প্রবাস

আমরা যে বয়সে চাকরির জন্য ঘুরি অস্ট্রেলিয়ানরা সেই বয়সে বাড়ির মালিক

প্রবাস এক দীর্ঘশ্বাসের নাম। আমার কাছে প্রবাসের কোনো শ্রেণিভেদ নেই। এর মানে যারা নিজ দেশের বাইরে থাকেন তাদের অধিকাংশেরই অনুভূতি প্রায় এক ও অভিন্ন। এখানে সবাইকে পরিশ্রম করে টিকে থাকতে হয়। সেটা হোক সৌদি-কাতার-কুয়েত-দুবাই-মালয়েশিয়া-জাপান-সিংগাপুর-ইতালী-সুইডেন-সুইজারল্যান্ড-আমেরিকা-কানাডা-ইংল্যান্ড কিংবা অস্ট্রেলিয়া।

Advertisement

কিছু মানুষ হয়তো তাদের অসম্ভব মেধা ও পরিশ্রমের কারণে সবাইকে ছাড়িয়ে ভিন্ন উচ্চতায় নিজেদের নিয়ে যান। তাছাড়া সবার গল্পই এক। আমরা কোনোরকমে তেলাপোকার মতো টিকে থাকাকেই চরম স্বার্থকতা বলে মেনে নেই। এটাই হয়তো জীবনের লক্ষ্য, এটাই হয়তো জীবনের গন্তব্য! জীবন ও জীবিকার তাগিদে গত ছয় বছরে ধরে অস্ট্রেলিয়াতে বসবাস। এখানে কিছু একটা করে জীবন চালিয়ে নেওয়াই অনেক বড় স্বার্থকতা। প্রতিদিন নিয়ম করে ঘুম থেকে উঠে কাজে যেতে হয়। তারপর ঘুম ঘুম চোখে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে খাওয়া দাওয়া সেরে আবার আগামীকালের জন্য পরিকল্পনা করে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতে হয়। ঘুমাতে যেতে যেতে মাথায় আবার অসংখ্য দুশ্চিন্তা কাজ করে। কাজ যাওয়ার আগ পর্যন্ত আর কাজ থেকে বাসা ফেরা পর্যন্ত যতটুকু সময় পাওয়া যায় সেই সময়ে ট্রেনে একটু ঘুমানোও নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার সময় দেখি কিছু মানুষ রাস্তায় শুয়ে আছে। তাদের কারও কারও গায়ে জামাকাপড় নেই। কেউ কেউ একটা ট্রলিতে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে রাস্তার পাশে বসে থাকে। কেউ কেউ আবার হাতে গিটারে সুর তুলে মানুষের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে থাকে। আমার কাছে এই ব্যাপারটি খুব শৈল্পিক মনে হয়। এরা বিভিন্ন কারণে এমন অবস্থায় পতিত হয়েছে।

আমি মাঝে মাঝে ভাবি, এদের কী কোনো অভিযোগ নেই? কোনও রাগ নেই? অভিমান নেই? ক্ষোভ নেই? এরা কী আন্দোলন করে না? ভাংচুর করে না? সরকার থেকে সহায়তা পায় না? এসব মানুষের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার আদি অধিবাসী,অস্ট্রেলিয়ান, এবং বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মানুষজন রয়েছে। একদিন কাজে যাওয়ার পথে দেখলাম একজন উদোম শরীরে মাথায় একটা শার্ট পেছিয়ে ফুটপাতে শুয়ে আছে। জীর্ণশীর্ণ শরীর আর সেই শরীরে অসংখ্য দাগ।

অস্ট্রেলিয়ায় এমন নাজুক ও ভঙ্গুর মানুষ প্রায়ই দেখা যায়। দেখে খুব মায়া হলো। এই মায়ামাখা মুখগুলো দেখার সাথে সাথে ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে ফুটপাত আর রেলস্টেশনে ভাসমান মানুষের চেহারা চোখে ভেসে উঠলো। তীব্র শীতে এসব মানুষ কতোই না কষ্ট করে। এ দু’দেশের মধ্য পার্থক্য হলো সরকারের কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড আর নিরাপত্তা। অস্ট্রেলিয়াতে এসব মানুষের অভিযোগ আছে কিনা জানি না। তবে আমাদের দেশের ছিন্নমূল মানুষগুলোর সত্যিই কোনও অভিযোগ নেই! আমাদের মতো প্রবাসে থাকা মানুষগুলোর অবস্থা হয়তো এতো নাজুক নয়। তবে অবস্থানটা কোথায় সেটাও অনুধাবন করা যায়। ঠিক দিনে এনে দিনে খাওয়ার মতো অবস্থা। দেশে যেমন অন্যের ক্ষেতে শ্রম বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করে ডাল ভাত খেয়ে বেঁচে থাকতে হয় ঠিক এখানেও গায়ের রক্ত পানি করে সংসারের খরচ যোগাড় করতে হয়। এদেশে একা উপার্জন করে টিকে থাকাই দুরূহ। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি আয় করলে অন্তত ভদ্রস্তভাবে চলা যায়।

Advertisement

গত ছয়টা বছরে টিকে থাকার জন্য কতই না পরিশ্রম করেছি! দেশে যে কাজ করার কথা কখনওই কল্পনা করিনি সংসারের স্বার্থে সেই কাজও হাসিমুখে করতে হয়েছে। এদেশে এটাই কাজের সংস্কৃতি। কাজে লজ্জা নেই। কাজ মানুষের জীবনের নিরাপত্তা প্রদান করে। মানুষ কাজ করে। ট্যাক্স প্রদান করে। সেই ট্যাক্সেবল উপার্জন দিয়ে বাড়ি গাড়ি ক্রয় করে। তাছাড়া কাজ থেকে ভবিষ্য তহবিলে টাকা জমা হয়।

সেই টাকার পরিবর্তে সরকার বৃদ্ধ বয়সে নানা রকমের সহায়তা প্রদান করে। তাই মানুষ কাজ করে। এমনকি এখানে শিশুরাও কাজ করে। শিশুদের বয়স ১২ বছর হলে তাদের পিতামাতা তাদেরকে কাজে যেতে উৎসাহিত করেন। বিদ্যালয় ছুটির সময়ে রেস্টুরেন্টগুলো শিশুদের কাজ দেয়। বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে কাজ করার সুবাধে দেখিছি শিশুরা খুব আনন্দ নিয়ে কাজ করে। এখানে কিছু কিছু কাজ বাদে সকল কাজের বেতন প্রায় এক। এজন্য মানুষ কাজ করতে লজ্জাবোধ করে না। আর এর মাধ্যমে সমাজে সাম্যতা আনয়ন করা সহজ হয়। মাঝে মাঝে ভাবি, আমাদের দেশের মানুষগুলো এমন কেন? তাদের একটা বড় অংশ না খেয়ে মারা যাবে, তাও কাজ করবে না। লোকে মন্দ বলবে তাই কাজ করবে না। তবে কাজ না করলেও বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ এনে সংসার চালাবে। আর একটা পর্যায়ে হয়তো বাড়ি ছাড়ে কিংবা আত্মহত্যা করে বা করতে উদ্যত হয়। তবে কাজ না করা সেই মানুষগুলোই দেশের বাইরে গেলে সব কাজ করতে পারেন। তার মানে হচ্ছে, আমরা কাজ করতে চাইলেই সমালোচনার ভয়ে কাজ করি না। অর্থাৎ আমরা কাজের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারিনি।

গড়ে তুলতে পারিনি বিধায় আমাদের জনশক্তির একটা বড় অংশ আজ অব্যবহৃত। কিংবা একটা দীর্ঘ সময় রাষ্ট্র একজন নাগরিকের সেবা থেকে বঞ্চিত থাকে। অস্ট্রেলিয়াতে একজন মানুষ যে বয়সে বাড়ি গাড়ির মালিক হয়ে থাকেন আমরা সেই বয়সে একটা সরকারি চাকরির পেছনে ঘোরাঘুরি করি। আর একারণেই একটা সরকারি পরীক্ষা না দিতে পারার কারণে কেউ রাস্তায় গড়াগড়ি করে কান্নাকাটি করেন আবার কেউবা আত্মহত্যা করতে চান। এর দায় কার? পরীক্ষা না দিতে পারা ব্যক্তিটির? না রাষ্ট্রের ভুল ব্যবস্থার?

বাংলাদেশের মানুষ উচ্চ শিক্ষার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশে গিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি কাজ করেন। খেয়ে না খেয়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। অথচ তারা যখন দেশে ফিরে যান সেই কাজের অভিজ্ঞতাগুলো কারও সাথে শেয়ার করেন না। বিদেশে উপার্জিত টাকা দিয়ে বাড়ি গাড়ি করে সেই আগের অবস্থাতেই ফিরে যান। এমন একটা ভাব নিয়ে চলাচল করেন যেনও পূর্বের জনমে সবাই রাজা বাদশা ছিলেন কিংবা একজনমে তিনি এমন কাজ আর কখনওই করেননি।

Advertisement

আমাদের এই সংস্কৃতির পরিবর্তন আবশ্যক। একটা দেশের পাঁচ ভাগের এক ভাগ মানুষের উপার্জন দিয়ে দেশের উন্নতি অনেক কঠিন। আমাদের বাবা-মায়েরা সন্তান চাকরি করার আগ পর্যন্ত সমস্ত দায়িত্ব বয়ে বেড়ান। একটা সরকারি চাকরির আশায় জীবনের অর্ধেকটা সময় পার করে দেন। এই অভিশাপ থেকে জাতির মুক্তি দরকার। আমরা উন্নত বিশ্বের কথা বলি। উন্নত বিশ্বের মতো হতে চাই। কিন্তু উন্নত বিশ্বের উন্নত হওয়ার ম্যাকানিজম অনুসরণ করি না।

যার কারণে একজনকেই সংসারের সকল দায়দায়িত্ব বহন করতে করতে জীবন পার করতে হয়। জীবন পার হয় রাষ্ট্রের। একজন একা মানুষ সারাটা জীবন কী কষ্ট করেন সেটা সেই কষ্টে না পড়লে কেই বুঝতে চান না। এই অপসংস্কৃতির অবসান হউক। সবাই কাজ করুক। বুঝতে শিখুক, কাজে লজ্জা নেই। কাজে নিজের নিরাপত্তা আসে, নিরাপত্তা আসে দেশের ও অনাগত ভবিষ্যতের।

এমআরএম/এমএস