অর্থনীতি

প্রকল্প বাস্তবায়নে গাফিলতির মাশুল ৪০ কোটি

দেশে নির্ভরযোগ্য ও ব্যয়সাশ্রয়ী টেলিকমিউনিকেশন সুবিধাদি গড়ে তোলার জন্য একটি প্রকল্প অনুমোদন হয় ২০১৭ সালের জুলাই মাসে। একে একে ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও শেষ হয়নি প্রকল্পের কাজ। যদিও প্রকল্পের মেয়াদ ছিল জুন ২০২০ পর্যন্ত, ৩ বছর। এ মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন না হওয়ায় ডলার কিনতে গচ্চা দিতে হচ্ছে ৪০ কোটি টাকা।

Advertisement

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২০ সালের শেষ দিনেও প্রতি ডলারের দাম ছিল ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা। এখন ডলারের বিনিময় হার ১১৭ টাকা। প্রতি ডলারে বেড়েছে ৩৩ টাকা। প্রকল্পের আইসিটি সংক্রান্ত মালামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হবে। ফলে ডলার কিনতে বাড়তি খরচ করতেই হবে।

এমন ঘটনা ঘটেছে ‘ডিজিটাল সংযোগের জন্য টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক আধুনিকীকরণ ২য় সংশোধিত (প্রস্তাবিত)’ শীর্ষক প্রকল্পে। ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ প্রকল্পের সংশোধনী প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে। সম্প্রতি প্রকল্পের সার্বিক বিষয় নিয়ে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভাও হয়েছে।

পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ানের সভাপতিত্বে পিইসি সভা হয়। এ প্রকল্পে ২০২২ সালে চুক্তি হওয়ার পরও কাজ সম্পন্ন করে অর্থ পরিশোধ কেন বিলম্ব হলো, তা জানতে চেয়েছে কমিশন।

Advertisement

এর জবাবে বিটিসিএল জানায়, চলমান অন্যান্য প্রকল্পের সঙ্গে সমন্বয় করে সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রকল্পের আওতায় ডিডব্লিউডিএম ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক আইপি ও অন্য যন্ত্রপাতির স্কোপ পুনর্নির্ধারণ করা হয়। ফলে নতুন কার্যপরিধি অনুযায়ী যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করতে বেশি সময় প্রয়োজন হয়। এ কারণে অর্থ পরিশোধে বিলম্ব হয়।

আরও পড়ুন

ডলারের দাম বাড়ায় বেশি চাপে আমদানিকারকরা ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ কমে ১৩.২২ বিলিয়ন ডলার

সভায় প্রকল্পের নানান ব্যয় প্রস্তাব নিয়ে প্রশ্নও তোলা হয়েছে। প্রচার ও বিজ্ঞাপন খাতে অতিরিক্ত ৩৫ কোটি এবং কনসালটেন্সি খাতে ৫০ লাখ টাকা প্রকল্প থেকে বাদ দিতে বলেছে কমিশন। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি, প্রকল্পের ঋণ অংশ দ্বারা বাস্তবায়িত সার্ভিস অংশের ভ্যাট-আইটি পরিশোধসহ প্রকল্পের প্রথম সংশোধনের মাধ্যমে গৃহীত পূর্তকাজের অংশ বাদ দেওয়া হয়েছে। কারিগরি নিরীক্ষা সম্পন্ন করার লক্ষ্যে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের জন্য নতুন খাত সংযোজন এবং বিদ্যমান কয়েকটি খাতের ব্যয় কমানো ও বাড়ানো হয়েছে। বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।

ডিজিটাল সংযোগের জন্য টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক আধুনিকীকরণ প্রকল্পের পরিচালক মো. হাফিজুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে সংশোধন করতে হবে। এজন্য আমরা প্রকল্পের প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছি, কমিশন যা সিদ্ধান্ত নেয়। ডলারের মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ খাতে ৪০ কোটি টাকা বাড়বে। কারণ প্রকল্পটি যখন অনুমোদন হয় তখনকার ডলারের রেট আর এখন এক নয়। সঠিক সময়ে বাস্তবায়ন হলে ৪০ কোটি টাকা লাগতো না বলেও স্বীকার করে প্রকল্পের পিডি বলেন, তখন বাস্তবায়ন করলে হয়তো লাগতো না। তবে আমি প্রকল্পে পিডি হিসেবে নতুন নিয়োগ পেয়েছি।

Advertisement

বিটিসিএল থেকে জানা গেছে, প্রকল্পের প্রথম সংশোধিত ডিপিপিতে ৪২টি জেলার টেলিযোগাযোগ সেবা আধুনিকীকরণের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ কাজের চুক্তি হয় মার্চ ২০২২ সালে। তখন এলসি খোলার সময় বৈদেশিক মুদ্রার দাম ছিল ৯৩ টাকা। পরবর্তীসময়ে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধির কারণে প্রয়োজনীয় টেলিযোগাযোগ সরঞ্জামাদি আমদানিতে বাড়তি ব্যয় প্রয়োজন হয়। এজন্য প্রকল্পের দ্বিতীয় সংশোধনী প্রস্তাবে অতিরিক্ত ৪০ কোটি ৪০ লাখ টাকা এ খাতে বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়।

আরও পড়ুন

ডলার সংকট ঠেকাতে এবার অফশোর ব্যাংকিংয়ে তোড়জোড় আরেক দফা বাড়ছে খরচের বোঝা!

সঠিক সময়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ৪০ কোটি টাকা বাড়তি লাগতো না বলে মত দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, টাইম ওভার রান হলে কস্ট ওভার রান হয়। ৪০ কোটি টাকা ডলারের রেটের কারণে বেড়েছে। এটা বেশি হয়েছে। অনেক প্রকল্প তিন বছরে বাস্তবায়ন হওয়ার কথা অথচ সময় বেড়ে ৭ বছর লেগে যায়। টাইম ওভার রান হলে কস্ট বাড়ে। এখন এসব প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে। সঠিক সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। যারা সঠিক সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে না তাদের জবাদিহির আওতায় আনতে হবে। প্রকল্পটি সঠিক সময়ে বাস্তবায়ন হলে ডলারের রেটের কারণে অন্তত ৪০ কোটি টাকা বাড়তো না। বিটিসিএল জানায়, প্রকল্পের অন্যতম কাজ দেশে নির্ভরযোগ্য ও ব্যয়সাশ্রয়ী টেলিকমিউনিকেশন সুবিধা গড়ে তোলা, টেলিডেনসিটি বৃদ্ধিসহ টেলিঅ্যাক্সেস সুবিধা ও ব্রডব্যান্ড অ্যাক্সেস সুবিধা বৃদ্ধি করতে আইসিটি সেবার মানোন্নয়ন ও সম্প্রসারণ।

এ লক্ষ্যে প্রকল্পের মূল কার্যক্রম হলো আইএমএস প্ল্যাটফর্ম ও অপটিক্যাল ট্রান্সপোর্ট নেটওয়ার্ক স্থাপন, ওএফসির জন্য ওএসপি ওয়ার্ক, বিটিসিএলের আইপি নেটওয়ার্ক স্থাপন এবং অপারেশন ও রক্ষাণাবেক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন, প্রশিক্ষণ ও কারিগরি জ্ঞান দেওয়া। কেন্দ্রীয়ভাবে নেটওয়ার্ক মনিটরের জন্য আধুনিক বস (বিজনেস অপারেশন সাপোর্ট সিস্টেম) স্থাপন। ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের আওতায় বিটিসিএল বাস্তবায়নাধীন মূল প্রকল্পটি ২০২৭ সালে অনুষ্ঠিত একনেক সভায় মোট ২ হাজার ৫৭৩ কোটি ৩৯ লাখ ৫৬ হাজার টাকা ব্যয়ে অনুমোদন হয়। এর মধ্যে সরকারি ব্যয় ৭৫৬ কোটি ১১ লাখ ও প্রকল্প ঋণ ১ হাজার ৮১৭ কোটি ২৪ লাখ টাকা।

আরও পড়ুন

ঋণের সুদহার আর খুব বেশি বাড়বে না: গভর্নর বৈদেশিক মুদ্রা ‘চুরি করতে’ ব্যাংককর্মীদের সার্ভার ডাউন নাটক

৪২টি জেলা সদরে অপটিক্যাল ফাইবারভিত্তিক ভয়েস ও ডাটা সেবা গিগাবাইট প্যাসিভ অপটিক্যাল নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের জন্য প্রকল্পের জিওবি অংশের ব্যয় ৭৪১ কোটি ৫৪ লাখ টাকা এবং বাস্তবায়ন মেয়াদকাল জুন ২০২২ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে ১ম সংশোধনী ২০২০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত একনেক সভায় অনুমোদিত হয়। পরবর্তীসময়ে ব্যয় বৃদ্ধি ব্যতিরেকে প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর করে মোট দুবারের মতো জুন ২০২৪ পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়। বর্তমানে ২২৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ব্যয় কমিয়ে মোট ৩ হাজার ৮৫ কোটি ৪৯ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হচ্ছে। তবে প্রকল্পের মাঝপথে ব্যয় কিছুটা কমলেও মূল প্রকল্প থেকে বর্তমানে প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধির পার্থক্য ৫১২ কোটি টাকা। জুলাই ২০১৭ থেকে জুন ২০২৪ পর্যন্ত মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য দ্বিতীয়বার সংশোধনী প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। বিটিসিএল জানায়, প্রকল্পের আওতায় বিটিসিএলের উপজেলা পর্যায়ে ২৮৮টি স্থাপনায় (অনাবাসিক ভবন) সীমানা প্রাচীর নির্মাণ কাজের জন্য ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছিল ১২০ কোটি ৭১ লাখ টাকা। প্রকল্পের মেয়াদে বিটিসিএলের নামে জমির নামজারি করা এবং সঠিকভাবে জমির পরিমাপ ও সীমানা নির্ধারণ নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ফলে প্রকল্পের দ্বিতীয় সংশোধনী প্রস্তাবে পূর্তকাজের ব্যয় বাবদ ১২০ কোটি ৭১ লাখ টাকা বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।

পরিকল্পনা কমিশন জানায়, বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্প অডিট অধিদপ্তর থেকে প্রকল্প ঋণ দিয়ে বাস্তবায়িত সার্ভিস অংশের ডিজাইন, ইন্সটলেশন, টেস্টিং, কমিশনিং ইত্যাদির জন্য ভ্যাট-আইটি বাবদ ব্যয়ের সংস্থান মূল ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) ছিল না। ফলে ডিপিপি সংশোধন করে সার্ভিস অংশের ভ্যাট-আইটি পরিশোধের জন্য সুপারিশ করা হয়। গাইডলাইন ও ডলারের বিনিময় হার বিবেচনা করে সংশোধিত ডিপিপিতে ১৫০ কোটি টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় ভয়েস ও ইন্টারনেট সেবা গিগাবাইট প্যাসিভ অপটিক্যাল নেটওয়ার্ক জনগণের মাঝে ব্যাপক প্রচারের প্রয়োজন রয়েছে। এজন্য ভয়েস ও ইন্টারনেট সেবা এবং অন্যান্য সার্ভিসের (ডোমেইন সেবা, আলাপ অ্যাপ, অপটিক্যাল ফাইবার লিজ ইত্যাদি) মার্কেটিংয়ের নিমিত্তে প্রচার ও বিজ্ঞাপন খাতে অতিরিক্ত ৩৫ লাখ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ৭০ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পের কিছু খাতের ব্যয় নিয়ে বিস্তারিত জানতে চেয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। কমিশন জানায়, প্রকল্পের আওতায় বেতন বাবদ অতিরিক্ত ২০ লাখ এবং আপ্যায়ন খাতে অতিরিক্ত ৩ লাখ টাকা ব্যয়বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া, কনসালটেন্সি খাতে অতিরিক্ত ৫০ লাখ টাকা রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।

তবে কিছু খাতে ব্যয় কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। যেমন- প্রকল্পের আওতায় সম্মানী বাবদ ৫ লাখ, বিদ্যুৎ বাবদ ১০ লাখ, মেশিন ও সরঞ্জামাদি ভাড়া বাবদ ১৫ লাখ, বইপত্র ও সাময়িকী বাবদ ৫০ হাজার টাকার অতিরিক্ত প্রস্তাব করা হয়েছে। অনুলিপি ব্যয় বাবদ ৫ লাখ, ব্যাংক চার্জ ১ কোটি ৫০ লাখ ৬৪ হাজার, কমিশন বাবদ দেড় কোটি, অভ্যন্তরীণ ভ্রমণ ব্যয় বাবদ ৬০ লাখ, কম্পিউটার সামগ্রী বাবদ ১৮ লাখ, স্ট্যাম্প ও সিল বাবদ ৫ লাখ ২০ হাজার টাকা কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। মোট ৩০০ কোটি ২০ লাখ টাকা কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।

পরিকল্পনা কমিশনে অনুষ্ঠিত পিইসি সভায় প্রকল্পের কিছু ব্যয় প্রস্তাব বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে ডলারের রেট বৃদ্ধির কারণে চাওয়া বাড়তি প্রস্তাবে সায় দিয়েছে কমিশন। একই সঙ্গে প্রকল্প সঠিক সময়ে বাস্তবায়নের তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, প্রকল্পটি নিয়ে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভা করেছি। সভায় আমরা কিছু খাতের ব্যয় বাদ দিয়েছি। তবে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাড়তি বরাদ্দ দেওয়া হবে। কারণ এ বরাদ্দ না দিলে প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না।

সঠিক মেয়াদে প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে বাড়তি বরাদ্দ লাগতো না জানিয়ে সচিব বলেন, আমরা সব মিটিংয়ে সংশ্লিষ্টদের তাগিদ দেই সঠিক সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য। কারণ সঠিক সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে অনেক খরচ কমে যায়। একইভাবে এ প্রকল্পেও বাড়তি ব্যয় লাগতো না।

এমওএস/এমএইচআর/এএসএম