ঢাকার জনপরিবহন ব্যবস্থাই ঢাকার প্রধান সমস্যা যা সবাইকেই মোকাবেলা করতে হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, ব্যয়ও বেড়েছে। জীবনযাত্রার মান বেড়েছে, অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। আজ থেকে ১৫ বছর আগের ঢাকাকে আজ আর চেনা যায় না। এক্সপ্রেসওয়ে, ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল আজ ঢাকার বাস্তবতা।
Advertisement
এই শহরে পৃথিবীর অন্যান্য আধুনিক শহরের মতোই মেট্রোরেল চলবে তা ছিল এক কল্পনামাত্র। সেখানে আজ মেট্রারেলের পাশাপাশি আছে এক্সপ্রেসওয়েও। এগুলো অবশ্যই আমাদের জনপরিবহন ব্যবস্থায় ইতিবাচক প্রভাব নিয়ে এসেছে সন্দেহ নেই। আমরা তার সুফল ভোগ করছি। যদিও ব্যাপকহারে সাধারণ নাগরিকদের এখনও এই সুবিধার আওতায় আনা যায়নি।
মেট্রোরেলের সংখ্যা বা ট্রিপ আরও বাড়ানো প্রয়োজন আছে। এক্সপ্রেসওয়েকে সাধারণ নাগরিকদের জন্য আরও ব্যবহারযোগ্য করতে হবে। সেজন্য জনপরিবহন বা পাবলিক বাসকেও এর আওতায় আনতে হবে। কঠোর নিয়ম আরোপ করতে হবে। এখনও শুধুমাত্র গুটি কয়েক প্রাইভেটকারই এক্সপ্রেসওয়ের বড় সুবিধাভোগী। এই প্রবণতা এক্সপ্রেসওয়ের এই বিশাল বিনিয়োগকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। কাজেই, আরও পাবলিক বাস যাতে এই সুবিধা নিতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে।
ব্যাটারি চালিত রিকশা যদি বিদ্যুৎ সমস্যার কারণ হয়ে থাকে সেটিও পরিষ্কার করতে হবে। আর বিদ্যুতের সমস্যার জন্য যদি ব্যাটারি চালিত রিকশা বন্ধ করতে হয়, তবে তার আগে কয়েক লক্ষ বা কোটি টাকা দিয়ে গাড়ি কিনে সেই গাড়ি সিএনজি দিয়ে চালানো বন্ধ করতে হবে। গ্যাসের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনও তো ব্যাহত হয়। আগে গোড়ায় হাত দিতে হবে।
Advertisement
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন হচ্ছে সন্দেহ নেই। তবে এ উন্নয়নকে আরও বেগবান ও দৃশ্যমান করতে না পারলে পরিস্থিতি দিনকে দিন আরও খারাপ হবে। এক্সপ্রেসওয়ে বা মেট্রোরেল হওয়ার পরও ঢাকার সড়গুলোর চিত্র আগের মতোই রয়ে গেছে। এই ঢাকা শহরে একই সড়কে রিকশা, ঘোড়ার গাড়ি থেকে শুরু করে বাস, অটোরিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিক্সা সবই চলছে। কিন্তু এতোকিছুর পরও ঢাকার ট্রাফিক জ্যাম কমছে না। আসলে, এতোকিছু একসঙ্গে চললে রাস্তার গতি থাকে না। তখন পায়ে হেঁটেও মানুষ সড়কের চেয়ে আগে যেতে পারে।
যেকোনো বড় শহরেরর গণপরিবহনের মূল ভরসা বাস। বাসের ওপর নির্ভরতা সব শহরেই আছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে ঢাকার বাসের সংখ্যা কিছু বাড়লেও মান আগের মতোই আছে। এবং যাত্রী সংখ্যার সাথে যে সংখ্যক বাস থাকা দরকার তার সিকি ভাগও নেই। বাসের মানের কথাই বাদই দিলাম। ২০২৪ সালে এসে ঢাকায় যেসব বাস চলাচল করে তা দুঃখজনক। একটি দেশের রাজধানীতে এরকম বাস চলাচলের অনুমতি কীভাবে পায় সেটাই এক বিস্ময়। মূলত: ঢাকায় গণপরিবহনের কোনো নিয়ম-নীতিই নেই। ফলে, যাত্রী সাধারণের ভোগান্তি কমেনি, বরং বেড়েছে বহুগুণ।
ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে কথা হচ্ছে। ঢাকা রিকশার শহর আমরা জানি। কিন্তু রিকশা কি চিরদিনই থাকবে? এক সময় কোলকাতায় টানা রিকশা ছিল। আজ থেকে ২০ বছর আগে কোলকাতার অধিকাংশ এলাকায় টানা রিকশা চলতো। কিন্তু এখন কোলকাতায় হাতেগোনা কয়েকটি টানা রিকশা আছে। তাও ঐতিহ্য হিসেবে আছে হয়তো। এবং এ রিকশাগুলোতে কোলকাতার অধিবাসীরা খুব কমই ওঠেন। বাংলাদেশ থেকে যারা বেড়াতে যান তারাই বেশি এগুলোতে চড়েন। কারণ, আমাদের কাছে এটি অভিনব। কাজেই, গতি বাস্তবতাকে মেনে নিতে হয়।
আধুনিক জীবনের অন্যতম অনুষঙ্গ আধুনিক ও গতিশীল পরিবহন ব্যবস্থা। একটি শহরের জনসংখ্যা, সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সেই শহরের পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। এক সময়ে আমাদের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে মিল রেখেই এই শহরে রিকশা নেমেছিল। আজ সময় বদলেছে। জীবনে গতি আনতে হবে। শহরে মানুষও বেড়েছে বহুগুণ।
Advertisement
লাল কৃষ্ণচূড়া আর নীল আকাশ দেখতে দেখতে বৃষ্টিতে ভিজে রিকশায় বাড়ি ফেরার বিলাসীতা কি আমাদের আছে? সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুই বিবর্তিতও হয়। আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আলিঙ্গন করতে হবে। মানছি, রিকশা হয়তো আজও আমাদের বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক অবস্থার সঙ্গে মানানসই। রাতারাতি তা আমরা পরিবর্তন করতে বা ফেলে দিতে পারবো না। কিন্তু আজ হোক, কাল হোক- ধীরে ধীরে রিকশা আমাদের বিসর্জন দিতেই হবে। রিকশার সঙ্গে আমাদের অনেক আবেগ থাকতে পারে। আবেগ আছেও, কিন্তু আমাদের বাস্তবতা মেনে নিতে হবে।
ঢাকার প্রধান প্রধান সড়কে এক সময় রিকশা চলতো। এখন ভিআইপি সড়কে রিকশা চলে না। সম্ভবও না। অন্যান্য মূল সড়কগুলোতেও ধীরে ধীরে রিকশা বন্ধ করেই দিতে হবে। কারণ, একটা রিকশায় যাত্রী থাকে দুই জন। আর একটা বাসে যাত্রী থাকে ৪০ থেকে ৫০ জন। চার/পাঁচটি রিকশায় যাত্রী থাকে বড়জোর ১০ জন আর চালক থাকে ৫ জন। সেখানে সেই একই পরিমাণ জায়গায় ৪০ জন যাত্রী আর একজন চালক ও কন্টাক্টর নিয়ে যাত্রী পরিবহন সম্ভব। সীমিত সড়কের সর্বোচ্চ ব্যবহারের কথাও আমাদের ভাবতে হবে।
মেগাসিটি ঢাকা। ১ কোটি মানুষের বসবাস এই শহরে যা ক্রমাগতই বাড়ছে। শহরকে গতিশীল করতেই জনপরিবহনের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। বেশি সংখ্যক যাত্রী পরিবহন করতে পারে এমন বাস নামাতে হবে। ধীরে ধীরে ফুটপাতও দখলমুক্ত করতে হবে। আবার ফুটপাতের ব্যবসায়ীদেরও একটা ব্যবস্থা থাকতে হবে। তবে যেকোনোভাবেই সড়কে দোকানপাট ব্যবসাপাতি বন্ধ করতে হবে। মূল সড়কে রিকশা ভ্যানও বন্ধ করতে হবে। সবার স্বার্থেই এটি করতে হবে। ঢাকায় যে সড়ক আছে তা যথেষ্ট। শুধু দখলমুক্ত মুক্ত তার যথাযথ ব্যবহার করতে হবে।
এলাকার অলি-গলিতে রিকশা চলতেই পারে। তবে সেখানেও বেশি যাত্রী বহনকারী ছোটছোট বাগি বা গাড়ির ব্যবস্থা করতে হবে। একজন যাত্রী একজন চালক-এই বিলাসী পরিবহন ব্যবস্থার সুযোগ হয়তো আমরা খুব বেশি দিন ধরে রাখতে পারবো না। আমরা জোর করেই এসব চালু রাখছি। চালু রাখছি, কারণ আমরা বিকল্প ব্যবস্থা করতে পারিনি। রিকশাওয়ালা ভাইদের জন্যও বিকল্প পরিবহন ব্যবস্থায় শ্রমের সুযোগ রাখতে রাখতে হবে। তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। তবেই তারা নতুন পরিবহন তথা শ্রমকে স্বাগত জানাবে। তাদের রুটি-রুজিতে হাত দেওয়ার আগে বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে।
১৮ মের বিআরটির বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ঢাকায় ব্যাওটারি বা মোটরচালিত রিকশা বা ভ্যান চালানো বন্ধের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। সে ঘোষণা আবার বাতিলও করা হয়েছে। আসলে তড়িঘরি করে সিদ্ধান্ত নিতে এমনই হয়। রঙচটা, জরাজীর্ণ, লক্কড়-ঝক্কড় মোটরযান চলাচলও বন্ধেরও নির্দেশ দেয়া হয় ওই ঘোষণা। ভালো কথা, কিন্তু সেখানে কি যথেষ্ট সংখ্য আধুনিক বা বা মোটরযান নামানো হয়েছে? নতুন ও আধুনিক বাস না নামিয়ে লক্কড়-ঝক্কর মার্কা বাস বন্ধ করলেই কি সমাধান? মানুষ কি পায়ে হেঁটে চলাচল করবে? পায়ে হাঁটার পথও তো আজ বেদখল, রীতিমতো বাজার!
বিকল্প ব্যবস্থা না করায় এর বিরুদ্ধে ব্যাটারি বা মোটরচালিত রিকশার চালকরা রাস্তায় নেমেছে। প্রতিবাদ করেছে। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করেই এমন ঘোষণা কেন সরকার সেটি পরিষ্কার করেনি। প্রশ্নটি হচ্ছে রিকশা থাকবে নাকি থাকবে না। সেটি ব্যাটারি চালিত হোক বা না হোক। ব্যাটারি চালিত রিকশা যদি বিদ্যুৎ সমস্যার কারণ হয়ে থাকে সেটিও পরিষ্কার করতে হবে। আর বিদ্যুতের সমস্যার জন্য যদি ব্যাটারি চালিত রিকশা বন্ধ করতে হয়, তবে তার আগে কয়েক লক্ষ বা কোটি টাকা দিয়ে গাড়ি কিনে সেই গাড়ি সিএনজি দিয়ে চালানো বন্ধ করতে হবে। গ্যাসের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনও তো ব্যাহত হয়। আগে গোড়ায় হাত দিতে হবে। কাজেই, কোটিপতিদের নির্বিঘ্ন চলাচল নিশ্চিত করে গরীবের রিকশা থেকে ব্যাটারি খুলে নেওয়ার মধ্যে বাহাদুরি থাকতে পারে, কিন্তু নির্বুদ্ধিতাও কম নয়।
প্যাডেল চালিত রিকশায় যদি সমস্যা না হয় ব্যাটারিচালিত রিকশায়ও সমস্যা হওয়ার কথা নয়। বরং ঢাকায় প্রচণ্ড গরমের মধ্যে ব্যাটারিচালিত রিকশা চালকদের কিছুটা হলেও স্বস্তি দেয়। তাদেরকে কষ্ট করেই খেতে হয়। সেখানে ব্যাটারিচালিত রিকশা যদি তাদের কিছুটা কষ্ট লাঘব করে তাতে দোষ কী? তবে, ব্যাটারিচালিত হোক বা প্যাডেল চালিত হোক, ঢাকার মূল সড়কে রিকশা বন্ধ করতেই হবে। পাড়া-মহল্লার রাস্তায় এগুলো চলতে পারে। ঢাকার প্রগতি স্মরনি থেকে শুরু করে মালিবাগ, গুলিস্তান পুরো সড়কে অবিলম্বে রিকশা বন্ধ করা জরুরি।
মূলত গাজীপুরের চৌরাস্তা, গাবতলী, যাত্রাবাড়ি, সায়েদাবাদ থেকে ঢাকার মূল সড়কে রিকশা বন্ধ করতে হবে। ঢাকাকে চলমান ও গতিশীল করতে এর বিকল্প নেই। তবে তারও আগে সড়কে যথেষ্ট সংখ্যক বাস নামাতে হবে। কিছুক্ষণ পর পর বাস আসবে- এমন একটি পরিবহন ব্যবস্থা আমাদের লাগবে। কোথাও কোনো বাস দাঁড়িয়ে থাকবে না। বাস আসবে, যাত্রী উঠবে-নামবে, বাস চলে যাবে। মেট্রোরেলের ট্রিপ বাড়াতে হবে। এক্সপ্রেসওয়েকে জনবান্ধব করতে হবে।
কোটি লোকের বসবাস যে শহরে সেখানে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ করতেই হবে। অবশ্যই এখানে রিকশা যারা চালান তাদের কথাও ভাবতে হবে। ফলে আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থার সঙ্গে তাদেরও সম্পৃক্ত করতে হবে। নতুন পরিবহন ব্যবস্থায় তাদেরকেও চাকরি বা কাজের ব্যবস্থা করতে হবে।
ঢাকার গণপরিবহন চালায় সিন্ডিকেট। সরকার এ সিন্ডিকেট ভাঙতে পারে না। ফলে এখানে আজও লক্কড়-ঝক্কর বাস চলাচল করে। তারা ইচ্ছা মতো বাসের ভাড়া বাড়ায়। কিন্তু বাসের সংখ্যা ও সেবার মান বাড়ায় না। সরকারও কিছু করতে পারে না।
পৃথিবীর সব দেশিই তাদের গণপরিবহনব্যবস্থা ঢেলে সাজিয়েছে। একটি মেগাসিটির মূল সৌন্দর্যই হচ্ছে তার সহজ ও গতিশীল পরিবহন ব্যবস্থা। কোলকাতায়ও আজ রুট অনুযায়ী বাস চলাচল করে। দিল্লিতেও রুট নম্বর অনুযায়ী বাস চলাচল করে। যাত্রী ওঠানামা করতে যতক্ষণ। বাস আসে আর যায়। তেমন কোনো জ্যামও নেই। ফলে, যাত্রীরা দাঁড়িয়েও গন্তব্যে যেতে পারে। কয়েক মিনিটেরই তো ব্যাপার। আমাদের ঢাকা শহরই বা কতটুকু জায়গা। জ্যাম না থাকলে গাজীপুরের চৌরাস্তা থেকে যাত্রাবাড়ি যেতে ১ ঘণ্টা/দেড় ঘণ্টার বেশি কি লাগার কথা? কিন্তু স্থবির এই শহরে বনানী থেকে সাতরাস্তা যেতেও দেড় ঘণ্টা লেগে যেতে পারে।
সরকার কাজ করছে। সড়ক প্রশস্ত হচ্ছে। দোতলা/তিনতলা সড়ক হচ্ছে। কিন্তু সড়কে শৃঙ্খলা বাড়ছে না। শৃঙ্খলা না থাকলে সড়কের দৈর্ঘ-প্রস্থ বাড়িয়ে লাভ নেই। বাস্তায় ইচ্ছেমতো এলোপাতাড়ি বাস দাঁড়িয়ে থেকে যাত্রী ওঠালে, কাঁচাবাজার বসালে সেই সড়ক যতোই বড় হোক- লাভ নেই। মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর থেকে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত কিছুটা স্বস্তি এসেছে সত্যি। কিন্তু সড়কে যা ছিল তাই আছে। কাজেই, সড়কে শৃঙ্খলা বাড়াতে হবে। সড়ক পুলিশিং বাড়াতে হবে। সরকারকে কঠোর হতে হবে।
লেখক: আইনজীবী, প্রাবন্ধিক।
এইচআর/এএসএম