটে থাকবে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল? এই সিরিজ হারে বাংলাদেশ কী পারবে ভুল শুধরে বিশ্বকাপের মঞ্চে ভালো করতে? কোথায় কোথায় ঘাটতি ছিলো? কোথায় উন্নতি করতে হবে? কোন বিষয়টাতে বেশি ফোকাস করলে বিশ্বকাপে সাফল্য পাবে বাংলাদেশ দল?

এমন নানা বিষয়ে নিয়ে জাগোনিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশের প্রথিতযশা ক্রিকেট কোচ, সাকিব-তামিম-মুশফিকদের গুরু হিসেবে পরিচিত, ক্রিকেট বিশ্লেষক নাজমুল আবেদিন ফাহিম। তিনি দেখিয়ে দিয়েছে, কোন কোন জয়গায় উন্নতি করলে বাংলাদেশ বিশ্বকাপে সফল হতে পারবে?

জাগো নিউজর পাঠকদের জন্য নাজমুল আবেদিন ফাহিমের একান্ত সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো-

Advertisement

জাগো নিউজ: যুক্তরাষ্ট্রর সাথে সিরিজ কেমন দেখলেন ?

নাজমুল আবেদিন ফাহিম: আরও খারাপ হতে পারতো। হয়নি। ভাগ্য ভাল।

জাগো নিউজ: যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সিরিজ নিয়ে আপনার ধারনা কী ছিল? কতটা আশাবাদী ছিলেন? নাকি খুব ভাল হবে না- এমন চিন্তাও ছিল ভেতরে।

ফাহিম: খুব ভাল নাও হতে পারে, আমার কিছুটা তেমন ধারনাই ছিল। কারণ, আমোরিকা একদম হেলা-ফেলা করার মত দল নয়। তাদের ক্রিকেটীয় ব্যাপারটা ওই লেভেলের না। তবে ক্রিকেটারদের ব্যাকগ্রাউন্ড, বেড়ে ওঠা একদম হেলা ফেলার নয়। তারা সবাই ক্যারিয়ার গড়তেই আসলে যার যার দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্র গেছে।

Advertisement

তারা নিজ দেশে থাকলে কিছু করতে পারতো না, জেনে-বুঝেই যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী হয়েছে। ন্যাশনাল টিমে এক্সপেরিয়েন্স আছে। সবাই ক্রিকেট খেলা হয়, এমন দেশ থেকেই এসেছে। খেলাটা বোঝে। কাজেই যুক্তরাষ্ট্র দলকে আমি একদম হালকা বা ছোট করে দেখিনি। তাদের ক্রিকেটীয় ব্যাপারটা ওই লেভেলের না।

সমস্যা আমাদের নিজেদেরই। গত বেশ কিছুদিন থেকেই আমাদের প্রতিপক্ষ আসলে আমরা নিজেরাই।

জাগো নিউজ: সেটা কিভাবে?

ফাহিম: জিম্বাবুয়ের সাথে হোম সিরিজটাকে আমরা মোটেই কাজে লাগাতে পারিনি। ওই সিরিজটা কাজে লাগানোর অনেক সুযোগ ছিল আমাদের। জিম্বাবুয়ের সাথে সিরিজটা একেবারেই ব্যবহার করতে পারলাম না। নিজেরা উপকৃত ও লাভবান হওয়ার চেষ্টা না করে উল্টো নিজেদের জন্য গর্ত খুড়লাম।

জাগো নিউজ: একটু ভেঙে, বিস্তারিত বলবেন কি?

ফাহিম: আসল কথা হলো একটা সিরিজে শুধু জয় পরাজয়ই শেষ কথা নয়। জিম্বাবুয়ে সিরিজটা হতে পারতো আমাদের দলের সাহস বাড়ানোর এক অনুপম ক্ষেত্র। ওই সিরিজটা আমাদের ক্রিকেটারদের সাহস বাড়াতে পারতাম; কিন্তু আমরা তা করিনি।

চট্টগ্রামের মত ব্যাটিং উইকেটেও আমরা জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টস জিতে প্রথম ২ ম্যাচে ব্যাটিং করলাম না। যে দলটা উগান্ডার মত আনকোরা নবীন দলের কাছে হারলো, হেরে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলতে পারছে না, তলানিতে পড়ে থাকলো। সব মিলিয়ে খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, এমন এক দল যারা ক্রমশ নিচের দিকে যাচ্ছে, মানসিকভাবে ভাঙ্গাচোরা, তাদের বিপক্ষেও আমরা আগে ব্যাটিং করলাম না। আমরা টস জিতে ব্যাটিং করার সাহস দেখালাম না।

আগে ব্যাটিং করলে কী হতো? তখন আমরা জানতাম, বুঝতাম এবং আমাদের সামনে একটা লক্ষ্য থাকতো, অন্তত ১৭০-১৮০ রান করতে হবে। ব্যাটাররা একটা টার্গেট সেট করে খেলতে পারতো। তারা রান করার চাপে ভুগতো। একটা টার্গেট সেট করে ব্যাট করার চাপটা থাকতো। ১৮০ রান করতে হলে কেমন ব্যাটিং প্রয়োজন এবং করনীয় কাজ কী কী? তা জানা হতো। সেভাবে খেলতেও হতো।

সব মিলিয়ে ভাল বা বড় রান করার চাপটা ভেতরে কাজ করতো। একটা ড্রেস রিহার্সেল হতো; কিন্তু আমরা সে পথে হাঁটলামই না। টস জিতেও সে চাপটা নিলাম না। সযত্নে তা এভয়েড করে উল্টো জিম্বাবুয়েকে আগে ব্যাটিংয়ের আমন্ত্রণ জানালাম। ধরেই নিলাম, জিম্বাবুইয়ানরা বেশি রান করতে পারবে না। আমরা তাদের কম রানে বেঁধে ফেলে সহজেই জয় তুলে নেব।

আমরা ভাবলাম না, এতে আমাদের অর্জনটা কী হবে? আমি ভাবলাম জিতবো এবং জিতলেই কিছু একটা হয়ে যাবে। জেতা মানেই সব না, তা বুঝলাম না। জিতলেও ভাল করার এবং সামনে আগানোর সত্যিকার প্রস্তুতি নিলাম না। তাই আমার মনে হয়, সামগ্রিকভাবে জিম্বাবুয়ে সিরিজে আমরা লাভবানের পরিবর্তে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।

জাগো নিউজ: এই দলের কাছে এখন আপনার প্রত্যাশা কী? আপনার কী মনে হয়, এই দল কতদূর যেতে পারে?

ফাহিম: এখন ওই হিসেবে বলা খুব মুশকিল। একটা প্যাটার্ন যদি দেখি, এভাবে খেলে এবং যেভাবে খেলে সেটা বার বার করে দেখাতে পেরেছে , প্যাটার্নটা বজায় বা বহাল থাকলে বলা যায় কি করতে পারবে? ভাল করতেই পারি। আর যদি ওই প্যাটার্ন অনুযায়ী খেলতে না পারি তাহলে ভাল হবে না। ব্যাটিংয়ে একটা বড় সমস্যা হলো টপ অর্ডারের পারফরমেন্স। টপ অর্ডার যদি ক্লিক না করে তাহলে আমাদের জন্য খুব কঠিন হয়ে যাবে।

বোলিংটা মোটামুটি ঠিক আছে। তারপরও শুধু বোলিংয়ের ওপর আশা করে জেতাটা খুব কঠিন হবে। এটা আশা করাও কঠিন যে আমরা ১৫০- ১৫৫ রান করে জিতে যাব।

জাগো নিউজ: যুক্তরাষ্ট্রর সাথে সিরিজ হারার পর তৃতীয় ম্যাচ দেখে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

ফাহিম: লাস্ট ম্যাচ দেখে অনেকে বলছেন, ভাবছেন যুক্তরাষ্ট্রর সেরা দল ছিল না। প্রতিষ্ঠিত ৩-৪ জন খেলেননি। অনেক দূর্বল দল, এটা এমন কিছু না। আমার কাছে মোটেই তা মনে হয় না। আমি ওই জয়টাকে মোটেই খাট করে দেখতে চাই না। বরং গুরুত্ব দিতে চাই। আমি আবারও বলবো, সেই জিম্বাবুয়ের মতো প্রতিপক্ষের বিপক্ষে আমরা যতটা খেলেছি, তার চেয়ে বেশি নিজেরা নিজেদের সাথে খেলেছি।

জাগো নিউজ: সেটা কেমন?

ফাহিম: আমার মনে হয়, শেষ ম্যাচে টিম বাংলাদেশ মাঠে নেমেছিল সর্বোচ্চ ও সর্বাধিক মানসিক চাপ নিয়ে।

জাগো নিউজ: কী সেই চাপ? ভেঙ্গে বলবেন একটু?

ফাহিম: যুক্তরাষ্ট্রের মত আইসিসি সহযোগী দেশের কাছে সিরিজ হারের পরপরই পুরো দল চুপসে গিয়েছিল। তাদের সামনে জেগেছিল হোয়াইটওয়াশের শঙ্কা। যুক্তরাষ্ট্রর সাথে টানা তিনটা ম্যাচ হারলে আর মুখ দেখানোর কিছু থাকবে না- এমন চিন্তা, টেনসন এসে ভর করেছিল ক্রিকেটারদের মধ্যে। তাই বলছি বাংলাদেশ দল এত চাপ নিয়ে শেষ কবে খেলেছে? আমি অন্তত মনে করতে পারছি না। আমার মনে হয় না, আগে কখনো কোন ম্যাচে এতটা চাপ নিয়ে খেলেছে।

সেই বিশাল চাপ নিয়েই গত ২৫ মে মাঠে নেমেছিল শান্তর দল এবং আমার মনে হয় বেশ ভালভাবেই সে চাপ সামলে জয় তুলে নিয়েছে ছেলেরা।

জাগো নিউজ: যুক্তরাষ্ট্রর মত আইসিসির সহযোগী সদস্যর কাছে সিরিজ হারার পর শেষ ম্যাচের ওই সান্ত্বনাসূচক জয়ে কী লাভ হবে? বিশ্বকাপে কি কোন ইতিবাচক প্রভাব পড়বে?

ফাহিম: আমার মনে হয় ওই জয়ের পজিটিভ ইমপ্যাক্ট আছে। এই বিশাল চাপ অতিক্রমের একটা মূল্য আছে। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার অবশ্যই একটা ইতবাচক দিক আছে। এখান থেকে ঘুরে দাঁড়াবার সুযোগ তৈরী হবে। ঘুরে দাঁড়ানোর কথা ভেবেই একটু ভরসার জায়গা তৈরি হয়েছে অমার। সেই আলোকে বলছি বোলিংয়ের যে অবস্থা, যদি ব্যাটিংয়ে আমরা ডিসিপ্লিন্ড হতে পারি, তাহলে খুব ভাল চান্স যে আমরা গ্রুপ পর্বেও ভাল করতে পারবো।

আইএইচএস/