গত তিনদিন ধরে ‘টক অব দ্যা কান্ট্রি’ ভারতে গিয়ে নিখোঁজ ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার। নিখোঁজের ৮ দিন পর (২২ মে) জানা গেলো তাকে খুন করা হয়েছে। ভারতে চিকিৎসার জন্য যাওয়া বাংলাদেশের একজন সংসদ সদস্যকে ভারতে কেন হত্যা করা হবে তা নিয়ে দানা বাঁধছে নানান সন্দেহ।
Advertisement
সূত্র বলছে, এই প্রভাবশালী এমপি খুনের পেছনে স্বর্ণ ও চোরাকারবারিদের সঙ্গে যোগাযোগ, নারীঘটিত বিষয় কিংবা রাজনৈতিক কারণ থাকতে পারে। বিভিন্ন দ্বন্দ্বের জেরে ভারতে কৌশলে পরিকল্পিতভাবে আনারকে খুন করা হতে পারে বলেও মনে করছেন অনেকেই। এসব বিষয় সামনে রেখেই তদন্ত করছে বিভিন্ন সংস্থা।
বাংলদেশের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, ভারতে পরিকল্পিতভাবে এমপি আনারকে খুন করা হয়েছে। খুনের সঙ্গে জড়িত সবাই বাংলাদেশি। খুনের কারণের বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত চলছে।
প্রতিবেশী কোনো দেশে এর আগে কখনো একজন বর্তমান বাংলাদেশি এমপি এভাবে খুন হননি। তার নিখোঁজ ও মৃত্যু ঘিরে রহস্যময় পরিস্থিতি জনমনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। কেন তাকে খুন করা হলো? এর পেছনে উদ্দেশ্য কী? কারা জড়িত থাকতে পারে? নিখোঁজের সময় তিনি কোথায় ছিলেন? মরদেহ কেন পাওয়া যাচ্ছে না? এমপি কী কোনোভাবে কোনো বেআইনি কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন?
Advertisement
গত ১২ মে চিকিৎসার জন্য তিনি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ থেকে চুয়াডাঙ্গার দর্শনার গেদে সীমান্ত দিয়ে ভারতে যান এমপি আনার। ওঠেন পশ্চিমবঙ্গে বরাহনগর থানার মণ্ডলপাড়া লেনে গোপাল বিশ্বাস নামে এক বন্ধুর বাড়িতে। পরদিন ডাক্তার দেখানোর কথা বলে বাড়ি থেকে বের হন। এরপর থেকেই রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ আনোয়ারুল আজীম।
আরও পড়ুন
নিউটাউনে যেভাবে সন্ধান মেলে আনোয়ারুল আজীমের আনোয়ারুল আজীমের মরদেহ উদ্ধার হয়নি: পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ আনোয়ারুল আজীমের মরদেহ নিয়ে ধোঁয়াশাবাড়ি থেকে বেরোনোর পাঁচদিন পরে, গত ১৮ মে বরাহনগর থানায় আনোয়ারুল আজীম নিখোঁজের বিষয়ে একটি জিডি করেন বন্ধু গোপাল বিশ্বাস। এরপরও খোঁজ মেলেনি তিনবারের এই সংসদ সদস্যের। বুধবার (২২ মে) হঠাৎ খবর ছড়ায়, কলকাতার পার্শ্ববর্তী নিউটাউন এলাকায় বহুতল সঞ্জীবা গার্ডেনস নামে একটি আবাসিক ভবনের বিইউ ৫৬ নম্বর রুমে আনোয়ারুল আজীম খুন হয়েছেন। ঘরের ভেতর পাওয়া গেছে রক্তের ছাপ। তবে ঘরে মেলেনি মরদেহ।
রহস্যময় হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজএমপির মোবাইল থেকে গত ১৫ মে হোয়াটসঅ্যাপে তিনটি মেসেজ আসে। একই মেসেজ তিনজনকে দেওয়া হয় তার নম্বর থেকে। সংসদ সদস্যদের কলকাতার বন্ধু গোপাল, তার (এমপি আনারের) ব্যক্তিগত গাড়িচালক ও তার ভাগনির হোয়াটসঅ্যাপে একই মেসেজ আসে। এই মেসেজ নিয়ে রহস্য তৈরি হয়। কারণ, ব্যক্তিগতভাবে সংসদ সদস্য এমনভাবে মেসেজ লিখতে পারেন না বলে জাগো নিউজকে জানিয়েছেন তার ব্যক্তিগত সহকারী আব্দুর রউফ।
Advertisement
হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজে যা লেখা ছিল‘আমি এখন বিজি থাকব আমাকে ফোনে পাওয়া যাবে নাআমি দিল্লি নেমে সময় মতো কন্টাক করব’
‘আমি মাত্র দিল্লি নেমেছি, ২জন ভিআইপি এর সাথে আছি। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ফোন দেবার দরকার নাই’
‘চিন্তা করার দরকার নাই। অনেক ভালো খবর নিয়ে আসবো ইনশাআল্লাহ’
৮ বছরে এমপির বিরুদ্ধে অস্ত্র, বিস্ফোরক, মাদক ও স্বর্ণ চোরাচালানের মামলা
গত ৭ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামা অনুযায়ী, তিনবার নির্বাচিত আনার ২০০০ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে ২১টি মামলার আসামি ছিলেন। এর মধ্যে তিনটি হত্যা মামলা, বাকিগুলো অস্ত্র, বিস্ফোরক, মাদক ও স্বর্ণ চোরাচালান, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি এবং চরমপন্থিদের আশ্রয় দেওয়ার মামলা।
এমপির নামে রেড নোটিশ ছিল ইন্টারপোলেইন্টারপোলের ‘ওয়ান্টেড’ তালিকায়ও ছিলেন তিনি। যদিও পরবর্তীসময়ে আওয়ামী লীগের শাসনামলে ২১টি মামলায় তিনি খালাস পেলেও বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসায় তার সম্পৃক্ততার অভিযোগ সময়ে সময়ে উঠে এসেছে।
ব্যবসায়িক বিরোধ নিয়ে সন্দেহচোরাকারবারিদের সঙ্গে আনারের সম্পৃক্ততার অভিযোগ বহু পুরোনো। চোরাকারবারে জড়িত থাকার অভিযোগে ইন্টারপোল তার বিরুদ্ধে রেড নোটিশ ইস্যু হয়। তার ঘনিষ্ঠ অনেকে মনে করছেন, পুরোনো কোনো ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব থেকে প্রতিপক্ষরা আনারকে খুন করতে পারে।
রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে খুন?নিহত এমপির সেজো ভাই মো. এনামুল হক ইমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঝিনাইদহ জেলার আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সবার সঙ্গে। ঝিনাইদহ চারটি আসনেই গ্রুপিং রয়েছে। প্রয়াত জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল হাইয়ের একটি গ্রুপ ছিল অন্যদিকে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুর আরেকটি গ্রুপ ছিল।’
তিনি বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের আগে থেকেই জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুর সঙ্গে আমার ভাই আনোয়ারুল আজীম আনারের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়।’
রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে খুন কি না জানতে চাইলে নিহত এমপির ভাই ইমান বলেন, ‘রাজনৈতিকভাবে যদি ফেলে দিয়ে আরেকজন এমপি হতে পারে তাহলে খুন করতে পারে।’
ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. শফিকুল ইসলাম অপু জাগো নিউজকে বলেন, ‘রাজনৈতিকভাবে কার কখন দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় তা বলা কঠিন।’
ট্র্যাপে ফেলে হত্যা নিয়ে সন্দেহযে ভবনে হত্যা করা হয়েছে ওই ভবনের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে কলকাতা পুলিশ জানতে পেরেছে, গত ১৩ মে সঞ্জীবা গার্ডেনসে উঠেছিলেন এমপি আনার। তার সঙ্গে ছিলেন আরও তিনজন, একজন ছিলেন নারী। এরপর থেকে আনার ভবনের বাইরে না বেরোলেও বাকিরা বেশ কয়েকবার বের হন। সঞ্জীবা গার্ডেনসের আশপাশে পুরোটাই বস্তি অঞ্চল। তার মধ্যেই অবস্থিত অভিজাত আবাসিক ভবনটি। সেখানেই শেষবারের মতো জীবিত অবস্থায় দেখা গিয়েছিল এমপি আনারকে।
ওই নারী কে এবং কেন এমপি আনারের সঙ্গে ওই ফ্ল্যাটে গিয়েছিলেন তা নিয়েও ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, নারী দিয়ে ট্র্যাপে ফেলে ভবনে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
যা বলছে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশবুধবার (২২ মে) বিকেলে নিউটাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনস থেকে বেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের আইজি সিআইডি অখিলেশ চতুর্বেদী সাংবাদিকদের জানান, সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার খুন হয়ে থাকতে পারেন।
তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত মরদেহ উদ্ধার হয়নি। আমরা কেসের তদন্ত শুরু করেছি। আমাদের কাছে যা তথ্য রয়েছে, তাতে ১৩ তারিখে তিনি এই ভবনে ঢুকেছিলেন। তবে এর আগে এসেছিলেন কি না সেটি আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। তার সঙ্গে আরও কয়েকজন ছিলেন। যদিও বিষয়টি এখনো তদন্তসাপেক্ষ।
অখিলেশ চতুর্বেদী আরও জানান, যে ফ্ল্যাটটিতে ওই সংসদ সদস্য এসে উঠেছিলেন, সেটি সন্দীপ রায় নামে এক ব্যক্তির। তিনি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আবগারি দপ্তরে কাজ করেন। তিনি ভাড়া দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা (প্রবাসী বাংলাদেশি) আখতারুজ্জামান নামে এক ব্যক্তিকে।
ঢাকায় হত্যা মামলা করলেন এমপির মেয়েআনোয়ারুল আজীম আনার ভারতে খুন হওয়ার ঘটনায় রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা দায়ের হয়েছে। মামলা নম্বর-৪২। বুধবার (২২ মে) সন্ধ্যায় মামলার এজাহার দায়ের করেন তার মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন। জাগো নিউজকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন শেরেবাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মু. আহাদ আলী।
তিনি জানান, সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় কোনো আসামির নামোল্লেখ করা হয়নি। সবাই অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবে দেওয়া হয়েছে। এখন তদন্ত করে আসামিদের আইনের আওতায় আনা হবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যা বললেনস্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেন, ভারতে নিখোঁজ আনোয়ারুল আজীম আনারকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে। এ হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশের মানুষ জড়িত। নিজ বাসভবনে সাংবাদিকদের একথা বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
তিনি বলেন, আজ সকালে ভারতীয় পুলিশ আমাদের জানিয়েছেন এমপি আনোয়ারুল আজীম খুন হয়েছেন। ভারতীয় পুলিশ যে তথ্য আমাদের দিয়েছিলেন সে তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ পুলিশ তিনজন অপরাধীকে ধরেছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে, তদন্ত চলছে।
ডিবিপ্রধান যা বলছেনডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ সাংবাদিকদের বলেন, ঘটনাটি মর্মান্তিক। এটি নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড। আনোয়ারুল আজীম আনার একজন জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধি ছিলেন। তার এলাকার সাধারণ মানুষ স্তম্ভিত। অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে আমরা কাজ করছি। তিনি তিনবারের সংসদ সদস্য। নিবিড়ভাবে ভারতীয় পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। কয়েকজন আমাদের কাছে আটক আছে। তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাচ্ছি। তদন্তের স্বার্থে আমরা সবকিছু বলতে পারছি না।
বাবার হত্যাকারীদের ফাঁসি দেখতে চাই: ডরিনমিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে আনোয়ারুল আজীম আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন বলেন, আমার বাবাকে যারা হত্যা করেছে তাদের ফাঁসি দেখতে চাই। যারা আমার বাবাকে হত্যা করেছে তাদের আমি দেখতে চাই।
‘এরই মধ্যে জেনেছি যে, আমার বাবাকে হত্যা করা হয়েছে। এটা শুনেই আমি ডিবিপ্রধান হারুন আঙ্কেলের কাছে এসেছি। তারা তিনজনকে ধরেছেন। মূলত, আমি মামলা করবো। ডিএমপি কমিশনার, ডিবিপ্রধান ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। সবাই আমাকে আশ্বস্ত করেছেন। ডিবি আন্তরিকতার সঙ্গে বিষয়টি দেখছে।’
ডরিন বলেন, আমার কোনো ভাই নেই। আমরা দুই বোন। বড় বোন ডক্টর। আমি এলএলবি পড়ছি। আমি ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের আন্ডারে এলএলবি পড়ছি। আমি নিজেই আজ এখানে এসেছি। ডিবি পুলিশ আন্তরিকতার সঙ্গে বিষয়টি দেখছে বলে আমি অনেক তথ্য পাচ্ছি।
এদিকে, আনোয়ারুল আজীম আনারের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বুধবার (২২ মে) এক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী আনোয়ারুল আজীমের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেন।
টিটি/এএসএ/জিকেএস