ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন চলছে। প্রথম দফা নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচন নিয়ে মানুষের আগ্রহ কম। ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি খুবই কম। উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিচ্ছে না। তবে দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েও কেউ কেউ ভোটে লড়ে জিতেও আসছে। আবার আওয়ামী লীগের মধ্যে এই নির্বাচন নিয়ে দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের অনেক ঘটনা ঘটছে। তবে উপজেলা নির্বাচন নিয়ে আলোচনার আগে আমাদের দেশের নির্বাচন নিয়ে বাইরের দেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিরা কী ভাবেন তা একটু দেখে নেওয়া যাক।
Advertisement
২০ মে ‘আজকের পত্রিকা’য় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যাচ্ছে, কারাগার থেকে বেরিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে তুলাধোনা করছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। ভারতের গণতন্ত্রের মান নষ্ট হচ্ছে মোদির কারণে, এই অভিযোগ তুলেছেন তিনি। দাবি করেছেন, মোদি গণতন্ত্রবিরোধীদের অনুসরণ করছেন। বলেছেন, বাংলাদেশে বিরোধী নেতাদের কারাগারে রেখে নির্বাচনে কারচুপি করেছে ক্ষমতাসীনেরা।
৫০ দিন কারাগারে থেকে ছাড়া পেয়ে লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে দল ও জোটের হয়ে নেমেছেন কেজরিওয়াল। ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি জোটের বিরোধী ইন্ডিয়া জোটের সমাবেশে গত ১৭ মে মহারাষ্ট্রের মুম্বাইয়ে গণতন্ত্র নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। সমাবেশের বক্তৃতায় মোদির কঠোর সমালোচনা করেন কেজরিওয়াল। তিনি বলেন, মোদি এবারের লোকসভা নির্বাচনে হেরে যাচ্ছেন। তিনি যদি কোনোক্রমে জিতে যান, তবে তিনি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মতো হবেন। যিনি কিনা বিরোধীদের ধরে ধরে জেলে পুরেছেন। এমনকি বিরোধীদের হত্যাও করেছেন।
এই সভায় পাকিস্তান প্রসঙ্গ তুলে কেজরিওয়াল বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে কারাগারে ঢুকিয়ে নির্বাচনে জয় ছিনিয়ে নিয়েছে বিরোধীরা। বাংলাদেশে বিরোধী নেতাদের কারাগারে রেখে নির্বাচনে কারচুপি করেছে ক্ষমতাসীনেরা। তিনি বলেন, মোদি যদি নির্বাচনে জিতে যান, তবে উদ্ধব ঠাকরে, শারদ পাওয়ারসহ বিরোধীদের জেলে যেতে হবে।
Advertisement
দুর্নীতির মামলায় কেজরিওয়াল আপাতত কারাগার থেকে ছুটি পেয়েছেন। সুপ্রিম কোর্ট তাঁকে ২১ দিনের জন্য মুক্তি দিয়েছেন। আগামী ২ জুন আবারও কারাগারে ফিরতে হবে তাঁকে। কেজরিওয়াল খারাপ নির্বাচন প্রসঙ্গে যে কয়টা দেশের নাম বলেছেন, তার মধ্যে বাংলাদেশও আছে। আমরা কেজরিওয়ালের বক্তব্যের বিরোধিতা করতে পারি, বলতে পারি তিনি সঠিক কথা বলেননি। কিন্তু তাতে তো তার ধারণা বদলাবে না। আমাদের এখন ভালো নির্বাচন করার ব্যাপারে আন্তরিক হওয়া উচিত।
দুই. এবার আসা যাক আবার আমাদের উপজেলা নির্বাচন প্রসঙ্গে। ২০ মে ‘আজকের পত্রিকা’য় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যাচ্ছে, ষষ্ঠ উপজেলা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপে কোটিপ্রতি প্রার্থীর সংখ্যা আগের বারের তিন গুণ। এই ধাপে ১১৬ জন প্রার্থীর সম্পদ ১ কোটি টাকা বা তার চেয়ে বেশি। একই সঙ্গে এবার প্রায় ২৫ শতাংশ প্রার্থীর ঋণ বা দায় আছে। অর্থাৎ প্রায় প্রতি চারজন প্রার্থীর মধ্যে একজন ঋণগ্রস্ত। দ্বিতীয় ধাপে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এসব তথ্য জানিয়েছে।
টিআইবি জানায়, দ্বিতীয় ধাপে ১৫৭ উপজেলায় চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদ মিলিয়ে মোট প্রার্থী ১ হাজার ৮১১ জন। চেয়ারম্যান পদে মহিলা প্রার্থী তুলনামূলকভাবে কম, মাত্র ১ দশমিক ৮৬ শতাংশ। পুরুষ প্রার্থী ৯৮ দশমিক ১৪ শতাংশ। এই ধাপে ৪৬২ জন প্রার্থী ঋণগ্রস্ত। এর মধ্যে চেয়ারম্যান পদে ২৩৫ (৩৯ দশমিক ২৩ শতাংশ), ভাইস চেয়ারম্যান পদে ১৬৭ (২৪ দশমিক ২৪ শতাংশ) এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৬০ জন (১১ দশমিক ৪৭ শতাংশ)।
মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের আত্মীয়দের উপজেলা নির্বাচন থেকে দূরে থাকার দলের কেন্দ্রীয় আহ্বান তৃণমূলে উপেক্ষিত হয়েছে। কিন্তু কেন্দ্র কোনো কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারছে না। দলের মধ্যে এ নিয়ে বিরোধ-অসন্তোষ বাড়ছে। জানা গেছে, প্রথম ধাপে সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদের ১৩ স্বজন নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। এই ধাপে তা বেড়ে ১৭ জন হয়েছে। চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ৭০ দশমিক ৫১ শতাংশ; ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৬৮ দশমিক ৭৩ এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ২৯ দশমিক ২৬ শতাংশ প্রার্থী পেশা হিসেবে ব্যবসায়ী দেখিয়েছেন। প্রার্থীদের ১৩ দশমিক ১৩ শতাংশ বর্তমানে বিভিন্ন মামলায় অভিযুক্ত।
Advertisement
টিআইবির দাবি, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো স্থানীয় নির্বাচনেও ব্যবসায়ী প্রার্থীদের দাপট ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ব্যবসায়ী প্রার্থীর সংখ্যা ২০১৪ সালের চতুর্থ উপজেলা নির্বাচনের তুলনায় ৮ শতাংশ বেড়েছে। অন্যদিকে গৃহিণী বা গৃহস্থালি, কৃষিজীবী ও শিক্ষক প্রার্থী ক্রমেই কমছে।
টিআইবির প্রতিবেদনে আরো জানানো হয়েছে, দ্বিতীয় ধাপে জমির মালিকানার দিক দিয়ে আইনি সীমা অতিক্রম করেছেন চার প্রার্থী। আইন অনুযায়ী, একজন নাগরিক সর্বোচ্চ ১০০ বিঘা বা ৩৩ একর জমির মালিক হতে পারেন। আইনি সীমার বাইরে চার প্রার্থীর মোট অতিরিক্ত জমি আছে ৩৮ দশমিক ৭৩ একর। এই তালিকার শীর্ষে আছেন শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী এস এম আমিনুল ইসলাম। তাঁর জমির পরিমাণ ৫৪ দশমিক ৬ একর। বাকি তিন প্রার্থী হলেন কুষ্টিয়ার মিরপুরের মোহাম্মদ আব্দুল হালিম (৪১ দশমিক ৩ একর), কক্সবাজারের ঈদগাঁওয়ের সামসুল আলম (৪০ দশমিক ৫৪ একর) এবং মানিকগঞ্জের শিবালয়ের মো. আবদুর রহিম খান (৩৪ দশমিক ২৯ একর)।
প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়েছে, ২০১৯ সালের তুলনায় ১০০ শতাংশ বা তার বেশি আয় বেড়েছে ১২০ প্রার্থীর। দ্বিতীয় ধাপের প্রার্থীদের মধ্যে আয় বৃদ্ধির দিক দিয়ে সবার ওপরে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান। তাঁর সম্পদ বেড়েছে ১০ হাজার ৯০০ শতাংশ। ঠাকুরগাঁও সদরের ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী মো. আব্দুর রশিদের আয় বেড়েছে ১০ হাজার ৮৬৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। একই সময়ে ১০০ শতাংশ বা তার বেশি অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে ১৫৬ জন প্রার্থীর। স্ত্রী বা নির্ভরশীলদের অস্থাবর সম্পদ অন্তত ১০০ শতাংশ বেড়েছে ৪২ প্রার্থীর।
টিআইবি জানায়, উপজেলা নির্বাচনে জয়ী প্রার্থীর সঙ্গে নির্বাচিত হননি, এমন প্রার্থীর গত পাঁচ বছরের আয় ও সম্পদ বৃদ্ধির তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে, অনির্বাচিতদের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের। অর্থাৎ ক্ষমতায় থাকার সঙ্গে দ্রুত আয় ও সম্পদ বৃদ্ধির প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ ক্ষেত্রে শুধু নিজেদেরই নয়, স্ত্রী ও নির্ভরশীলদের আয় ও সম্পদ বেড়েছে পাল্লা দিয়ে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, বড় দুই দলই দলীয় শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পারছে না। জনপ্রতিনিধিরা নিজেদের পদকে আয় ও সম্পদ বিকাশের মাধ্যম হিসেবে দেখছেন। ফলে শুধু জনস্বার্থ নয়, দলীয় স্বার্থের বিষয়ও প্রাধান্য থাকছে না প্রার্থীদের কাছে। নির্বাচনে এক দলের একচ্ছত্র আধিপত্য গভীরতর প্রতিষ্ঠা লাভ করছে। প্রথম ধাপের তুলনায় দ্বিতীয় ধাপে প্রার্থীর সংখ্যা বাড়লেও এটিকে গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতার সঙ্গে তুলনা করা যাবে না।
বড় দুই দলই দলীয় শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পারছে না। জনপ্রতিনিধিরা নিজেদের পদকে আয় ও সম্পদ বিকাশের মাধ্যম হিসেবে দেখছেন। ফলে শুধু জনস্বার্থ নয়, দলীয় স্বার্থের বিষয়ও প্রাধান্য থাকছে না প্রার্থীদের কাছে। নির্বাচনে এক দলের একচ্ছত্র আধিপত্য গভীরতর প্রতিষ্ঠা লাভ করছে।
তিন. নির্বাচনে প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটানো প্রায় নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবর থেকে জানা যাচ্ছে, কোনো কোনো জায়গায় আত্মীয়কে জিতিয়ে আনার জন্য স্থানীয় সংসদ সদস্য প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে আচরণবিধি লঙ্ঘন করলেও নির্বাচন কমিশন শক্ত অবস্থান নিতে পারছে না। এতে উত্তেজনা বাড়ছে, ভোটারদের মধ্যেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক।
লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) নুরউদ্দিন চৌধুরী নয়নের ভগ্নিপতি মামুনুর রশিদ রায়পুর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী। ভগ্নিপতিকে বিজয়ী করতে এমপি প্রতিপক্ষ প্রার্থী ও তাঁর সমর্থকদের এলাকা ছাড়তে হুমকি দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ১৯ মে দুপুরে চেয়ারম্যান প্রার্থী আলতাফ হোসেন হাওলাদার শহরের প্রধান নির্বাচনী কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে এই অভিযোগ করেন।
মোটরসাইকেল প্রতীকের প্রার্থী আলতাফ বলেন, ‘তফসিল ঘোষণার পর থেকে লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও লক্ষ্মীপুর-২ আসনের এমপি নয়ন তাঁর ভগ্নিপতি আনারস প্রতীকের প্রার্থী মামুনুরকে বিজয়ী করতে নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করেছেন। তিনি আচরণবিধি লঙ্ঘন করে আমার লোকজনকে জোর করে তুলে নিয়ে মামুনুরের পক্ষে কাজ করতে চাপ দিচ্ছেন। আমার কর্মী-সমর্থকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে এলাকা ছাড়তে ভয়ভীতি ও হত্যার হুমকি দিচ্ছেন। এতে কর্মী-সমর্থকেরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।’
এসব বিষয়ে নির্বাচন কমিশন, জেলা প্রশাসক এবং রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ দিলেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না জানিয়ে আলতাফ বলেন, ‘এটা সুষ্ঠু ভোটের পরিবেশ হতে পারে না। সুষ্ঠু ভোটের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে।’
মোটরসাইকেল প্রতীকের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট রায়পুর পৌরসভার সাবেক মেয়র ইছমাইল হোসেন খোকন বলেন, ‘এমপি নয়ন, তাঁর ভগ্নিপতি, আওয়ামী লীগ নেতা কাজী জামশেদ কবির বাকী বিল্লাহ ও সাবেক কেন্দ্রীয় যুবলীগ নেতা মোহাম্মদ আলীর হুমকি-ধমকিতে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় আছি। তাঁরা প্রকাশ্যে প্রার্থী, আমাকে ও কর্মী-সমর্থকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে এলাকা ছাড়তে নির্দেশ দিচ্ছেন। এলাকা না ছাড়লে হত্যা করা হবে। এ ছাড়া মোটরসাইকেল প্রতীকের যেন এজেন্ট দেওয়া না হয়, সেই ভয়ভীতিও দেখানো হচ্ছে।’অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এমপি নুরউদ্দিন চৌধুরী নয়ন ও তাঁর ভগ্নিপতি মামুনুর রশিদ। তাঁরা বলেছেন, প্রতিপক্ষ মিথ্যা বলছে।
তবে হুমকি ধমকির ঘটনা অনেক জায়গায় থেকেই পাওয়া যাচ্ছে। এমনিতেই ভোটের ফলাফল অনেকটা পূর্ব নির্ধারিত হওয়ায় ভোটাররা কষ্ট করে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার গরজ বোধ করছেন না। তার ওপর যদি আতঙ্ক ছড়ানো হয়, তাহলে স্বল্প সংখ্যক ভোটারের উপস্থিতিতে নিয়ম রক্ষার যে নির্বাচনই হবে তা কোনোভাবেই উৎকৃষ্ট নির্বাচনের দৃষ্টান্ত হবে না।
লেখক : রাজনীতিবিদ, লেখক ও চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ।
এইচআর/জেআইএম