জাতীয়

এমপি আনোয়ারুলের সন্দেহভাজন ৪ খুনির আখ্যান

ভারতের কলকাতার একটি ফ্ল্যাটে নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন বাংলাদেশের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার। হত্যাকাণ্ডের বিভিন্ন ‘ক্লু’ এরই মধ্যে সামনে এনেছে দুই দেশের তদন্তকারী সংস্থা। জড়িত সন্দেহে উঠে এসেছে বেশ কয়েকজনের নাম। আটকও হয়েছেন চার-পাঁচজন। এর মধ্যে খুনের মাস্টারমাইন্ড আক্তারুজ্জামান শাহীনসহ চারজন সম্পর্কে জানা গেছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য।

Advertisement

তদন্তকারী সংস্থা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ও আটকদের জিজ্ঞাসাবাদের তথ্য বলছে, হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেন চরমপন্থি দল পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা আমানুল্লাহ আমান, মোস্তাফিজ ও ফয়সাল। আর হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড এমপির বাল্যকালের বন্ধু আক্তারুজ্জামান শাহীন। আসছে শাহীনের আরও দুই সহযোগী সিয়াম ও জিহাদের নাম। জড়িয়ে গেছে শাহীনের বান্ধবী সিলিস্তি রহমানের নামও।

হত্যার পুরো দায়িত্ব আমানকে বুঝিয়ে দিয়ে ১০ মে দেশে চলে আসেন মাস্টারমাইন্ড শাহীন। পরিকল্পনা অনুযায়ী, আমান বাংলাদেশ থেকে আরও দুই ভাড়াটে কিলারকে নিয়ে যান কলকাতায়। ফয়সাল ও মোস্তাফিজ নামে দুই ভাড়াটে খুনি ১১ মে কলকাতায় গিয়ে আমানের সঙ্গে যোগ দেন।

হত্যার মাস্টারমাইন্ড শাহীন

Advertisement

মাস্টারমাইন্ড আক্তারুজ্জামান শাহীন ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার এলাঙ্গী গ্রামের বাসিন্দা ও যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। বাবার নাম আসাদুজ্জামান। শাহীনের বাবার মাছ, পাট ও গুড়ের ব্যবসা ছিল। তারা তিন ভাই দুই বোন। সবার বড় ভাই পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ও কোটচাঁদপুর পৌরসভার মেয়র সহিদুজ্জামান সেলিম। মেজ ভাই মনিরুজ্জামান মনির যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। খুকু নামে এক বোন কানাডায় থাকেন। সবার ছোট বোন এনিল থাকেন ঢাকায়। ভাই-বোনদের মধ্যে সবার ছোট শাহীন। বয়স প্রায় ৫৬ বছর।

শাহীনের শ্বশুরবাড়ি রাজধানীর বসুন্ধরায়। স্ত্রীর নাম কনক। তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে। তারা সবাই যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন।

হত্যার মাস্টারমাইন্ড শাহীন

শাহীন কোটচাঁদপুর হাইস্কুল ও কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করেন। পরে সিলেট মেডিকেলে চান্স পেয়ে সেখানে না পড়ে চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমিতে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করেন। পড়াশোনা শেষে জাহাজেও চাকরি করেন। সেখানে থাকা অবস্থায় ডিবি লটারিতে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান তিনি।

Advertisement

আক্তারুজ্জামার শাহীনের বড় ভাই কোটচাঁদপুর পৌরসভার মেয়র সহিদুজ্জামান সেলিম বলেন, ‘শাহীন যুক্তরাষ্ট্র থেকে মাঝে মধ্যে এলাকায় এসে থাকতো বাংলোবাড়িতে। যখন দেশে আসতো তখন আগে থেকে বলতো না, হঠাৎ করেই চলে আসতো।’

কোটচাঁদপুর শাহীনের বাংলোবাড়িতে গিয়ে জাগো নিউজের স্থানীয় প্রতিবেদক দেখতে পান, তালাবদ্ধ। বাড়িটিতে কাউকে পাওয়া যায়নি। বাড়ির ভেতরে কী রয়েছে তা এলাকার কোনো মানুষেরও দেখার সুযোগ হয়নি বলে জানান স্থানীয়রা।

এমপির সঙ্গে ব্যবসা ছিল শাহীনের, জানতেন বড় ভাই

শাহীনের বড় ভাই সহিদুজ্জামান সেলিম বলেন, ‘শাহীন এত বড় একটি হত্যাকাণ্ড ঘটাবে তা বিশ্বাস হয় না। তবে প্রশাসনের উচিত সঠিক তদন্ত করা। যদি আমার ভাই দোষী হয় তাহলে প্রচলিত আইনে তাকে শাস্তি দেওয়া হোক এটা আমরা চাই। এমপি আনারের সঙ্গে তার পারিবারিক ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল। তবে কী ব্যবসা ছিল তা আমরা কখনো জানতে পারিনি।’

আরও পড়ুনখুলনার চরমপন্থি নেতা শিমুল যেভাবে হয়ে ওঠেন আমানুল্লাহএমপি আনোয়ারুল খুনের রোমহর্ষক বর্ণনা দিলেন ডিবিপ্রধান

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, আখতারুজ্জামান শাহীনের একটি বাসা গুলশান ও আরেকটি বসুন্ধরা এলাকায়। এই দুই বাসায় গত দুই-তিন মাস ধরে এমপি আনারকে হত্যার ছক আঁকা হয়। গত ১২ মে এমপি আনার বন্ধু গোপালের বাসায় যান। সেখানে আরও দুজনকে ভাড়া করা হয়। তারা ওই বাসায় আসা-যাওয়া করবে। তারা হলেন, জিহাদ ও সিয়াম। মাস্টারমাইন্ড শাহীন গাড়ি ঠিক করেন। কাকে কত টাকা দিতে হবে, কারা কারা হত্যায় থাকবে, কার দায়িত্ব কী হবে সব ঠিক হয়। দেশে তার কিছু কাজ আছে বলে পাঁচ-ছয় জন কলকাকাতায় রেখে ১০ মে বাংলাদেশে চলে আসেন শাহীন।

এমপি আনোয়ারুল আজীম নিখোঁজের বিষয়টি দেশে আলোচিত হলে তিনি ১৮ মে আবারও ভারত হয়ে নেপালে চলে যান। ২১ মে নেপাল থেকে চলে যান দুবাই। ২২ মে দুবাই থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান।

খুলনা অঞ্চলের কুখ্যাত সন্ত্রাসী আমানুল্লাহ আমানই শিমুল ভূঁইয়া

ডিবির তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যা করার জন্য ভাড়া করা হয় খুলনা অঞ্চলের কুখ্যাত সন্ত্রাসী শিমুল ভূঁইয়াকে। তিনি চরমপন্থি সংগঠন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম শীর্ষ নেতা। এ ঘটনায় ঢাকায় ধরা পড়ার পর পুলিশের কাছে শিমুল ভূঁইয়া নিজেকে সৈয়দ আমানুল্লাহ আমান নামে পরিচয় দেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনি আমানুল্লাহ নামেই পাসপোর্ট বানিয়েছেন, সেই পাসপোর্টে তিনি কলকাতায় গিয়েছিলেন। ২০১৯ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকা থেকে পাসপোর্টটি করা হয়েছিল। পাসপোর্ট করতে একই নামে তিনি জাতীয় পরিচয়পত্রও (এনআইডি) তৈরি করেন। কীভাবে তিনি শিমুল ভূঁইয়া থেকে আমানুল্লাহ হলেন এবং ভুয়া পাসপোর্ট ও এনআইডি তৈরি করলেন, এখন সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন গোয়েন্দারা।

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, কলকাতার নিউটাউনের ভাড়া করা ফ্ল্যাটে সংসদ সদস্যকে খুন করে ১৫ মে দেশে ফেরেন আমানুল্লাহ। পরে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি স্বীকার করেন যে আনোয়ারুলকে তারা খুন করেছেন। এই খুনের জন্য আনোয়ারুলের বন্ধু যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক আক্তারুজ্জামান শাহীনের সঙ্গে পাঁচ কোটি টাকায় চুক্তি হয়। এমপি আনারের সঙ্গে আক্তারুজ্জামানের সোনা চোরাচালান ও হুন্ডির ব্যবসা নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল বলে জানা যায়। আমানুল্লাহর গ্রামের বাড়ি খুলনার ফুলতলার দামোদর ইউনিয়নে।

আমানুল্লাহ আমান

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র বলছে, আমানুল্লাহর বিরুদ্ধে খুনসহ অন্তত দুই ডজন মামলা আছে। গণেশ নামে এক ব্যক্তিকে খুন করে যশোরের অভয়নগর থানার এক মামলায় আমানুল্লাহ সাত বছর (১৯৯১-৯৭) জেল খাটেন। ইমান আলী নামে এক ব্যক্তিকে খুনের ঘটনায় ২০০০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত জেল খাটেন। শিমুল ভূঁইয়া এখনো খুলনার অপরাধজগতে আতঙ্কের নাম। তার স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন এখন খুলনা জেলা পরিষদের সদস্য। তার ভাই শরীফ মোহাম্মদ ভূঁইয়া (শিপলু) দামোদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান।

আমানকে জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের বরাতে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, ১৩ মে বিকেলের দিকে এমপি আনার সঞ্জীবা গার্ডেনের সেই ফ্ল্যাটে প্রবেশ করেন। এরপর আমান তার সহযোগী ফয়সাল, মোস্তাফিজ, সিয়াম ও জিহাদ মিলে এমপিকে চাপাতির মুখে জিম্মি করেন। এসময় তারা এমপির কাছে শাহীনের পাওনা টাকা পরিশোধের কথাও বলেন। বিষয়টি নিয়ে তর্কাতর্কির একপর্যায়ে সবাই মিলে আনারকে জাপটে ধরে বালিশচাপা দিয়ে হত্যা করেন। হত্যার পর আমান বিষয়টি জানান শাহীনকে।

আমানের দেওয়া তথ্যের বরাতে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, শাহীনের পরামর্শ মতো মরদেহ গুম করতে মরদেহ কেটে টুকরো টুকরো করা হয়। এরপর ফ্ল্যাটের কাছেই শপিংমল থেকে আনা হয় দুটো বড় ট্রলিব্যাগ ও পলিথিন। এমপি আনারের মরদেহের টুকরোগুলো পলিথিনে পেঁচিয়ে ট্রলিব্যাগে ভরা হয়। ঘটনার রাতে মরদেহের টুকরোসহ দুটি ট্রলিব্যাগ বাসাতেই রাখা হয়। এর মধ্যে তারা বাইরে থেকে ব্লিচিং পাউডার এনে ঘরের রক্তের দাগ পরিষ্কার করেন।

‘হানিট্র্যাপ গার্ল’ সিলিস্তি রহমান

সিলিস্তি রহমান নামে যে নারীর নাম সামনে আসছে তিনি মূলত আক্তারুজ্জামান শাহীনের কথিত গার্লফ্রেন্ড। কলকাতার নিউটাউনে অভিজাত ‘সঞ্জীবা গার্ডেন্সে’ যে ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়া হয়, সেখানে অবস্থান করেছিলেন এই নারী। হত্যা মিশন শেষে মূল ঘাতক আমানুল্লাহ আমানের সঙ্গে তিনি গত ১৫ মে দেশে ফেরেন। ওই নারীকে এরই মধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) তাদের জালে নিয়েছে। ঘটনার বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ডিবি।

সিলিস্তি রহমান

ধারণা করা হচ্ছে, এমপি আনারকে কলকাতার ওই ফ্ল্যাটে নিতে এ নারীকেই ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান শাহীন। কারণ সব পরিকল্পনা করে শাহীন ১০ মে দেশে ফিরে এলেও সিলিস্তি থেকে যান কলকাতায়।

আরও পড়ুনএমপি আনারের মরদেহ গুম করা সিয়াম কলকাতায় গ্রেফতারআনোয়ারুল আজীমের মরদেহ নিয়ে ধোঁয়াশা

ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেন, হত্যাকাণ্ডের সময় সিলিস্তি তিনতলা ফ্ল্যাটের একটি তলায় অবস্থান করছিলেন। তবে সামনে ছিলেন না। হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পর তিনি নিচে নেমে আসেন।

কলকাতায় গ্রেফতার বাংলাদেশি সিয়াম

কলকাতায় সিআইডির হাতে গ্রেফতার হয়েছেন বাংলাদেশি নাগরিক সিয়াম। ১৩ মে হত্যাকাণ্ডের দিন তিনি সঞ্জীবা গার্ডেনসের ওই ফ্ল্যাটে তিনি ছিলেন বলে জানা যায়। এমপির মরদেহের খণ্ডিত অংশ গুমের দায়িত্ব ছিল সিয়ামের ওপর। এর বেশি তার সম্পর্কে বেশিকিছু জানা যায়নি। একই ঘটনায় জুবের নামে এক ক্যাবচালককেও আটক করেছেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা।

এরই মধ্যে তার গাড়িটিও জব্দ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার ভোর রাতে জব্দ করা হয় সাদা রঙের মারুতি গাড়িটিকে। ওইদিন রাতেই নিউটাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনসের একটি ফ্ল্যাটে তাকে খুন করা হয় বলে অভিযোগ। ১৪ মে প্রথম পর্যায়ে এমপির মরদেহের খণ্ডিত অংশ একটি ট্রলিব্যাগে করে ফ্ল্যাট থেকে বের করা হয়। এরপর তোলা হয় ওই সাদা রঙের ক্যাবে।

গ্রেফতার বাংলাদেশি সিয়াম

সূত্র জানায়, সিআইডির হাতে গ্রেফতার সিয়ামের দায়িত্ব ছিল ওই মরদেহের টুকরোগুলোকে সরিয়ে দেওয়া। সঞ্জীবা গার্ডেনসের ওই ফ্ল্যাট থেকে বেশ কিছু প্লাস্টিক ব্যাগ পাওয়া গেছে। পুলিশের ধারণা, এমপি আনারের মরদেহের টুকরোগুলো সরানোর উদ্দেশ্যে ব্যাগগুলো আনা হয়েছিল।

জিজ্ঞাসাবাদে ক্যাবচালক জানিয়েছেন, গত ১৪ মে এক নারী ও দুই পুরুষকে ট্রলিব্যাগসহ অ্যাকসিস শপিং মলের সামনে নামিয়ে দেন তিনি।

সিসিভিটি ফুটেজ দেখে সিআইডি জানতে পারে অ্যাক্সিস শপিংমলে নামানোর আগে নজরুল তীর্থের কাছে গাড়িটি প্রায় ১৫ মিনিট দাঁড়িয়ে ছিল। সে সময় দেহাংশ কোথায় ফেলা হবে তা নিয়ে আলোচনা হয় গাড়ির মধ্যেই। সিআইডি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ক্যাবচালক সেই আলোচনা শুনে ফেলেন। এরপর অভিযুক্তদের অ্যাক্সিস শপিংমলের সামনে নামিয়ে দেন তিনি।

টিটি/এএসএ/এমআরএম