পাভেলের হাতে আপাতত অনেকগুলো কাজ।সবগুলোই গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে তার। কোনটা রেখে কোনটা করবে সেটাই ভাবছে সে। আসলে কোনোটাই ফেলে রাখা যাবে না। করতে হবে সবগুলোই। আচ্ছা কী কী কাজ হাতে আছে তার, সেই লিস্ট আগে দেওয়া যাক। তারপর না হয় ঠিক করা যাবে, আগে-পরের সিরিয়াল। চাইলে আপনারাও সিরিয়ালটা করে দিতে পারেন। বলছি, কী কী কাজ জমা হয়ে আছে পাভেলের।১. একটা সিনেমা অর্ধেক দেখে ফেলে রেখেছে। বাকিটা দেখতে হবে।২. একটা বই অর্ধেক পড়া আছে, বাকিটা শেষ করতে হবে।৩. অনেক দিন ধরে একটা বই খুঁজছিল। সেটা হাতে এসেছে। সেই বইটা পড়তে হবে।৪. একটা গবেষণার কাজে বরিশাল গিয়েছিল। সংগ্রহ করে আনা তথ্যগুলো বিন্যাস করা দরকার।৫. বিকেলে একজন পরিচালক আসবেন। তার সঙ্গে স্ক্রিপ্ট নিয়ে মিটিং আছে। তার আগে স্ক্রিপ্টটা একটু দেখা দরকার।৬. একটা সরকারি অফিস তাকে কনসালটেন্ট হিসেবে নিয়োগ দিতে চায়। সে বিষয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলা দরকার।৭. কাল সন্ধ্যা থেকে রাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে। রাই কোনো পাত্তা দিচ্ছে না। রাইয়ের খোঁজ বের করা দরকার।জানি, উপরের কাজগুলোর বেশিরভাগই আপনাদের কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু বিশ্বাস করেন প্লিজ, এগুলোই পাভেলের ভীষণ ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আসলে গুরুত্ব জিনিসটাই আপেক্ষিক। কারণ একই জিনিস হয়তো কারো কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ আবার কারো কাছে একেবারেই গুরুত্বহীন।
Advertisement
সে যা-ই হোক। আজকের সমস্যা সেটা নয়। পাভেল চাইলে উপরের সাতটা কাজের মধ্যে যে কোনোটাই শুরু করতে পারে। কিন্তু সমস্যা হলো সব ছাপিয়ে পাভেলের মাথায় ভর করেছে অন্য একটা জিনিস। তার মাথায় ঘুরেফিরে কেবলই আসছে জয়ন্তদার কথা। জয়ন্ত ভদ্রের সঙ্গে কালকেই তার পরিচয় হয়েছে। অল্প কিছুটা সময় তার সঙ্গে ছিল পাভেল। টুকটাক কেজো কথা হয়েছে তার সঙ্গে। ওই যে বলছিলাম, একটা গবেষণার কাজে বরিশালে গিয়েছিল, সেখানেই জয়ন্তদার সঙ্গে পরিচয়। গ্রামের নিতান্তই সাধারণ মানুষ। বিশেষত্বহীন চেহারা। রোদে পোড়া কালো কুচকুচে শরীর। মাথায় চুল একেবারেই নেই। অল্প যে কয়টা দুই কানের পাশের দিকে এবং ঘাড়ের দিকে ঝুলে আছে সেগুলোতেও কালোর চেয়ে রুপালি ঝিলিক বেশি। কালকে তার সঙ্গে যখন কথা হয়, তখনো বিশেষ কিছু মনে হয়নি তার জয়ন্ত ভদ্রকে। কিন্তু এখন কেন জানি খুব করে তার কথা মনে পড়ছে। কেন বারবার ঘুরেফিরে জয়ন্ত ভদ্রকে মনে পড়ছে, বিষয়টা ভেবে বের করার চেষ্টা করছে পাভেল।
জয়ন্ত ভদ্র চিরকুমার, এটা কি কোনো কারণ হতে পারে? আবার ভাবছে পাভেল, একটা মাঝবয়সী লোক চিরকুমার–এটা তো অস্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়। সুতরাং এ কারণে তাকে মনে পড়বে–এমনটা হতে পাবে না। আরেকটা বিষয় মনে পড়ছে। জয়ন্তদা বলেছিলেন কাল, তার মা খুব আগুন ভয় পেতেন। একদিন বলেছিলেন, আমি মরে গেলে আমাকে পোড়াবি না জয়ন্ত। ২০০৫ সালে ১০২ বছর বয়সে তার মা মারা গেলে জয়ন্ত সবাইকে বলেছিলেন, মা বলে গেছেন তাকে যেন আগুনে পোড়ানো না হয়! জয়ন্তর কথা শুনে সবাই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। এ কেমন কথা? এটা কি কোনো দিন সম্ভব?
আচ্ছা এসব বাদ। জয়ন্ত ভদ্রের সঙ্গে পাভেলের কিভাবে পরিচয় হলো, সেটা বরং বলা যাক। আগেই বলেছি, গবেষণার জন্য মাঠ পর্যায়ের কিছু সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য বরিশাল গিয়েছিল সে। তো, ভোর ছয়টায় ঢাকা থেকে রওয়ানা দিয়ে সকাল পৌনে নয়টার দিকে গৌরনদী পৌঁছায় পাভেল। গৌরনদী বাসস্ট্যান্ডে তার জন্য অপেক্ষা করছিল তার ইউনিভার্সিটি জীবনের বন্ধু প্রশান্ত। একটু পরপর ফোনে তাড়া দিচ্ছিল প্রশান্ত–কতদূর? আর কতদূর। বলে যাচ্ছিল পাভেল–মাওয়া পার হচ্ছি... এই তো ভাঙ্গা আছি... মাদারীপুর রাজৈর... মকসুদপুর... মোস্তফাপুর।- ওহ মোস্তফাপুর? তাইলে চলে আসছো দোস্ত! আমি আছি বাসস্ট্যান্ডে।
Advertisement
গৌরনদী বাসস্ট্যান্ডে এসে হঠাৎ খুব জোরে ব্রেক করে শাহীন। আর সামনের দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে পাভেল। সামলে নিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখে বত্রিশ দাঁত বের করে হাসছে প্রশান্ত। এমন উজবুকের মতো কেউ গাড়ির সামনে দাঁড়ায়? ইচ্ছে করে প্রশান্তকে কষে একটা ধমক লাগায়। কিন্তু সেটা না করে পাভেলও বত্রিশ দাঁত বের করে হাসে। তবে তার হাসিটা ঠিক জমে না। কারণ ক্ষুধায় পেটের নাড়িভুঁড়ি গোলাচ্ছে তার।- দোস্ত চল কোথাও নাস্তা করি। ক্ষুধায় পেট চো চো করছে আমার।- নাহ, এখানে নাস্তা করা লাগবে না! আমাদের জন্য এক জায়গায় নাস্তা রেডি করা আছে।- কী বলিস? কোথায় নাস্তা রেডি আছে? এসব করতে দিলি ক্যান তুই?- আরেহ আমি দিতে চাই নাই। জোর করে করেছে। মানা তো করতে পারি না!মনে মনে কিছুটা বিরক্ত লাগে পাভেলের। বুঝতে দেয় না প্রশান্তকে।- চল তাহলে একটু চা খেয়ে নিই।রাস্তার পাশেই একটা চায়ের দোকানে বসে সেখানে ডাব বিক্রি হতে দেখে তারা। দুজন দুটো ডাব খেয়ে উঠে বসে গাড়িতে।- কোথায় যাচ্ছি আমরা?- যাবো আগৈলঝাড়ার দিকে।
গৌরনদী থেকে আগৈলঝাড়া খুব বেশি পথ নয়। পথে পথে যেতে যেতে নানান কিছু দেখায় প্রশান্ত। ধারা বর্ণনার মতো বলতে থাকে এলাকার ইতিহাস। হাতের বাঁয়ে একটা স্কুল দেখিয়ে বলে এটির নাম ভেগাই হালদার পাবলিক একাডেমি। মতুয়া মতাদর্শের প্রবক্তা গুরুচাঁদ ঠাকুরের একনিষ্ঠ শিষ্য ছিলেন ভেগাই হালদার। ১৯১৯ সালে গুরুর নির্দেশে এই স্কুল স্থাপন করে তিনি। অথচ ভেগাই হালদার নিজে কিন্তু পড়াশোনা জানতেন না। প্রথমে এটি ছিল শিশুদের জন্য পাঠশালা। পরে ধীরে ধীরে বড় হতে হতে এখন এই পর্যায়ে এসেছে। প্রশান্তর কথা শুনে গাড়ির জানালা দিয়ে স্কুলের দিকে তাকায় পাভেল। কাঁচের ভেতর থেকে চোখে পড়ে ইটের দেওয়াল ঘেরা বড় একটা মাঠ ঘিরে চারপাশে স্কুল বাড়ি। কোনো ভবন দোতলা। কোনোটা একতলা। স্কুলে তখন হয়তো ক্লাস চলছিল। কারণ ভবনের জানালা দিয়ে ভেতরে ছাত্র-শিক্ষকদের দেখা যাচ্ছিল। চোখ ধাঁধানো রোদের মধ্যে গর্বিত মাথা তুলে পতপত করে উড়ছিল জাতীয় পতাকা। পথ চলতি গতিতে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে এতটুকুই দেখতে পারে পাভেল।গাড়ি এগিয়ে চলে। কথা এগিয়ে চলে প্রশান্তরও। - বুঝলা দোস্ত, মনসা মঙ্গলের কবি বিজয় গুপ্তের বাড়ি কিন্তু এখানে!- তাই নাকি? কোথায়?- এই তো কাছেই। একটা মনসা মন্দিরও আছে এখানে। যাবি নাকি?- নাহ, আজকে থাক। যে কাজে এসেছি, আগে সেটা শেষ করি।
আগৈলঝাড়া সদরে পৌঁছে কাকে যেন ফোন দেয় প্রশান্ত। তারা বসে একটা চায়ের দোকানে। খানিক সময় পর হন্তদন্ত হয়ে আসে একজন বয়সী মানুষ। দীনেশ হালদার অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক। তার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই হাজির হোন আরেকজন। সত্যানন্দ মজুমদার। তিনিও এক সময় স্কুলে পড়াতেন। বয়স জিজ্ঞেস করলে জানান–একাশি। কিছুটা অবাক লাগে পাভেলের। সত্যানন্দ মজুমদারকে কিছুতেই ৫৫-৬০’র বেশি মনে হয় না পাভেলের। কথা চলতে থাকে তাদের মধ্যে। চায়ের পর চা চলতে থাকে। ঘণ্টাখানেক কিংবা আরও বেশি সময় যায় এখানে।
এরপর আবার গাড়িতে ওঠে তারা। উদ্দেশ্য পূর্ব গোয়াইল গ্রাম। আগৈলঝাড়া থেকে উত্তরমুখি রাস্তা ধরে কয়েক কিলোমিটার গেলে বাশাইল বাজার। বাশাইল বাজার থেকে হাতের ডানের রাস্তা ধরে আরও খানিকটা গেলে পূর্ব গোয়াইল গ্রাম। এমন নির্দেশনা নিয়ে পথ চলতে শুরু করে তারা। পথে যেতে যেতে গাড়ি থামিয়ে এর তার কাছে ঠিকানা জানার চেষ্টা করছে প্রশান্ত। বোঝা যায় এই এলাকাটা খুব একটা পরিচিত নয় তার। বাশাইল বাজার পর্যন্ত ঠিকঠাক গেলেও এরপর যেতে যেতে পথ ভুল হয়ে যায় তাদের। গাড়ি নিয়ে যেখানে পৌঁছায় সেই জায়গার নাম ছোট বাশাইল। কিন্তু পূর্ব গোয়াইল কোন দিকে? লোকজনের কাছে জিজ্ঞেস করে যে পথের খোঁজ পায়, সেদিকে গাড়ি যাবে না। গাড়ি ছেড়ে একটা ভ্যানে ওঠে তারা। যাকেই জিজ্ঞেস করে, সবার উত্তর ওই তো দেখা যায় পূর্ব গোয়াইল। একটু হাঁটলেই পেয়ে যাবেন। অবশেষে তিন সাড়ে তিন কিলোমিটার ভ্যানযাত্রার পর এক তিন মাথার মোড়ে দেখা মেলে ছোট্ট এক ঝুপড়ি দোকানের। সেখানে ভ্যান ছেড়ে দিয়ে তপন ভদ্রের বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করলে বিস্তৃত ধানক্ষেতের দিকে আঙুল তুলে অনেক দূরে গাছপালা ঘেরা জনবসতির দিকে নির্দেশ করে একজন বয়স্ক মানুষ বলেন–ওই তো দেখা যায়। পাগলা ঘোড়ার মতো তেজি গরমে রোদে পুড়তে থাকা মাঠের দিকে বিস্ময় লাগা চোখে তাকিয়ে থাকে পাভেল। মিনমিনে গলায় প্রশান্ত বলে–দোস্ত এই গরমে পারবি তো এতদূর হাঁটতে?পাভেল একবার ভাবে বলবে, পারবো না বললে তুই কী কিরবি? বাড়িটা এখানে নিয়ে আসবি? কিন্তু মনের কথা মনেই রাখে। তার বদলে প্রশান্তর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসে। নিজের অভিনয়ে নিজেরই অবাক লাগে তার।- ধুর ব্যাটা, না পারার কী আছে? চল!এমন সময় বয়স্ক লোকটা বলেন–তপন তো একটু আগেই ছিল এখানে!- ওই তো তপন কাকা আইতেয়াসে। কিশোর ছেলেটার কথা অনুসরণ করে সামনের দিকে তাকায় সবাই।
Advertisement
চোখে পড়ে নীল রঙের ফুলহাতা শার্ট পরে ছুটতে ছুটতে আসছেন ছোটখাটো গড়নের মাঝবয়সী একটা লোক। কাছে এলে পাভেল দেখতে পায় মানুষটার ঘামে চকচকে মুখে মেছতার দাগ। প্রশান্তকে দেখে হাতজোড় করে নমস্কার বলে এগিয়ে আসেন তপন ভদ্র। বয়সে বড় মানুষটা পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেন প্রশান্তকে। পাভেলকে দেখিয়ে প্রশান্ত বলে– দাদা আমার বন্ধু পাভেল। ঢাকা থেকে আসছে। ওর কথাই বলেছিলাম আপনাকে। নমস্কার বলে হাত তোলেন তপন ভদ্র। পাভেলও হাতজোড় করে নমস্কার জানায়। এবারে প্রশান্তর মতো পাভেলকেও পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে এগিয়ে আসেন তপন ভদ্র। লাফ দিয়ে সরে যায় পাভেল। তপন ভদ্রর হাতদুটো ধরে তাকে বুকিয়ে জড়িয়ে নেয় সে।
রাস্তার পাশের দোকানটাতে বসেই তপন ভদ্রের সঙ্গে কথা বলতে চায় পাভেল। কিন্তু তপন ভদ্র নাছোড়। যেতেই হবে তার বাড়িতে। তার জোরাজুরিতে শেষ পর্যন্ত মধ্য এপ্রিলের ভয়ংকর রোদ মাথায় নিয়ে মাঠে নামে পাভেল এবং প্রশান্ত। তাপমাত্রার পারদ তখন চুয়াল্লিশ! নাকি আরও বেশি, কে জানে? মূলরাস্তা থেকে নেমে নিচু ধানের ক্ষেতের আইল ধরে আগায় তারা। আদতে নিচু ভূমিটা একটা বিল। বর্ষা এলেই জলমগ্ন থাকে মাঠটা। তখন ছোট কোষা নৌকা দিয়ে পারাপার এলাকার মানুষের। এখন এই তালুফাঁটা রোদে ধানক্ষেতের আইল ধরে হাঁটে তারা। শক্ত শাদা এঁটেল মাটি রোদে ফেটে চৌচির। মাটিতে বড় বড় ফাটল। তার ওপর বেশ উঁচ-নিচু রাস্তা। হাঁটতে গিয়ে এদিক সেদিক হোঁচট খায় পাভেল। কিন্তু তপন হাঁটছেন খুব দ্রুত। হাঁটছেন বললে হয় না, তিনি দৌড়ের মতো করে ছুটছেন। তার সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে হিমশিম খায় পাভেল। তবুও হাঁটার গতি থামায় না সে। প্রায় মাইলখানেক পথ গনগনে সূর্য মাথায় নিয়ে হাঁটার পর তপন ভদ্রের বাহির বাড়ির উঠোনে পৌঁছান তারা। বাড়ির বাইরে খোলা উঠোনে সোনালি ধানের খড়, বিছিয়ে আছে পুরোটা জুড়ে। খড় থেকে কাঁচা ধানের মৌ মৌ গন্ধ নাকে এসে লাগে। বাড়ির আশপাশে অনেক গাছপালা। বেশিরভাগই আম গাছ। প্রায় সব গাছেই ঝুলছে এখনো পরিপক্ব না হওয়া কাঁচা আম। কিছু গাছ এতই নিচু, হাঁটতে মাথায় গালে মুখে আমের ছোঁয়া লাগে। বাড়ির ভেতরের উঠোনজুড়ে ছড়ানো ধান। শুকোতে দেওয়া হয়েছে। বারান্দার ছায়ায় লম্বা বাঁশের কঞ্চি হাতে বসে আছেন একজন বয়স্ক নারী। তাকে পাশ কাটিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে যান তপন। পাভেলরা দাঁড়িয়ে থাকে উঠোনে। ভেতর থেকে তাড়া দেন তপন।- ভেতরে আসুন দাদা।প্রথমে ঘরে ঢোকে প্রশান্ত। পেছন পেছন পাভেল। ঘরে ঢুকে কথার ঝাপি খুলে বসেন তপন। আর একটু সময় পর আসেন কালো পেটানো শরীরের একজন মানুষ। পরিচয় করিয়ে দেন তপন।- আমার দাদা, জয়ন্ত ভদ্র।
জয়ন্ত ভদ্র কিছু বলার আগেই তাকে হাতজোড় করে নমস্কার জানায় পাভেল। এরপর তার সঙ্গে কথা হয় টুকটাক। তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনো কথা নয়। তীব্র গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা। প্রায় সারাদিনই লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ হওয়া। এবারে ধানের ফলন খুব ভালো হয়েছে। প্রায় আটষট্টি বছর বয়সেও কেন জয়ন্ত দা বিয়ে করেননি। তার মায়ের মৃত্যু। মৃত্যুর আগে অগ্নিদাহ না করার বিষয়ে তার মায়ের দিব্যি দিয়ে যাওয়া। এসব নানা বিষয় নিয়েই আলাপ হয়। কেজো কথা যা হওয়ার তপন ভদ্রের সঙ্গেই হয়েছে। শুধু চলে আসার সময় জয়ন্ত দা বলেছিলেন–আবার কবে দেখা হবে আপনার সঙ্গে? জয়ন্ত ভদ্র এত আপন সুরে কথাটি বলেছিলেন, যেন কিছুদিন পরে পরেই পাভেলের সঙ্গে দেখা হয় তার! অথচ আজকেই তার সঙ্গে প্রথম দেখা। আবার কখনো দেখা না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি! তবু তিনি এত মায়াময় স্বরে কথাটা বলেছেন, বুকের কোথায় যেন খুব করে দাগ কেটেছে পাভেলের।
সেখান থেকে বের হয়ে আবারও হেঁটে মাঠ পাড়ি দিয়ে ভ্যানে চড়ে গাড়ির কাছে এসেছে একইভাবে। এরপর একে একে তারা গিয়েছে আগৈলঝাড়ারই বাগধা ইউনিয়ের আশকর গ্রামে। গিয়েছে বাটাজোরের দেওপাড়া গ্রামে। সেখান থেকে উজিরপুরের হারতা। সবশেষ বরিশাল শহরে। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা ছোঁয়ার একটু আগে বরিশাল থেকে ঢাকার দিকে ফিরতে থাকে পাভেল। পথে গৌরনদীতে প্রশান্তকে নামিয়ে দেওয়ার সময় খুব আবেগী হয়ে পড়ে দুজনই। - দোস্ত আবার কবে তোর সঙ্গে দেখা হবে?গাঢ় স্বরে জিজ্ঞেস করে প্রশান্ত।পাভেল কিছুই বলে না। শুধু গভীর করে বুকে জড়িয়ে ধরে প্রশান্তকে। আর মুচকি হেসে বলে, ভালো থাকিস বন্ধু।বরিশাল থেকে ফিরে এরপর নানান কাজে জড়িয়ে যায় পাভেল। কিন্তু সব ছাপিয়ে আজ এই ভর সকালে কেন জয়ন্ত ভদ্রর কথা খুব করে মনে পড়ছে তার? মানুষের মন আসলেই বড় বিচিত্র!
এসইউ/এমএস