জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে নারীদের নামাজ পড়ার স্থানে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন এক ছাত্রী। এ ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ এনে মসজিদের ইমাম মো. ছালাহ উদ্দিনকে অব্যাহতি দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ঘটনা তদন্তে গঠিত হয়েছে পাঁচ সদস্যের কমিটি।
Advertisement
জবি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন শফিকুল ইসলাম ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গত ১৮ মে মসজিদে নারীদের নামাজ পড়ার স্থানে এশার নামাজ পড়তে যান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের এক ছাত্রী। অসুস্থবোধ করায় সেখানেই ঘুমিয়ে পড়েন তিনি। রাত ১০টার একটু পরে মুয়াজ্জিন লক্ষ্য করেন নারীদের নামাজ পড়ার স্থানে কেউ একজন আছেন। তখন বিষয়টি তিনি ইমামকে জানান।
এরপর দুজন সিকিউরিটি গার্ডের মাধ্যমে ছাত্রীকে ডেকে তোলা হয়। ততক্ষণে ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছান ইমাম। তিনি প্রক্টরকে ফোন করে বিষয়টি জানান। ওই ছাত্রী ইমামকে জানান, তিনি জবির বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছাত্রী হলের আবাসিক ছাত্রী। ইমাম হলের হাউজ টিউটর সাজিয়া আফরিনের সঙ্গে ওই ছাত্রীকে কথা বলিয়ে দেন এবং তাকে হলে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
ইমামকে অব্যাহতি, তদন্ত কমিটিএ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মসজিদে দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগ এনে ইমামকে মৌখিকভাবে অব্যাহতি দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এ বিষয়ে গত ২৭ মে এক অফিস আদেশে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। অফিস আদেশে ‘রাত ১১টা ২০ মিনিট’ পর্যন্ত মসজিদে ছাত্রীর অবস্থানে ইমামের দায়িত্বে অবহেলার বিষয়ে কমিটির কাছে তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন চাওয়া হয়।
Advertisement
তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ড. একেএম লুৎফর রহমান বলেন, ‘সোমবার জানতে পারি, আমাকে কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে। এর আগে এ ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলবো। তদন্ত শেষ না হলে বিষয়টি নিয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না।’
ইমাম যা বললেনইমামের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাওয়া মো. ছালাহ উদ্দিন বলেন, ‘আমি ওই ছাত্রীকে চিনি না। মসজিদের ভেতরে নারীদের নামাজের জায়গায় একজন মেয়ে শিক্ষার্থী অবস্থান করছেন জেনেই আমি প্রক্টরকে জানিয়েছিলাম। কোনো অসৎ উদ্দেশ্য থাকলে প্রক্টরকে বিষয়টি অবগত করতাম না। কিন্তু আমার বিরুদ্ধে ওই ছাত্রীর কোনো লিখিত অভিযোগ ছাড়াই আমাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়েছে প্রশাসন। ওই মেয়ে আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ দিয়েছে কি না বা কী অভিযোগ দিয়েছে সেটাও জানি না।’
ছাত্রীর বক্তব্যসেই রাতের বিষয়ে ওই ছাত্রী বলেন, “ঘটনাটি ছিল ১৮ মে রাতে, প্রায় ১০টা ৩০ এর দিকে। আমি কয়েকদিন থেকে অসুস্থ ছিলাম। নামাজ পড়তে গিয়ে ওই দিন মসজিদে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। পরে মসজিদের দায়িত্বে থাকা একজন আমাকে দেখতে পেলে তিনি তার সঙ্গে একজন নারী (হয়তো ওনার স্ত্রী হবেন) এনে আমাকে ওই রুম (নারীদের নামাজ পড়ার স্থান) থেকে বের করে আনেন। এরপর ইমাম সাহেব প্রক্টর স্যারকে কল দেন। সেখানে প্রক্টর স্যারের সঙ্গে মোবাইলে আমার কথা হয়। প্রক্টর স্যার আমাকে বলেন, ‘তুমি তোমার হলের হাউজ টিউটরকে কল দাও।’ পরে হাউজ টিউটরকে কল দিলে উনি হলে চলে আসতে বলেন। ইমাম সাহেবকে কেন অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, আমি জানি না। ওইখানে তেমন কিছুই ঘটেনি। ইমাম সাহেবের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ মিথ্যা।”
আরও পড়ুন
Advertisement
ছাত্রী হলের হাউজ টিউটর ও দর্শন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাজিয়া আফরিন সেই রাতের ঘটনা সম্পর্কে বলেন, ‘হ্যাঁ, মেয়েটি আমাকে ফোন দিয়েছিল। আমাকে মসজিদে ঘুমিয়ে পড়ার বিষয়টি বলেছিল। তার সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারি, সে হলে নতুন হওয়ায় ভয় পাচ্ছিল। পরে আমি তাকে হলে ফেরার ব্যবস্থা করি। নিরাপত্তাকর্মীরা তাকে হলে দিয়ে আসে।’
ছাত্রী কোনো অভিযোগ করেছিলেন কি না এমন প্রশ্নে হাউজ টিউটর বলেন, ‘না, সে কোনো অভিযোগ দেয়নি।’
ইমামকে কেন অব্যাহতিএ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর জাহাঙ্গীর হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘রাতের বেলা একটা মেয়ে মসজিদে কেন শুয়ে থাকবে? এটা তো ওই ইমামের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এখানে দায়িত্ব অবহেলার কারণে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। অন্য কোনো বিষয় নয়। মেয়ে যে স্টেটমেন্ট দিয়েছে সে বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করবো না।’
প্রতিবাদ করায় ইমামকে অব্যাহতি?ইমামকে অব্যাহতি দেওয়ার নিন্দা জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে পোস্ট করছেন শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে উপাচার্য ড. সাদেকা হালিমের প্রবেশ নিয়ে প্রতিবাদ করায় ইমামকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তারা বলছেন, মূল ঘটনার সূত্রপাত গত ১৭ মার্চ। সেদিন জাতীয় শিশু দিবস এবং আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইরুজ অবন্তিকার মৃত্যুতে তার রুহের মাগফেরাত কামনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। মাহফিলের সময় মসজিদের মিম্বারের পাশে নারী-পুরুষ সবাইকে একসাথে বসিয়ে বক্তব্য দিয়েছিলেন সাদেকা হালিম। এ ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন ইমাম ছালাহ উদ্দিন। সেই ক্ষোভ থেকে এবার ছাত্রীর ঘুমিয়ে পড়ার ঘটনায় ইমামকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষার্থীরা জানান, তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইমামকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া ঠিক হয়নি। একটা মেয়ে নারীদের নামাজের জায়গায় অসুস্থ হয়ে ঘুমিয়ে থাকতে পারেন। সেটা ইমাম কীভাবে জানবেন? এরপরও মেয়েটার বক্তব্য শুনে প্রশাসন ব্যবস্থা নিতে পারত৷ কিন্তু সেটা না করে তুচ্ছ একটা ঘটনা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করা হয়েছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ইমামকে অব্যাহতির প্রতিবাদে আজ বুধবার জোহরের নামাজের পর মানববন্ধন ও মিছিল করার চেষ্টা করেন শিক্ষার্থীরা। ছবি : জাগো নিউজ
মিছিল করতে নিষেধইমামকে অব্যাহতির প্রতিবাদে আজ বুধবার (২৯ মে) জোহরের নামাজের পর ক্যাম্পাসে মানববন্ধন ও মিছিলের চেষ্টা করেন শিক্ষার্থীরা। খবর পেয়ে ইমামকে অব্যাহতির ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য এ এন এম আসাদুজ্জামান ফকির সেখানে হাজির হন। তিনি মানববন্ধন ও মিছিল করতে নিষেধ করেন বলে অভিযোগ করেন শিক্ষার্থীরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এ এন এম আসাদুজ্জামান ফকির জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা আসলে শৃঙ্খলার বিষয়ে সেখানে গিয়েছি। শিক্ষার্থীদের বুঝিয়েছি, এখন এ বিষয়ে মানববন্ধন হলে ক্যাম্পাসে বিশৃঙ্খলা হতে পারে। এছাড়া দেখা গেছে ইমামের পক্ষে থাকতে গিয়ে হিতে বিপরীত হয়ে ইমামের আরও ক্ষতি হতে পারে।’
যা বললেন প্রক্টরপ্রক্টর জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘মসজিদ একটা সেনসিটিভ ইস্যু। এখানে আমরা মেয়েলি কোনো ইস্যু খুঁজিনি। কিন্তু অবান্তর ঘটনা ঘটে যেতে পারতো। আমি বিশ্বাস করি, মেয়েটা অসুস্থ ছিল, ইবাদত করতে গেছে। কিন্তু একটা মেয়ে রাত ১১টা পর্যন্ত মসজিদে ঘুমাবে কেন? সেটা ইমাম জানবে না?’
প্রক্টর আরও বলেন, ‘ওই ঘটনার পরদিন ইমামকে আমি প্রক্টর অফিসে দেখা করতে বলেছি। কিন্তু তিনি দেখা করেননি। এমনকি আজ পর্যন্ত তিনি দেখা করেননি। এরপর আমি একটা স্টেটমেন্ট রেডি করে ভিসির কাছে দেই। এখন তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। তারা বিষয়টি তদন্ত করে দেখবে।’
অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব আছে উপাচার্যেরজগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি শুনেছি একটা মেয়ে মসজিদে ঘুমিয়ে গেছে। আমার তো অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব আছে। সে ঘুমিয়ে গেছে, লাইট জ্বালানো ছিল, পরে সেটা অফ হয়ে গেছে বলে শুনেছি।’
ইমামের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনা হয়েছে বলে ছাত্রী গণমাধ্যমে বক্তব্য দিয়েছেন। এ ব্যাপারে উপাচার্য বলেন, ‘মেয়ে যে ভাষ্য দিয়েছে হয়তো সে ভয় পেয়ে এমন কিছু বলছে।’
আরএএস/এসএনআর/এমএমএআর/জিকেএস