মতামত

জেনারেল আজিজের ওপর নিষেধাজ্ঞা ও তারপর

গত ৭ জানুয়ারী দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনের আগে স্যাংশন কথাটি ব্যাপক আলোচনায় ছিল। আমেরিকা স্যাংশন দিচ্ছে ব্যক্তিকে, প্রতিষ্ঠানকে এমনকি দেশকেও – এমন একটি আলাপ বেশ জোরালোভাবেই ছিল বিরোধী শিবিরে। বিএনপি ও তার মিত্রদের মধ্যে ব্যাপক উল্লাস ছিল, তাদের নেতারা, বুদ্ধিজীবীরা মানুষের নাম ধরে ধরে তালিকা প্রকাশ করছিল। এরা এতই বাড়াবাড়ি করছিল যে এটা এক পর্যায়ে হাস্যরসে পরিণত হয়। নির্বাচনের পাঁচ মাসের মাথায় এসে এই স্যাংশন কথাটি যেন ফিরে এলো।

Advertisement

আমরা জানি দুর্নীতিতে সম্পৃক্ততার অভিযোগে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। গত মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন অপারেশন অ্যান্ড রিলেটেড প্রোগ্রামস অ্যাপ্রোপ্রিয়েশনস আইনের ৭০৩১ (সি) ধারার আওতায় এ নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেয় মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর। নিষেধাজ্ঞার ফলে জেনারেল আজিজ ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।

আইনের এই অংশে বলা হয়েছে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উল্লেখযোগ্য দুর্নীতি অথবা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় জড়িত অন্য দেশের কোনো সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যদি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য থাকে, তাহলে অভিযুক্ত সেই সরকারি কর্মকর্তা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারের বিবৃতিতে এক বলা হয়েছে, আজিজ আহমেদ কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহের অবমূল্যায়ন এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়ার ওপর জনগণের আস্থা কমেছে।

Advertisement

এর আগে কোনো সেনাপ্রধান বা জেনারেল এভাবে মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় পড়েন নি। ফলে প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য এবং সরকারের জন্য এটি একটি দুঃখজনক বিষয়। আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মতো প্রতিষ্ঠানের মর্যাদাকে দেশের ভেতরে ও আন্তর্জাতিকভাবে ক্ষুণ্ণ করেছে এমন সারাংশে না গেলেও বলা যায় যে একটা অস্বস্তিকর অবস্থা অবশ্যই সৃষ্টি করেছে। এর আগে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে প্রতিষ্ঠান হিসাবে র‌্যাব ও তার ৭ জন কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দেয়।

বিরোধীদলগুলো বলছে ক্ষমতাসীন সরকার একদলীয় কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে রাষ্ট্রের সবগুলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, এমনকি সেনাবাহিনীকেও নিজেদের দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করে আসছে এই নিষেধাজ্ঞা তার প্রমাণ। তারা বলেন, সরকার ও সরকারি দল তাদের কর্তৃত্ববাদী শাসন অব্যাহত রাখতে গিয়ে রাষ্ট্রের বাহিনী ও প্রতিষ্ঠানসমূহকে জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, তাদের পেশাদার দায়িত্বশীলতাকে ক্ষুণ্ণ করা হয়েছে। এ কারণে উপঢৌকন হিসাবে তারা দুর্নীতিগ্রস্ত ও বিতর্কিত কর্মকর্তাদের সর্বোচ্চ আসনে বসিয়েছে। দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসীদেরকেও নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়েছে। আর এভাবে আন্তর্জাতিক পরিসরে দেশের মর্যাদাকে ভীষণভাবে ক্ষুণ্ণ করছে।

তবে সরকার কোনো দায় নিতে চাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা ‘ব্যক্তিগত ভাবে আজিজ সাহেবের’। গত বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠানের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, “যে দপ্তর থেকে বা যে আইনের অধীনে তার (আজিজ আহমেদ) ওপর ভিসা রেস্ট্রিকশন দেওয়া হয়েছে, সেটিতো দুর্নীতির কারণে। এটা পার্সোনাল দায়।

তিন বছর আগে অবসরে গিয়েছেন জেনারেল আজিজ। তিন বছর আগেই আমরা দেখেছিলাম জেনারেল আজিজ-কে বিরল রাজকীয় সংবর্ধনা দিয়েছিল, যা আগে কাউকে দেয়া হয়নি। আল জাজিরায় যখন জেনারেল আজিজকে নিয়ে প্রামাণ্য চিত্র প্রচারিত হয়, তখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রেই ছিলেন। ভিডিও প্রকাশের তিন দিন পর পেন্টাগনে মিটিং ছিল। সে সময় নয়টি এনজিও তার সঙ্গে প্রোগ্রাম না করার অনুরোধ জানিয়েছিল। তবুও শিডিউলের সব প্রোগ্রামই হয়েছে। তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে।

Advertisement

জেনারেল আজিজ আহমেদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টিকে এতটা গুরুত্ব দিতে চাইছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও। দলটির নেতারা মনে করছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সরকার এখন অনেকটাই স্থিতিশীল। এ অবস্থায় সাবেক একজন সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে ভাবার সময় তাদের নাই।

জেনারেল আজিজ নিজে যে কষ্ট পেয়েছেন সেটা তার কথায় এসেছে। বলেছেন, আমি অবাক ও মর্মাহত হয়েছি। বিষয়টি দুর্ভাগ্যজনক। দুর্নীতির অভিযোগ সত্য নয় দাবি করে তিনি বলেছেন, আল-জাজিরা ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন’ নামে তথ্যচিত্র প্রচার করেছিল। সেখানে যে অভিযোগ আনা হয়েছিল, এখন যুক্তরাষ্ট্র একই অভিযোগ এনেছে। ফলে এ দুটি একই সূত্রে গাঁথা বলে আমি মনে করি।

সাবেক সেনাপ্রধান অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল আজিজ আহমেদ ও তার পরিবারের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞাকে সরকারের জন্য বিব্রতকর এবং সতর্কবার্তা বলেই মনে করা হচ্ছে।

বাংলাদেশে এই প্রথম কোনো সাবেক সেনাপ্রধানের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এলো৷ এই অঞ্চলে মিয়ানমার ও পাকিস্তানের জেনারেলদের ওপর এর আগে আমরা দেখেছি৷ একটা বিষয় বোঝা গেল যে ডোনাল্ড লুর সফরে সরকারি শিবিরে যে উল্লাস দেখা দিয়েছিলো সেটাই সবকিছু না। কিছু হার্ড ইস্যু রয়ে গেছে বাকি। আমি একটি বিষয়ে অবাক হয়েছি যে যুক্তরাষ্ট্র তো বলেছিলো নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি যাকে দেয়া হবে তিনি জানবেন এবং তারা জানবে৷ তাহলে এটা প্রকাশ করে তারা কি আলাদা কোনো গুরুত্ব দিচ্ছে? এর আগে ২০২১ সালে অবশ্য রাবের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়টিও তারা প্রকাশ করেছিলো।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, ঢাকা জার্নাল।

এইচআর/এমএস