স্বাস্থ্য

বয়ঃসন্ধিকালীন প্রসবে বাড়ছে ফিস্টুলা

আজ ২৩ মে, আন্তর্জাতিক ফিস্টুলা নির্মূল দিবস। জনসচেতনতা তৈরির উদ্দেশ্যে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক ফিস্টুলা নির্মূল দিবস। দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘আসুন নীরবতা ভেঙে ফিস্টুলা আক্রান্ত নারীদের খুঁজে বের করি, প্রসবজনিত ফিস্টুলা প্রতিরোধ করি।’

Advertisement

পায়ুপথের রোগ ফিস্টুলা। এটি বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। ফিস্টুলায় মলদ্বারের পাশে ছোট ছিদ্র তৈরি হয়, যা দিয়ে পুঁজ-পানির মতো বের হতে থাকে। সাধারণত নালিটি পায়ুপথের কতটা গভীরে প্রবেশ তার ওপর নির্ভর করে জটিলতা। এ সমস্যায় অনেক নারী ভুগে থাকলেও নারীদের সঠিক ধারণার অভাবে কমছে না ফিস্টুলার মতো রোগ। এটি নারী বা মাতৃস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশে ফিস্টুলা রোগীর সংখ্যা কত- এ নিয়ে সঠিক পরিসংখ্যান নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, আনুমানিক এক লাখ ২০ হাজার নারী প্রসবজনিত ফিস্টুলায় ভুগছেন। প্রতি এক হাজার বিবাহিত নারীর মধ্যে এক দশমিক ৬৯ জন প্রসবজনিত ফিস্টুলায় আক্রান্ত।

জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফিস্টুলা আক্রান্ত রোগীর ৯১ দশমিক ৯ শতাংশের বয়ঃসন্ধিকালে (১৩ থেকে ১৯ বছরে) বিয়ে হয় এবং ৮৯ দশমিক চার শতাংশের প্রথম সন্তান প্রসব হয়। এসব রোগীর ৬৩ দশমিক চার শতাংশ তিন থেকে চারটি সন্তান জন্ম দিয়েছেন। ফিস্টুলা রোগীদের মধ্যে ৩০ দশমিক চার শতাংশের বয়স ছিল ৪০ থেকে ৪৯ বছর, ৫০ বছরের বেশি ২৮ দশমিক তিন শতাংশ, ২৬ দশমিক এক শতাংশের বয়স ৩০ থেকে ৩৯ বছর, আট দশমিক সাত শতাংশের বয়স ২০ থেকে ২৯ বছর। এসব রোগীর ৭৯ দশমিক তিন শতাংশের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই।

আরও পড়ুন

Advertisement

১৫-১৯ বছর বয়সী কিশোরীর মা হওয়ার হার সবচেয়ে বেশি

এছাড়াও জরিপে দেখা যায়, ফিস্টুলায় আক্রান্তদের মধ্যে ৫৭ শতাংশের প্রসবজনিত (বাধাগ্রস্ত প্রসব) কারণে ফিস্টুলা হয়েছে। জরায়ু অপসারণ করতে যে অস্ত্রোপচার হয়, সেক্ষেত্রে ৫৬ শতাংশ এবং অস্ত্রোপচারে সন্তান প্রসবের পরবর্তী আঘাতের কারণে ৪০ শতাংশ নারী ফিস্টুলায় আক্রান্ত হচ্ছেন। তবে সঠিক অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ৯৩ শতাংশ রোগীর ফিস্টুলা সারানো সম্ভব। এছাড়াও জরিপে সাম্প্রতিক সময়ে কিশোরীদের মধ্যে ফিস্টুলা আক্রান্তের হার বেশি।

প্রথম সন্তান নেওয়ার সময় ৯৪ শতাংশ কিশোরীর এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এর মধ্যে ৬৪ শতাংশ প্রসূতি এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নীরবে বাড়ছে প্রসবজনিত ফিস্টুলা। এমনকি গত ১০ বছরে দেশে ফিস্টুলা রোগী দ্বিগুণ হয়েছে। দেশে ২০ হাজার নারী জননাঙ্গের ফিস্টুলার সমস্যায় ভুগছেন। এর সঙ্গে প্রতি বছর আরও দুই হাজার রোগী নতুন করে যুক্ত হচ্ছেন। যদিও কতজন রোগী রয়েছেন তার সঠিক কোনো তথ্য নেই।

জরিপ সংশ্লিষ্টরা বলেন, বিশেষ করে প্রসূতিকে বাড়িতে সন্তান প্রসব করানোর সময় বাধাগ্রস্ত বা দীর্ঘস্থায়ী প্রসব হচ্ছে। এতে করে প্রসূতি মারা না গেলেও কিছু ক্ষেত্রে ফিস্টুলায় আক্রান্ত হচ্ছেন। কিন্তু বাংলাদেশে ফিস্টুলার চিকিৎসক অনেক কম। তাই প্রসবজনিত ফিস্টুলা নির্মূলে চিকিৎসক, প্রশিক্ষিত সেবাদানকারী বা মিডওয়াইফদের মাধ্যমে গর্ভকালীন ও প্রসবকালীন সেবা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।

বাংলাদেশে নারীদের ফিস্টুলা নির্মূলের লক্ষ্যে সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) বাংলাদেশ, এনজেন্ডার হেলথ বাংলাদেশ, বেসরকারি ল্যাম্ব হাসপাতালসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। তাদের দাবি, ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি হয়েছে। এ সত্ত্বেও বিশ্বের ৫৫টিরও বেশি দেশে প্রায় পাঁচ লাখ নারী ফিস্টুলা সমস্যা নিয়ে জীবনযাপন করছেন। প্রতি বছর নতুন রোগী শনাক্ত হচ্ছে। এসডিজি অর্জনে বাংলাদেশে এক দশকের মধ্যে নারীদের ফিস্টুলা নির্মূলের প্রচেষ্টাকে জোরদার করতে বলা হয়েছে। সে লক্ষ্যে কাজ চলছে।

Advertisement

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য বলছে, ফিস্টুলা নির্মূলে দেশে ২০০৩ সালে প্রচার শুরুর পর যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। গত পাঁচ বছরে চারটি বিভাগে ফিস্টুলা নির্মূল কর্মসূচি সম্প্রসারণ করা হয়েছে। কমিউনিটি ভিত্তিক রোগী শনাক্তকরণ প্রক্রিয়ার উন্নতি হয়েছে। ইউএনএফপিএ সহায়তায় ৩১টি ফিস্টুলা কর্নার স্থাপন করা হয়েছে। ২০২২ সালে উত্তরাঞ্চলে দুটি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওজিএসবি, ওজিএসবি হাসপাতালে ফিস্টুলা ফাউন্ডেশন নতুন ফিস্টুলা সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছে।

আরও পড়ুন

স্বাভাবিক প্রসব সেবায় একধাপ এগিয়ে সীতাকুণ্ড স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স

ফিস্টুলা সম্পর্কিত জাতীয় বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে দেশে ফিস্টুলা চিকিৎসা সাফল্যের হার ৯০ শতাংশের বেশি। ২০২৩ সালে ১৭টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে সেবা নিয়ে প্রায় দুই হাজার ৫০০টি ফিস্টুলার অপারেশনের মাধ্যমে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে পরিবারে ফিরে গেছেন। ২০৩০ সালের মধ্যে প্রসবজনিত ফিস্টুলা নির্মূলের লক্ষ্যে প্রসবজনিত ফিস্টুলা সম্পর্কিত দ্বিতীয় জাতীয় কৌশল প্রণয়ন করা হয়েছে। এছাড়া সরকার ২০২১ সালের ডিসেম্বরে পঞ্চগড় জেলা ফিস্টুলামুক্ত ঘোষণা করেছে। রংপুর ও সিলেট বিভাগে আট জেলার আটটি উপজেলা ফিস্টুলামুক্ত হবে।

স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞদের পেশাজীবী সংগঠন ‘অবসট্রোটিক্যাল অ্যান্ড গাইনোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ’ (ওজিএসবি)-এর সাবেক প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. রওশন আরা বেগম জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের দেশে হাজারো নারী এবং শিশু নিরাপদ মাতৃত্বের প্রতিশ্রুতি ও সুবিধা থেকে বঞ্চিত। বর্তমানে বিলম্বিত সন্তান প্রসব হতে গিয়ে যে ফিস্টুলা হয় (অবস্ট্রাকটিভ ফিস্টুলা) তা অনেক কমে গেছে। এরপরও সন্তান প্রসবের সময় অস্ত্রোপচার করাতে গিয়ে অসাবধানতাবশত অনেক প্রসূতি ফিস্টুলায় আক্রান্ত হচ্ছেন।

ওজিএসবি হাসপাতালের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. ফেরদৌসী বেগম জাগো নিউজকে বলেন, অদক্ষ ধাত্রীর মাধ্যমে বাড়িতে জোর করে বা বাধাগ্রস্ত সন্তান প্রসবের কারণেই নারীকে ফিস্টুলার মতো জটিল স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগতে হয়। প্রসবপূর্ববর্তী সেবা, প্রসব সেবা ও প্রসবপরবর্তী সেবা—তিন ক্ষেত্রেই আমরা পিছিয়ে আছি। যেমন—আমাদের দেশে ৭০ শতাংশ মানুষ একবার অ্যান্টিনেটাল কেয়ার নেয়। ৩০ শতাংশ গর্ভবতী নারী কোনো চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন না।

তিনি বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুসারে একজন গর্ভবতীকে প্রসবপূর্ব সময়ে অন্তত আটবার অ্যান্টিনেটাল কেয়ারের আওতায় আসতে হবে। কিন্তু আমরা চারবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছি। সেটিও আবার নিয়ে থাকেন ৪২ শতাংশ নারী।

ফেরদৌসী বেগম বলেন, বেশিরভাগ ফিস্টুলা রোগী এখনো আমাদের আশপাশে ছড়িয়ে আছেন। তারা হয় জানেন না, না হয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসে সেবাগুলো নিতে পারেন না। এসব মানুষের বেশিরভাগই দরিদ্র ও অসচেতন। অথচ প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত হলে ফিস্টুলা চিকিৎসার মাধ্যমে পুরোপুরি ভালো হয়ে যায়। এমনকি সার্জারি করারও প্রয়োজন হয় না। বাংলাদেশে অনেক বেসরকারি সংস্থা এই রোগে বিনামূল্যে সার্জারি করিয়ে থাকে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ দেশের ২০টি হাসপাতালে এই রোগের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

জনস্বাস্থ্যবিদ ড. আবু জামিল ফয়সাল জাগো নিউজকে বলেন, ফিস্টুলা রোগ প্রতিরোধযোগ্য। এজন্য গর্ভকালীন ন্যূনতম চারবার স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ, মিডওয়াইফের কাছ থেকে মাতৃ স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ এবং যেকোনো জটিলতার সঙ্গে সঙ্গে নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে হবে। কারও প্রাথমিকভাবে ফিস্টুলা শনাক্ত হলে নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সেবা নিতে হবে।

এএএম/ইএ/এএসএম