আজ ২৯ মে আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস। বিশ্বের অন্যসব দেশের মতো বাংলাদেশেও যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। আজকের দিনে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী বিশ্বের সব দেশের শান্তিরক্ষীদের অসামান্য অবদানকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। দিবসটি উপলক্ষে জাতিসংঘ মহাসচিব বাণী দেন।
Advertisement
অন্য দেশের মতো বাংলাদেশেও মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধান, সশস্ত্রবাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও), পুলিশের মহাপরিদর্শক এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী পৃথক বাণী দেন।
জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশন একটি মানবিক গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা। শান্তি রক্ষা মিশনের মাধ্যমে জাতিসংঘ যুদ্ধে আক্রান্ত দেশগুলোকে সহায়তা করে। বিভিন্ন আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক বিদ্রোহ দমনে সেই রাষ্ট্রগুলো শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা সহায়তা করছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বড় ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশ শান্তি রক্ষায় সর্বদা উদ্যোগী, সব অবস্থায় শান্তির পক্ষে ও শান্তি রক্ষাকে বাংলাদেশ মৌলিক কাজ বলে মনে করে।
জাতিসংঘের এই মিশনে বাংলাদেশের ওপর অর্পিত দায়িত্ব বাংলাদেশ সুষ্ঠুভাবে পালন করছে। বলা চলে, জাতিসংঘও শান্তি রক্ষা মিশনের মধ্য দিয়ে বিশ্ব শান্তি রক্ষায় অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করে- যা তার মৌলিক কাজ হিসেবে গণ্য। এ কথা সত্য, এই কার্যক্রম সবসময় নির্বিঘ্ন থাকেনি, নানা সংকট ও প্রতিকূলতা পেরিয়ে আজকের অবস্থানে জাতিসংঘ শান্তি মিশন।
Advertisement
অপ্রিয় হলেও সত্য যে, বর্তমান বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো পরমাণু অস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। হিরোশিমা-নাগাসাকির নির্মম ইতিহাস পৃথিবীর মানুষের কাছে নৃশংসতম বর্বরতার উদাহরণ হিসেবে বছরের পর বছর উপস্থাপন হয়ে আসছে। হিরোশিমা-নাগাসাকির নাম শুনলেই এখনও ভয়ে আতঙ্কিত ওঠে বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষ। সেই কারণে আজ মধ্যপ্রাচ্যসহ বহু স্থানের ভয়াবহতা আমাদের ভাবিয়ে তোলে। এসবের চির অবসান হওয়া দরকার।
বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় শক্তিধর দেশগুলোর সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব পরিহার করা দরকার। উল্লেখ্য, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশ একটি বড় অংশীদার। বিশ্বের বিভিন্ন বিরোধপূর্ণ দেশে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ কাজ করে যাচ্ছে। ১৯৮৮ সালে সেনাবাহিনীর ১৫ সদস্যের একটি পর্যবেক্ষক দল ইরাক-ইরান শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে যোগদানের মাধ্যমে জাতিসংঘের পতাকাতলে শান্তিরক্ষা মিশনে কাজ শুরু করে বাংলাদেশ। এক বছর পর ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ পুলিশ নামিবিয়ায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে যোগ দেয়। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ নৌবাহিনী মোজাম্বিক ও বাংলাদেশ বিমান বাহিনী বসনিয়া-হার্জেগোভিনায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রম শুরু করে।
সশস্ত্রবাহিনীর জনসংযোগ বিভাগের গত বছরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে ১২৫টি দেশের ৮৭ হাজারের বেশি শান্তিরক্ষী ১২টি অপারেশনে দায়িত্ব পালন করছেন। শুধু তাই নয়, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে সর্বোচ্চ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় এ পর্যন্ত বিশ্বের ৪০টি দেশে ৬৩টি মিশনে এক লাখ ৮৮ হাজার ৫৫৮ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী সদস্য অংশগ্রহণ করেছে।
যুদ্ধ কোনো দেশ বা জাতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনে না। এই বিশ্ব একটা সংসার, প্রতিটি দেশ তার সদস্য। তাই ভালোবাসা ও সম্প্রীতি বজায় রেখে দেশ পরিচালনা করা সবার কাম্য। আমাদেরও প্রত্যাশা- যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই। সংঘাত নয়, দেশে দেশে শান্তি বিরাজ করুক- এটাই হোক জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক শান্তি দিবসের শপথ।
Advertisement
পাশাপাশি বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের নারী শান্তিরক্ষীদের অংশগ্রহণও ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। ইতোমধ্যে দুই হাজার ৭২৮ জন নারী শান্তিরক্ষী সদস্য সাফল্যের সঙ্গে তাদের দায়িত্ব সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে ৫৭২ জন নারী সদস্য শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে কর্মরত। এছাড়া মিশন এলাকায় সংঘাতপূর্ণ ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এ পর্যন্ত ১৬৭ জন বাংলাদেশি বীরসন্তান জীবন উৎসর্গ করেছেন। আহত হয়েছেন তিন শতাধিক।
বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা হাইতি থেকে পূর্ব তিমুর, লেবানন থেকে কঙ্গো পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন সংঘাতপূর্ণ এলাকায় কাজ করেছেন। বসনিয়ার তীব্র শীত, সাহারা মরুভূমির দুঃসহ গরম ও পূর্ব এশিয়ার ক্লান্তিকর তাপমাত্রার সঙ্গে মানিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা।
ধর্ম, গোত্র, বর্ণ, রাজনৈতিক মতাদর্শ ও আঞ্চলিক বৈষম্য পেছনে ফেলে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী সদস্যরা নিজেদের উৎসর্গ করেন বিশ্ব মানবতার সেবায়। পেশাগত দক্ষতা, নিরপেক্ষতা, সততা ও মানবিকতার কারণে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী সদস্যরা বিশ্বের সব মানুষের কাছে আজ অনন্য দৃষ্টান্ত।
এ কথা সত্য যে, এখনও পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা, চিকিৎসাসহ মৌলিক অধিকার ও সুবিধা থেকে এসব মানুষ বঞ্চিত। অথচ মানবজাতিকে ধ্বংসের জন্য উন্নত দেশগুলো মারণাস্ত্র তৈরির পেছনে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে।
এসব না করে উন্নত দেশের নেতারা আজ যদি তাদের সময়, শ্রম ও অর্থকে বিশ্বব্যাপী বিরাজমান দারিদ্র্য, অশিক্ষা, মারণব্যাধি এইডস এবং নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য ব্যয় করতো, তাহলে বহু বঞ্চিত বিশ্ববাসী উপকৃত হতো। মারণাস্ত্র তৈরির জন্য যে বাজেট ব্যয় হচ্ছে, তার সিকি ভাগও যদি মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ব্যয় হতো তাহলে পৃথিবী ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত হতো।
বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় কয়েক বছর ধরে যে ধরনের সংঘাত বিরাজ করছে, তা আমাদের মনে শঙ্কার জন্ম দেয়। আবার কয়েক বছর ধরে যেমন উদ্বাস্তু স্রোত দেখা যাচ্ছে, তাতে সমস্যা আরও প্রকট বলেই বোধহয়। হাজার হাজার মানুষ যেভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছে, জীবন বাঁচানোর জন্য অন্য দেশের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছে, তা খুবই পীড়াদায়ক ও দুঃখজনক। এই লাখ লাখ জনগোষ্ঠীর উদ্বাস্তুতে পরিণত হওয়া মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার চলমান সংঘাতের ফসল। তাই যে অবস্থা এই সংঘাতের কারণ, তা নিবারণ করা অতি জরুরি।
যুদ্ধ কোনো দেশ বা জাতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনে না। এই বিশ্ব একটা সংসার, প্রতিটি দেশ তার সদস্য। তাই ভালোবাসা ও সম্প্রীতি বজায় রেখে দেশ পরিচালনা করা সবার কাম্য। আমাদেরও প্রত্যাশা- যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই। সংঘাত নয়, দেশে দেশে শান্তি বিরাজ করুক- এটাই হোক জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক শান্তি দিবসের শপথ।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম