খেলাধুলা

অনিশ্চয়তার গৌরব ফেরানোর মঞ্চ

কতগুলো বড় প্রশ্নকে সামনে রেখে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের গভীরে যাওয়া যাক -

Advertisement

১. কোন স্বাগতিক দল কি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শিরোপা জিতেছে কখনো?২. এই আসরে কি চ্যাম্পিয়ন হতে পেরেছে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নরা?৩. ক্রিকেটের এই সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটের বিশ্বকাপে কি চ্যাম্পিয়ন হতে পেরেছে শীর্ষ র‌্যাংধারী কোন দল? ৪. ওয়ানডে বিশ্বকাপজয়ী হিসেবে অংশ নিয়ে কোনো দল কি প্রথমবারেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শিরোপা জিতেছে?

এ সবগুলো প্রশ্নের উত্তরই ‘না’।

এক কথায় সময়ের সেরা দল, হোম গ্রাউন্ড, র‌্যাংকিং এসবের কোন গুরুত্বই যেন নাই ক্রিকেটের এই ছোট ফরম্যাটের বিশ্বকাপে। ছোট ফরম্যাটেও এই বিশ্বকাপের আগে দিনকে দিনই ফিকে হয়ে আসছিল ক্রিকেটের সার্বজনীন বিশেষণ ‘গৌরবময় অনিশ্চয়তা’। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ছোঁয়ায় নতুন করে ক্রিকেট ফিরে পেয়েছে তার সেই হারানো সুর।

Advertisement

ছোট্ট একটা দৃষ্টান্ত দেয়া যাক। ওয়ানডে বিশ্বকাপে ভারতকে একটিবারের জন্যও হারতে পারেনি পাকিস্তান। ৫০ ওভারের বিশ্বকাপে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছে পাকিস্তান হেরেছে সাত-সাতবার। যেটাকে অনেকেই বলে থাকেন পাকিস্তানের সেভেন আপ ট্রাজেডি।

বিশ্বকাপে ভারতকে কি কখনোই হারাতে পারবে না, এই আক্ষেপে বছরের পর বছর পুড়েছে পাকিস্তান সমর্থকরা। এ যেন এক ঐতিহাসিক ক্ষত! পাকিস্তান সমর্থকদের এই মনোকষ্ট দূর করেছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। ২০২১ সালের আসরে ভারতকে ১০ উইকেটে হারিয়েছে পাকিস্তান। ম্যাচ শেষে বিজয়ী অধিনায়ক বাবর আজমের মন্তব্য, এখন তো আর কেউ বলতে পারবে না যে, বিশ্বকাপে ভারতকে আমরা হারাতে পারি না।

বিশ্ব ক্রিকেটে সবচেয়ে আবেদনময়ী দ্বৈরথ ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ। ফুটবলে যেমন ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা! চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দু’দলের ফাইনাল যেন এক সোনার হরিণ। ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় এই উপহারটি দিতে পারেনি অর্ধশতাব্দী বছরের ওয়ানডে বিশ্বকাপ।

আর বিশ্ব ক্রিকেটের যা বাস্তবতা তাতে একই বিশ্বকাপে এই দু’দলের ফাইনালে ওঠাটা শুধু কঠিন নয়, প্রায় অতিলৌকিক একটা ব্যাপার। আর সেই বিরল ঘটনাটি ঘটিয়েছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। পাকিস্তান-ভারত ফাইনাল দেখার স্বপ্নপূরণ করেছে ছোট ফরম্যাটের এই বিশ্বকাপটি। ২০০৭ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের অভিষেক আসরেই গোটা ক্রিকেট দুনিয়াকে উপহার দিয়েছে মাতাল করা সেই ফাইনাল।

Advertisement

খেলাধুলায়, বিশেষ করে ক্রিকেটে ‘হোম গ্রাউন্ড অ্যাডভান্টেজ’ কথাটি খুবই প্রচলিত। সহজ কথায়, ঘরের মাঠের সুবিধা কাজে লাগিয়ে সর্ব্বোচ্চ সাফল্য তুলে নেয়া। কিন্তু এই প্রচলিত ধারণাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। ঘরের মাঠ হয়ে উঠেছে ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’।

এই ফরম্যাটে কোন বিশ্বকাপ আয়োজক দেশই আজ পর্যন্ত নাগাল পায়নি শিরোপার। শুধু এখানেই শেষ নয়। দু’দুবারের চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও ইংল্যান্ড ঘরের মাঠে উঠতে পারেনি ফাইনালেও। ক্রিকেটের দুই পরাক্রমশালী অস্ট্রেলিয়া ও ভারত ঘরের উঠোনে ঝরে গেছে ফাইনালের আগেই।

ক্রিকেটের ছোট সংস্করণের এই বিশ্বকাপের প্রথম আয়োজক দক্ষিণ আফ্রিকা। ২০০৭ সালের ওই আসরে সেমিফাইনালে পৌঁছাতে পারেনি স্বাগতিক প্রোটিয়ারা। তাদের বিদায়ঘণ্টা বাজে সুপার এইট পর্ব থেকেই। শেষ চারের টিকিট পায় ভারত, পাকিস্তান, নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া। পরের আসর অর্থাৎ ২০০৯ সালের টুর্নামেন্টে শেষ চারে জায়গা করে নিতে পারেনি স্বাগতিক ইংল্যান্ড। স্বাগতিকদের পেছনে ফেলে সেমির মঞ্চে উঠে আসে পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বলাবাহুল্য প্রথম দুটো আসরের চ্যাম্পিয়ন যথাক্রমে ভারত ও পাকিস্তান।

তৃতীয় আসরে আয়োজক ওয়েস্ট ইন্ডিজ পা রাখতে পারেনি সেমির মঞ্চেই। ২০১০ সালের এই টুর্নামেন্টে ক্যারিবীয়রা বিদায় নেয় সুপার এইট পর্বেই। ফাইনালে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে প্রথম কোন বৈশ্বিক আসরের শিরোপা জেতে ইংল্যান্ড। ২০১২ সালে স্বাগতিক দেশ হিসাবে প্রথমবারের মত ফাইনালে ওঠার কৃতিত্ব দেখায় শ্রীলঙ্কা। কিন্তু শিরোপার স্পর্শ পায়নি কুমারা সাঙ্গাকারা, মাহেলা জয়াবর্ধনে, তিলকারত্নে দিলশান, অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউজ, অজন্তা মেন্ডিস, লাসিথ মালিঙ্গার মত তারকাঠাসা লঙ্কানরা। স্বাগতিকদের হারিয়ে শিরোপা উৎসব করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

পঞ্চম অর্থাৎ ২০১৪ সালের টুর্নামেন্টটি স্বাগতিক বাংলাদেশের জন্য এক দুঃস্বপ্নের নাম। বাছাইপর্বে হংকংয়ের কাছে ২ উইকেটের ব্যবধানে হারের লজ্জায় ডোবে টাইগাররা। তবে মূলপর্বে জায়গা করে নিতে সমর্থ হয় বাংলাদেশ। আর মূলপর্বে চার ম্যাচেই বড় হারের হতাশা নিয়ে মাঠ ছাড়ে টাইগাররা।

ঘরের মাঠে ভারত সবসময়ই বাঘ; কিন্তু ২০১৬ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বিড়াল বনে যায় স্বাগতিক ভারতও। সেমির লড়াইয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে ৭ উইকেটের হার নিয়ে মাঠ ছাড়ে ভারত। পরের আসর ২০২১ সালে যৌথ আয়োজক ক্রিকেটের পিছিয়ে থাকা জনপদ আরব আমিরাত ও ওমান। আর তাই, এখানে হোম গ্রাউন্ড বিষয়টা প্রজোজ্য নয়। কেননা মূল পর্বেই জায়গা হয়নি স্বাগতিক দুই দলের।

সর্বশেষ ২০২২ সালের আসরে ঘরের দর্শকদের সামনে হতাশায় ডোবে অস্ট্রেলিয়া। পৌঁছাতে পারেনি সেমিফাইনালেই। অসি দর্শকদের জ্বলুনি বাড়িয়ে ক্রিকেটের তীর্থস্থান মেলবোর্ন মাঠে শিরোপা উৎসব করে ইংলিশরা।

ক্রীড়াঙ্গনে সব টুর্নামেন্টে ঘরের মাঠ বড় প্রেরণা হলেও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ আয়োজকদের জন্য হয়ে উঠেছে এক সাক্ষাত মৃত্যুফাঁদ।

৫০ ওভারের ক্রিকেটের সঙ্গে দারুণ সাদৃশ্য ২০ ওভারের ক্রিকেটের। টি-টোয়েন্টি আসলে এক দিনের ক্রিকেটেরই সংক্ষিপ্ত রূপ। শুধু ৫০ ওভারকে চেপে ২০ ওভার করা হয়েছে। দুই ফরম্যাটেই আছে পাওয়ার প্লে। দুই ঘরানাতেই একজন বোলার সর্বোচ্চ বল করতে পারবেন পাঁচ ভাগের এক ভাগ; কিন্তু মাঠের খেলায় বিশেষত বিশ্বকাপে এ দুই ঘরানার ক্রিকেটের আচরণ যেন সম্পূর্ণ বিপরীতমুখি। সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটের এ আসর যেন ওয়ানডে বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের জন্য এক মরণফাঁদ।

ধরা যাক অস্ট্রেলিয়ার কথাই। ২০০৭ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপে হ্যাটট্রিক শিরোপা জেতে প্রবল পরাক্রম অসিরা। এর চারমাস পর অনুষ্ঠিত হয় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের অভিষেক আসর। ৫০ ওভারের ক্রিকেটে এক যুগের বেশি সময় একচ্ছত্র রাজত্ব করা অস্ট্রেলিয়া মুখ থুবড়ে পড়ে ছোট ফরম্যাটের এ বিশ্বকাপে। ভারতের কাছে হেরে ফাইনালেই উঠতে পারেনি ইতিহাসের অন্যতম সেরা দলটি। সেই যে ওয়ানডে চ্যাম্পিয়নদের পতনের শুরু, তার যেন শেষ নেই।

ওয়ানডে (২০১১) চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ২০১২ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অংশ নেয় ভারত। ৫০ ওভারের চ্যাম্পিয়নরা ডোবে আরও বড় লজ্জায়। সেমিফাইনালের আগেই বিদায়ঘণ্টা বাজে মহেন্দ্র সিং ধোনিদের। একবারের বিরতির পর ২০১৫ সালের ওয়ানডে আসরে হারানো মুকুট ফিরে পায় অসিরা। ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে কিন্তু ওয়ানডে চ্যাম্পিয়নরা পারেনি ভাগ্য বদল করতে। সেমিফাইনালের আগেই আসর থেকে ঝরে পড়ে অস্ট্রেলিয়া।

চ্যাম্পিয়নদেও দুঃস্বপ্ন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপকে দিয়েছে বিশিষ্টতা। এই আসরে এখন পর্যন্ত শিরোপা জিততে পারেনি ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নরা। আগের আসরের চ্যাম্পিয়নদের বিদায়ঘণ্টা বাজবেই- এটাই যেন টি- টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নির্ধারিত নিয়তি। প্রথম আসরের চ্যাম্পিয়ন ভারত পরের আসর অর্থাৎ ২০০৯ সালে ঝরে গেছে সেমিফাইনালের আগেই। এই টুর্নামেন্টের চ্যাম্পিয়ন পাকিস্তান পরের আসরে (২০১০) বিদায় নেয় সেমির মঞ্চ থেকে। শিরোপা জেতে ইংল্যান্ড।

২০১২ সালের টুর্নামেন্টে সেমিফাইনালের নাগাল পায়নি ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ইংলিশরা। এই আসরে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কৃতিত্ব দেখায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। পরের আসর অর্থাৎ ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে উঠতে পারেনি আগেরবারের চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্টইন্ডিজ। ওই টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কৃতিত্ব দেখায় শ্রীলঙ্কা।

২০১৬ সালের টুর্নামেন্টে সেমির আগেই বিদায়ঘণ্টা বাজে আগের আসরের চ্যাম্পিয়ন শ্রীলঙ্কার। ওই আসরে শিরোপা জেতে ক্যারিবীয়রা। পরের আসরে (২০২১) সেমির নাগাল পায়নি আগের টুর্নামেন্টের চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ট্রফি জেতে অস্ট্রেলিয়া। সর্বশেষ ২০২২ সালের বিশ্বকাপে ঘরের মাঠে মিশনে নামে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু আগের বারের চ্যাম্পিয়নদেরন স্বপ্নযাত্রা থেমে যায় সেমির আগেই।

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ বদলে দিয়েছে বড়, ছোট’র ধারণা। একক পরাশক্তি হয়ে উঠতে পারেনি কেউই। হোম গ্রাউন্ড, শীর্ষ র‌্যাংকিং, পরিসংখ্যান এসব সংখ্যা ছাড়া যেন কিছ্ইু নয়। ক্রিকেটে অনিশ্চয়তার যে গৌরব তা নতুন করে ফিরিয়ে এনেছে ছোট ফরম্যাটের এই বিশ্বকাপ।

আইএইচএস/