গোল্ডেন রাইসের বাণিজ্যিক অনুমোদন বন্ধ ও বিটি বেগুনের বাণিজ্যিক অনুমোদন প্রত্যাহারে চিঠি দিয়ে আহ্বান জানিয়েছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।
Advertisement
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব; পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল এবং বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালকের কাছে সোমবার (২৭ মে) পাঠানো চিঠিতে এ আহ্বান জানানো হয়।
এতে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে বিটি বেগুন ও গোল্ডেন রাইসের বাণিজ্যিক অনুমোদন বন্ধসহ সব ধরনের জিনগতভাবে পরিবর্তিত শস্য ও খাদ্যদ্রবের বাণিজ্যিক অনুমোদন প্রদান থেকে বিরত থাকতে বলা হয়।
চিঠিতে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা উল্লেখ করেন, গত ৪ এপ্রিল গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, আর্ন্তজাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি) এবং বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) মিলিতভাবে দেশে ‘ভিটামিন-এ’ সমৃদ্ধ যুক্তিতে গোল্ডেন রাইস নামক ধানের জাত প্রচলন করতে সরকারি উচ্চপর্যায়ে বৈঠক করেছে।
Advertisement
আরও পড়ুন
‘গোল্ডেন রাইস ও বিটি বেগুন চাষ কৃষকের স্বার্থে নয়’ বিটি বেগুন উৎপাদনের পরিমাণ ১ লাখ ৩৩ হাজার টনপ্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, ইরি’র ‘Healthier Rice Programme’ প্রকল্পের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে জিএমও গোল্ডেন রাইস ধানের জাত অবমুক্তির জন্য সরকারের সহযোগিতা কামনা করেছে এবং সরকার অনুমোদনের আশ্বাসও দিয়েছে। ইরি ছাড়াও গোল্ডেন রাইসের প্রকল্পে সহায়তা দিচ্ছে মার্কিন দাতব্য সংস্থা বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন এবং ধানটির পেটেন্টের স্বত্বাধিকারী হচ্ছে বিদেশি রাসায়নিক কৃষি কোম্পানি সিনজেন্টা।
তারা আরও উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ ধানের আদি নিবাস এবং এ দেশে একসময় ১৫০০০ জাতের ধান ছিল বলে বিভিন্ন গবেষণায় উল্লিখিত হয়েছে। এখনো বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানে ৭৫০০ জাতের ধান সংরক্ষিত রয়েছে বলে প্রচার রয়েছে। বাংলাদেশের মতো প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভরশীল দেশে জিনগতভাবে পরিবর্তিত ধান ও খাদ্য ফসলের প্রবর্তন তাদের উদ্বিগ্ন করেছে।
বিশেষত যেখানে গত ১৭ এপ্রিল ফিলিপাইনের আপিল আদালত নির্দিষ্টভাবে গোল্ডেন রাইস এবং বিটি বেগুনের বাণিজ্যিক চাষ বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছে। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত (নিরপেক্ষ ও পর্যাপ্ত বিজ্ঞান সম্মত গবেষণা) এবং আইনি বাধ্যবাধকতা (বায়োসেফটি রুল, কার্টেহেনা প্রটোকলসহ অন্যান্য) মানার পূর্বে এগুলো বাণিজ্যিকভাবে প্রচলন করা যাবে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
Advertisement
একই সঙ্গে রায়ে গোল্ডেন রাইসের বায়োসেফটি অনুমোদনও প্রত্যাহার করা হয়েছে। যেখানে অন্য কোনো দেশ গোল্ডেন রাইসের বাণিজ্যিক অনুমোদন দেয়নি এবং ফিলিপাইনের আদালত সুনির্দিষ্টভাবে এ অনুমোদনের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে, যেখানে বাংলাদেশে ‘ভিটামিন এ’ এর বিকল্প প্রাকৃতিক উৎস বিদ্যমান ও সহজলভ্য সেখানে ‘ভিটামিন এ’ বেশি পাওয়ার অজুহাতে জিনগতভাবে পরিবর্তিত এবং কোম্পানির পেটেন্টকৃত গোল্ডেন রাইসের বাণিজ্যিক প্রচলন করার কোনো সুযোগ এদেশে নেই বলে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা মনে করেন।
চিঠিতে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা আরও উল্লেখ করেন, গোল্ডেন রাইসের পূর্বে জিনগত পরিবর্তিত বিটি বেগুনের বাণিজ্যিক প্রচলনও বাংলাদেশ সরকার তড়িঘড়ি করে অনুমোদন দিয়েছিল। সে অনুমোদন প্রক্রিয়ায় কেবলমাত্র নাগরিক সমাজ ও পরিবেশবাদী সংগঠনই নয় বরং অনেক সরকারি সংস্থাও উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। বিটি বেগুন বাংলাদেশ, ভারত ও ফিলিপাইনে একই সঙ্গে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করলেও ভারত কিংবা ফিলিপাইন বিটি বেগুনের বাণিজ্যিক প্রচলনের অনুমোদন দেয়নি।
ভারতের আইন প্রণেতারা এ মতামত ব্যক্ত করেছিলেন যে, এ জাতীয় শস্যাদি কেবল কোম্পানির জন্য লাভজনক কিন্তু দেশের আপামর জনসাধারণ ও কৃষকের জন্য লাভজনক নয়। যেই নিরাপত্তা বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ভারত ও ফিলিপাইন বিটি বেগুনের বাণিজ্যিক প্রচলনের চূড়ান্ত অনুমোদন দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল সেই একই বিশ্লেষণের সারমর্মের ভিত্তিতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতি উৎসাহের কারণে বিটি বেগুনের বাণিজ্যিক চাষ বাংলাদেশে অনুমোদন করে।
নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা মনে করেন, যেখানে ধান ও বেগুনের প্রজাতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ স্থানীয় দেশ সেখানে প্রাকৃতিকভাবে পোকা মাকড় দমন ব্যবস্থাপনার দিকে না গিয়ে কোম্পানির পেটেন্টকৃত বীজের দিকে ঝুঁকে পড়া আত্মঘাতীর শামিল।
চিঠির মাধ্যমে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সব ধরনের জিনগতভাবে পরিবর্তিত শস্য ও খাদ্যদ্রবের বাণিজ্যিক অনুমোদন প্রদান থেকে বিরত থাকতে এবং এরই মধ্যে প্রদানকৃত অনুমোদন প্রত্যাহারে অনুরোধ জানান। এ বিষয়ে সব প্রকার সহযোগিতারও প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন তারা।
চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সুলতানা কামাল, নিজেরা করি'র সমন্বয়কারী খুশী কবির, উবিনীগ নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আখতার, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি)-এর নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, নাগরিক উদ্যোগ প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবীর, বীজ বিস্তার ফাউন্ডেশনের সভাপতি ড. এম.এ সোবহান, শিসউকের নির্বাহী পরিচালক সাকিউল মিল্লাত মোর্শেদ, বারসিক গবেষক পাভেল পার্থ, জিএমও বিরোধী মোর্চার সদস্য ইবনুল সাঈদ রানা, বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশনের সভাপতি বদরুল আলম, উন্নয়ন ধারা ট্রাস্টের সদস্য সচিব আমিনুর রসুল, নারী গ্রন্থ প্রর্বতনার সহ-সভানেত্রী সীমা দাস সীমু, নয়াকৃষি আন্দোলনের পরিচালক জাহাংগীর আলম জনি ও বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
এফএইচ/এনএইচ/এমএইচআর/জিকেএস