শ্বাসকষ্টজনিত দীর্ঘমেয়াদী বিভিন্ন রোগের সমস্যায় ইনহেলার ব্যবহারের পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে অ্যাজমা, ক্রোনিক ব্রোঙ্কাইটিস, এমফাইসেমা ইত্যাদিসহ শ্বাসকষ্টজনিত রোগের ক্ষেত্রে বয়স নির্বিশেষে শিশু কিংবা বয়ষ্ক সব রোগীর চিকিৎসায় ইনহেলার ব্যবহার করতে বলা হয়।
Advertisement
এটি পাফার বা পাম্প নামেও পরিচিত। এটি কিন্তু কোনো ওষুধ নয়, বরং মানবদেহের শ্বাসযন্ত্রে সরাসরি সালবিউটামল, ইপ্রাট্রোপিয়াম, স্টেরয়েড ইত্যাদি বিভিন্ন ওষুধ প্রয়োগের একটি মাধ্যম। হাঁপানি বা অন্যান্য শ্বাসকষ্টজনিত রোগের চিকিৎসার সাফল্য সঠিক ওষুধের পাশাপাশি ইনহেলারের ব্যবহারবিধি সঠিকভাবে অনুসরণের ওপরও বহুলাংশে নির্ভর করে।
অনেকেই অভিযোগ করেন, ইনহেলার ব্যবহার করে কোনো উপকার হচ্ছে না কিংবা ঘন ঘন ইনহেলার নিতে হচ্ছে। আসলে সঠিক নিয়মে ইনহেলার ব্যবহার না করা এর অন্যতম কারণ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে অনেকেই ইনহেলার সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারেন না।
সমীক্ষায় দেখা যায় যে, প্রায় এক তৃতীয়াংশ ব্যবহারকারী ভুল নিয়মে ইনহেলার ব্যবহার করেন। ভুল নিয়মে ইনহেলার ব্যবহারের কারণে প্রায় ৯০ শতাংশ অ্যারোসল ওষুধই মুখগহ্বরে থেকে যায়। ফলে অনেক রোগীকেই ঘন ঘন ইনহেলার নিতে হয়। এজন্য সঠিক মাত্রায় সঠিক ওষুধ প্রয়োগের পরও অনেক ক্ষেত্রেই হাঁপানির মতো রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয় না।
Advertisement
অনেকেই ইনহেলারের কথা শুনলে বেশ ভয় পেয়ে যান। ইনহেলার নিয়ে বিভিন্ন ধরণের ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত আছে, যেমন- ইনহেলার ব্যবহার করলে নেশা হয়ে যায়, ওষুধ ভালো কাজ করে না, সারাজীবন ব্যবহার করতে হয় ইত্যাদি। তবে মনে রাখা জরুরি, মুখে খাবার ওষুধের চেয়ে ইনহেলারই বেশি নিরাপদ।
যেহেতু ইনহেলারের মাধ্যমে ওষুধ সরাসরি অ্যারোসল আকারে শ্বাসযন্ত্রে প্রয়োগ করা হয়, এজন্য ওষুধ ফুসফুসেই বেশিরভাগ অংশ যায়, রক্তে খুব একটা মেশে না। এজন্য একই ওষুধ মুখে খাওয়া ও ইনহেলারের মাধ্যমে নিলে ইনহেলার প্রয়োগের ক্ষেত্রে ওষুধের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া অনেক কম হয় ও কার্যক্ষমতা অনেক বেশি হয়।
বিভিন্ন ধরনের ইনহেলার বাজারে প্রচলিত আছে যেমন- প্রেসারাইজড মিটার ডোজ ইনহেলার বা পাম্প ইনহেলার (এমডিআই), ড্রাই পাউডার ইনহেলার (ডিপিআই), ব্রেথ একচুয়েটেড ইনহেলার (বিএআই) ইত্যাদি। এদের মধ্যে এমডিআই সবচেয়ে বেশি প্রচলিত।
মিটার ডোজ ইনহেলারের সাহায্যে আরও অত্যাধুনিক ডিভাইস সংযুক্ত করে এর ব্যবহারকে আরো সহজ করা যায়, যেমন- সিনক্রোব্রিথ, জেরোস্ট্যাট ভিটি স্পেসার, মিনাইজারস্ট্যাট স্পেসার, বেবি মাস্ক, হাফ পাফ কিট ইত্যাদি। এদের মধ্যে আবার স্পেসার বহুল ব্যবহৃত ডিভাইস।
Advertisement
এমডিআই এর মতো ডিপিআই এর সঙ্গেও রিভোলাইজার, রোটাহেলার ইত্যাদি বিভিন্ন ডিভাইস ব্যবহার করে একে স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যবহার করা যায়। তবে যে ধরনেরই ইনহেলার হোক না কেনো- তার মূল ব্যবহার ও প্রয়োগবিধি কমবেশি একই রকমের।
আরও পড়ুননেবুলাইজার কেন ব্যবহার করা হয়?ডেঙ্গু থেকে সুস্থ হতে কী কী সুপারফুড খাবেন?মিটার ডোজ ইনহেলারের বিভিন্ন অংশ থাকে যেমন- ক্যানিস্টার, একচুয়েটর, মাউথ পিস, ক্যাপ বা কভার ইত্যাদি। এর বিভিন্ন অংশের বিভিন্ন কাজ। ইনহেলারের উপরের দিকের ধাতব অংশটিকে বলা হয় ক্যানিস্টার, আর যেই অংশ থেকে গ্যাস নিঃসরণ হয় সেটি মাউথ পিস। মাউথ পিসটি ক্যাপ দিয়ে আটকানো থাকে।
সঠিক ইনহেলার প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রথমে অন্তত ৬ বার ভালোভাবে ইনহেলারটি ঝাঁকিয়ে নিতে হবে। এরপর মুখের ঢাকনা খুলে ইনহেলারটি খাড়া করে মুখ থেকে ১-২ ইঞ্চি দূরে রাখতে হবে। ইনহেলারটি যদি নতুন বা অধিক বিরতিতে ব্যবহৃত হয়, তাহলে পরীক্ষামূলকভাবে একবার চাপ দিয়ে বাতাস বের করে দিতে হবে।
এবার মাথাটা একটু পেছনে হেলিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে ফুসফুস থেকে সব বাতাস বের করে দিতে হবে। ইনহেলারটি সোজাভাবে ধরে ক্যানিস্টারে চাপ দিয়ে ধীরে ধীরে লম্বা শ্বাসের সাহায্যে ওষুধ ফুসফুসে টেনে অন্তত ১০ সেকেন্ড দম বন্ধ করে রেখে ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে হবে।
ইনহেলারটি এমনভাবে মুখে নিতে হবে, যেন মুখ ও ইনহেলারের মধ্যে কোনো ফাঁকা না থাকে। দ্রুত ও খুব জোরে টান দেওয়া যাবে না। না হলে বেশিরভাগ ওষুধ ফুসফুসে প্রবেশ না করে মুখে লেগে থাকবে। এবার মিনিটখানেক স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার পর একইভাবে আরেকটি পাফ নিতে হবে।
ব্যবহারের পর ইনহেলারের মুখ পরিষ্কার করে মাউথপিসটি গরম পানি দিয়ে ধুয়ে ক্যাপ লাগিয়ে রাখতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যে, ক্যানিস্টার লাগানোর আগে মাউথপিসে যেন কোনো পানি না থাকে। ইনহেলার ব্যবহারের পর ভালো করে কুলি করে মুখ, জিহ্বা পরিষ্কার করে নিতে হবে।
অপেক্ষাকৃত শীতল ও শুষ্ক জায়গায় ইনহেলারটি সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। এক বছরের বেশি একই ইনহেলার ব্যবহার করা উচিত নয়। ইনহেলার ব্যবহারের পর কতটুকু ওষুধ অবশিষ্ট আছে ও আরও কতদিন ব্যবহার করা যাবে, তা দেখার কিছু সহজ উপায় আছে।
ইনহেলারের ধাতব ক্যানিস্টারটি খুলে নিয়ে পানিতে ছেড়ে দিলে যতটুকু খাড়াভাবে ডুবে যাবে, বুঝতে হবে ওষুধ ঠিক ততটুকুই আছে। যদি সম্পূর্ণ ক্যানিস্টার পানির ওপর ভাসতে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে ইনহেলারে আর কোনো ওষুধ অবশিষ্ট নেই।
যেসব রোগী ইনহেলারের মাধ্যমে ওষুধ নিতে পারেন না বিশেষ করে ৫ বছরের কম বয়সী শিশু বা কেউ হঠাৎ মাঝারি বা তীব্র মাত্রার অ্যাজমায় আক্রান্ত হলে ইনহেলারের সঙ্গে স্পেসার ব্যবহার করে ভালো ফল পাওয়া যায়। স্পেসার প্লাস্টিকের একটি ফাঁপা চোঙাবিশেষ, যার একপ্রান্তে ইনহেলার লাগিয়ে অপর প্রান্ত দিয়ে শ্বাসের সঙ্গে ওষুধ গ্রহণ করা হয়।
স্পেসার ইনহেলারের ওষুধকে পর্যাপ্ত সময় পর্যন্ত ধরে রাখে, ফলে রোগী ধীরে ধীরে গভীর শ্বাস গ্রহণের মাধ্যমে ওষুধ সহজেই শ্বাসনালিতে গ্রহণ করতে সক্ষম হয়। ইনহেলারের সঙ্গে স্পেসার ব্যবহার করলে এর মাধ্যমে সরাসরি শ্বাসনালিতে প্রয়োগকৃত ওষুধ নষ্ট কম হয়।
স্পেসারের মাধ্যমে প্রয়োগকৃত ওষুধ খুব কম পরিমাণে মুখ, গলা ও খাদ্যনালিতে লেগে থাকে বলে ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া যেমন- কাশি, গলায় ও মুখে ফাঙ্গাসের সংক্রমণ ইত্যাদি কম হয়। স্পেসার ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রথমে ইনহেলারটি ঝাঁকিয়ে নিয়ে ইনহেলারটির মুখ স্পেসারের নির্দিষ্ট স্থানে লাগাতে হবে।
এরপর ইনহেলারটি একবার চাপ দিয়ে ওষুধ স্পেসারের ভেতরের ফাঁকা অংশে প্রবেশ করিয়ে ঝাঁকাতে হবে ও অপর প্রান্তে মুখ লাগিয়ে ধীরে ধীরে বুক ভরে শ্বাস নিতে হবে। ওষুধ স্পেসারে প্রবেশ করানোর ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে শ্বাস নিলেই চলে।
৫-১০ সেকেন্ড শ্বাস বন্ধ রেখে একইভাবে পুনরায় ২ বা ৩ বার শ্বাস নিতে হবে। ব্যবহারের পর স্পেসারটি সুতি কাপড় দিয়ে পরিষ্কার করে রাখতে হবে। ইনহেলার ও এর আনুষঙ্গিক অন্যান্য ডিভাইসের সঠিক ব্যবহারই পারে শ্বাসকষ্টজনিত রোগ থেকে উপশম দিতে।
এজন্য এর সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে নিজে জানা একই সঙ্গে অন্যদের জানানোও একান্ত প্রয়োজন। তবেই হাঁপানিসহ শ্বাসযন্ত্রের অন্যান্য রোগ থাকবে নিয়ন্ত্রণে।
লেখক: সহকারী রেজিস্ট্রার (মেডিসিন), খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, খুলনা।
জেএমএস/জেআইএম