মতামত

গরিবি চেহারার গাড়িগুলোর গর্বিত মালিক কারা?

আমাদের রাজধানী ও সারাদেশে একই রাস্তায় চলন্ত গাড়ির ধরন বিভিন্ন; তবে এদের মালিক মূলত দুই শ্রেণির। ধনী আর গরিব মালিক। গরিব মালিকরা কখনো কখনো মাত্র একটি পুরোনো গাড়ির মালিক। তাদের গাড়িগুলো হতে পারে একটি বাস বা মাইক্রোবাস, একটি সিএনজি, একটি বা কয়েকটি অটোরিকশা। তারা সেটাকে ভাড়ায় খাটান অথবা নিজেরাই সেটা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন।

Advertisement

গত বছর রাজপথ থেকে পুরোনো গাড়ি সরানো হবে খবর প্রচারিত হলে তাদের অনেকেই ভেবেছেন উপার্জনের একমাত্র সম্বল একটিমাত্র গাড়ি। সেটা পথে চালাতে না দিলে পরিবার নিয়ে না খেয়ে মারা যাবেন। এসব পুরোনো গাড়ির ব্যক্তিমালিকরা কখনো কোনো নীতিনির্ধারণী সভায় আমন্ত্রিত হন না, তাদের কোনো প্রতিষ্ঠান নেই।

অন্যদিকে পুরোনো গাড়ির ধনী মালিকদের একেকজনের বহু গাড়ি, নিজস্ব পরিবহন প্রতিষ্ঠান, লোকবল, সমিতি, নেটওয়ার্ক সবকিছুই আছে। তারা নতুন গাড়ি কিনে দূরপাল্লায় দেন ও অতিপুরোনোগুলো ঢাকা-চট্টগ্রামে চালান। তারা সরকারের নীতিনির্ধারণী সভায় আমন্ত্রিত হন, মতামত দেন।

এসব বাস মালিকদের উদ্দেশ্য করে এক সভায় সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বলেন, ‘রাজধানী ঢাকায় অনেক উন্নয়ন হলেও লক্কড়-ঝক্কড় বাস চলাচল বন্ধ হয়নি। এজন্য ১২ বছর মন্ত্রী পদে থেকে কথা শুনতে হয়। আপনাদের কি লজ্জা করে না? ... আমাকে জিজ্ঞেস করল, এত বছর মন্ত্রী আছেন, গাড়িগুলোর এই অবস্থা? এই গাড়িগুলো চলে চোখের সামনে। কেন এই বাস বন্ধ করা যায়নি? এটি সত্যিই লজ্জার বিষয়। আপনাদের কি লজ্জা করে না?’

Advertisement

প্রশ্ন হলো- গরিব গরিব চেহারা কি শুধু রাজপথে চলাচলকারী গাড়িগুলোর? জড় পদার্থ ছাড়া গরিব চেহারার জীবগুলোর কথা আগে ভাবা উচিত। জীবগুলোর গরিবি চেহারা দেখানো বন্ধ হলে তাদের বাহনগুলোর গরিবি চেহারা হয়তো আর দেখা যাবে না।

রাজপথে ক্ষুধার তাড়নায় রাজকীয় গাড়ির বন্ধ জানালায় টোকা দিয়ে এক টাকা দাবি করা ভিক্ষুক, ভবঘুরে, অভাবী মানুষ তাদের চেহারাও বেশ মলিন ও গরিবি। তাদের মোট সংখ্যা কত? তারা নিশ্চয়ই মাফিয়াদের কালো কাচ লাগানো গোপন পরিবহন দ্বারা পরিবাহিত হন অথবা রিকশাভ্যান অথবা গরিবি চেহারার বাসে চলাচল করেন। এসব তথ্য নীতিনির্ধারকের কাছে মোটেও অজানা নয়।

তিলোত্তমা ঢাকার রাস্তায় হাল ফ্যাশনের গাড়ির পাশে রংচটা, কালো ধোঁয়া ছড়ানো, লক্কড়-ঝক্কর মার্কা গাড়ি, বাস চলাচল করা নিতান্ত বেমানান। এসব গাড়ির কোনোটির বয়স তেতাল্লিশ বছর পার হয়েছে। এর চেয়ে আরও কত বৃদ্ধ গাড়ি রাজপথে ও দেশের আনাচে-কানাচে চলাচল করছে তার কোনো পরিসংখ্যান কেউ দিতে পারবে বলে মনে হয় না। এসব গাড়ির গর্বিত মালিক কারা?

গত বছর পুরোনো গাড়ি ডাম্পিং করার কথা উঠলে এক শ্রেণির মালিকরা না খেয়ে মারা যাচ্ছেন বলে সংবাদ হয়েছিল। এখন তো অতি বৃদ্ধ গাড়ি ধরে ধরে স্ক্রাপিং করার কথা ভাবা হচ্ছে। তাহলে তাদের এবার কি হবে?

Advertisement

অতি বৃদ্ধ গাড়ি স্ক্রাপিং করার পদ্ধতি সব উন্নত দেশে প্রচলিত। সেখানে অতি বৃদ্ধ গাড়ি ধরে ধরে আনতে হয় না। কোনো গাড়ি সরকার নির্দেশিত বয়সসীমা পার হলে তার লাইসেন্স নবায়ন করা হয় না। উন্নত দেশে লাইসেন্স নবায়ন করা হয় স্বয়ংক্রিয় মেশিনের মাধ্যমে। এতে কোনো নতুন গাড়িও যদি ফেল করে তাহলে সেটা রাস্তায় চলাচলের অনুমতি পায় না। তিনি বাধ্য হন সেই গাড়ি ভাগাড়ে ফেলে দিয়ে আসতে।

তিলোত্তমা ঢাকার রাস্তায় হাল ফ্যাশনের গাড়ির পাশে রংচটা, কালো ধোঁয়া ছড়ানো, লক্কড়-ঝক্কর মার্কা গাড়ি, বাস চলাচল করা নিতান্ত বেমানান। এসব গাড়ির কোনোটির বয়স তেতাল্লিশ বছর পার হয়েছে। এর চেয়ে আরও কত বৃদ্ধ গাড়ি রাজপথে ও দেশের আনাচে-কানাচে চলাচল করছে তার কোনো পরিসংখ্যান কেউ দিতে পারবে বলে মনে হয় না। এসব গাড়ির গর্বিত মালিক কারা?

মজার ব্যাপার হলো, উন্নত বিশ্বে ফিটনেস পেতে ব্যর্থ গাড়ি ডাম্পিং ও স্ক্রাপিং করতে হলে নির্দিষ্ট ফি জমা দিয়ে সরকারি ভাগাড়ে ফেলে দিয়ে আসতে হয়। সেসব ভাগাড় ভর্তি হলে সরকারি লোকেরা নষ্ট গাড়িগুলোকে স্ক্রাপিং করে মন্ড বানিয়ে লৌহজাত দ্রব্য তৈরির কারখানায় পাঠিয়ে দেয়। স্বয়ংক্রিয় মেশিনের মাধ্যমে ফিটনেস পেতে ব্যার্থ গাড়ি রিসাইকেল করার নিয়ম নেই। পরিবেশ সচেতনতা আইনের কঠোরতা থাকায় তারা নিজেদের দেশে সেসব পুরোনো গাড়ি চালাতে পারে না। জাপান ও কিছু দেশ পাঁচ বছরের পুরোনো কিন্তু সচল গাড়ি বিদেশে রপ্তানি করে।

আমাদের দেশে অবৈধভাবে আমদানি, বেনামি, ফিটনেসবিহীন, দুর্ঘটনাকবলিত ইত্যাদি গাড়ি মামলা দিয়ে ধরে এনে থানার পাশে ডাম্পিং করা হয়। বহু থানায় জায়গা না থাকায় রাস্তায় সারিবদ্ধ করে ফেলে রাখা হয়। অনেক সময় ঘুসের ভয়ে মালিকরা গাড়ি ফেরত নিতে আসে না। সেখান থেকে বছরের পর বছর জং ধরে এসব গাড়ির যন্ত্রাংশ চুরি হয়ে ধোলাই খালে বিক্রি হয়।

কারণ, এসব গাড়ির মালিক ও এর তদারকিতে অফিসে ও রাস্তায় দায়িত্বরত কোনো কোনো মানুষের মন খুব গরিব। তাদের জৌলুস ও চেহারা কিন্তু গরিব নয়। তাই কে শোনে কার কথা? ফিটনেসবিহীন, দুর্ঘটনাকবলিত গাড়িগুলো স্ক্রাপ না হয়ে গোপনে পুনরায় রাজপথে ফিরে আসার অনুমতি পায়।

রাজধানীর একই রাস্তায় রোলসরয়েস, মার্সিডিজ, পাগানি, বিএমডব্লিউ, টেসলা, টয়োটা, ফেরারি ইত্যাদি বিলাসবহুল কারের সাথে ৪৩ বছরের পুরোনো লক্কড়-ঝক্কর বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস, মুড়ির টিন, রিকশা, ভ্যান, ঘোড়ার গাড়ি চলতে দেখা যায়। দানব মোটরবাইক ফাঁকফোকর দিয়ে উচ্চশব্দে হর্ন বাজিয়ে পথচারীর গা ঘেঁষে চলে যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করে। এটাই তো আমাদের পথ চলাচলের চিরায়ত কৃষ্টি!

এজন্য কোনো মোটিভেশন আজ পর্যন্ত কাজে লাগানো যায়নি। দেশের গ্রামাঞ্চলে এমনকি হাইওয়েতে চলে নসিমন, করিমন, পঙ্খীরাজ নামক অটোরিকশা, ভটভটি, চান্দের গাড়ি আরও কত কি! নতুন রাস্তায় আধুনিক মোটরবাইক অন্য গাড়ির সাথে পাল্লা দিয়ে চলার কৃষ্টি চালু করেছে সাড়ম্বরে। এসবের গতি নিবারণের জন্য সিসি ক্যামেরা বসালেও অদ্যাবধি দক্ষ ও সৎ জনবল তৈরি করা যায়নি। মুখের কথা ও দেশের বাস্তব অবস্থার মধ্যে এখানেও দুস্তর ব্যবধান তৈরি হয়েছে।

গরিবি চেহারার এসব গাড়ি ছাড়া একই সঙ্গে অনেক বিলাসবহুল গাড়ির মালিক অনেক আমলা ও রাজনৈতিক নেতাও। এজন্য নেপথ্যে থাকা মালিকদের চিহ্নিত করতে হবে। এতদিন পরে ‘সাবওয়ে আমাদের করতেই হবে’ আমাদের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর এমন বোধোদয় হওয়ায় তাকে অনেক ধন্যবাদ। তবে পুঙ্খানুভাবে পরিবেশ ও সামাজিক প্রভাব বিশ্লেষণ না করে বন্যাপ্রবণ ঢাকায় সাবওয়ের মতো বড় কোনো প্রকল্প তৈরির আগাম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলে সাবওয়ে থেকে তেমন কোনো উপকার পাওয়া কঠিন।

কল্পিত পাতাল পথের সাথে ওপরের প্রচলিত পথের কানেক্টটিভিটির বিষয়টি বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এতে মানুষ নিকটস্থ জেলাশহরগুলো থেকে প্রতিদিন ৩০-৪০মিনিটে ঢাকায় এসে অফিস করে বাড়ি ফিরতে পারবে। তাহলে জাপানের টোকিওর সাথে সাইতামা, চিবা, তোচিগি ইত্যাদি নিকটস্থ জেলার মতো আমাদের জনগণ ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, মুন্সিপঞ্জ থেকে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করে ঢাকায় চাকরি করতে পারলে ঢাকার ওপর মানুষ ও বসতির চাপ কমবে এবং গরিবি চেহারার পুরোনো যানবাহনগুলো এমনিতেই বিলীন হতে পারে।

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েরসমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন। fakrul@ru.ac.bd

এইচআর/ফারুক/জেআইএম