বাবার বাড়িতে কলির লাশ আনা হলো। কলির মৃত্যুর সংবাদে চারদিকে শুধু মানুষ আর মানুষ। গোসল করানোর পর কাফনের কাপড় পরিয়ে কলিকে যখন খাটিয়াতে রাখা হলো তখন স্বামী তার মত পাল্টে ফেললো। জজ মিয়ার এক কথা, কলির লাশ আমার বাইতই দাফন করুন লাগবো। মেয়ে মানুষের মৃত্যুর পর তাদের লাশ স্বামীর বাড়ি দাফন হওয়া ফরজ! এই ব্যাপারে আমাদের গ্রামের সকল মাতব্বর আর কলির শ্বশুর বাড়ির সবাই একমত। কিন্তু কলির মা-বাবা কিছুতেই একমত নন। কলির মা চিৎকার করে কাঁদলেও বাবা চাঁদরে মুখ লুকিয়ে চোখের পানি ফেলছেন। কাউকে বুঝতে দিচ্ছেন না যে তার ভেতরে কী চলছে! আমি তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলেও বয়সে অন্যদের চেয়ে ছোট। চাইলেও কিছু বলতে পারছিলাম না। বাড়িতে আমার সমবয়সী যারা ছিল তারাও ব্যাপারটার সাথে একমত ছিল না। কিন্তু বড়দের মুখের ওপর কথা বলা অন্যায় ও বেয়াদবির শামিল তাই কেউ কিছু বলতে পারছিল না। আমরা শুধু সবার কথা শুনছি আর মামা মামির জন্য সমবেদনা অনুভব করছি। কলির লাশ ফিরোজ ভাইজানের উঠোনে রেখে দুই গ্রাম আর পরিবারের মধ্যে তুমুল ঝগড়া চলছে। জজ মিয়ার বোন গলা ফাটিয়ে বলছিল যে, দরহার অইলে আরও একটা লাশ ফালায়্যাম, তাও কলির লাশ জজ মিয়ার বাইত লয়্যা যায়্যাম। এর মধ্যে কলির এক চাচাতো চাচা বলে উঠলেন, ছেইড়াইন একবার বাফের বাড়ি ছাইড়্যা গেলে জামাইয়ের বাইত লাশ দাফন দিওন লাগবো। পুরুষশাসিত সমাজের এক অপূর্ব দৃশ্য! লাশ ঘিরে প্রায় শত শত মানুষ।
Advertisement
কারও কাছে কোনও সমাধান নেই। এছাড়া এলাকার নেতৃত্বস্থানীয় লোকজনও সমধান দিতে ব্যর্থ। অন্যদিক বাড়ি থেকে ভেসে আসছে কলির মা আর ভাই-বোনের বুকফাঁটা আর্তনাদ। এদিকে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে। এর মধ্যে গ্রামের এক মুরুব্বি মানুষজনকে নিয়ে জানিয়ে দিলো যে, কলি যেহেতু মেয়ে এবং বিবাহিত সেহেতু তার দাফন বাবার বাড়িতে সম্ভব নয়। সমাজ ও ধর্ম রক্ষার জন্য কলির লাশের দাফন স্বামীর বাড়িতেই অপরিহার্য।
প্রথম পর্ব পড়ুন এখানে
কলি ছিল মা-বাবার সাত রাজার ধনএর মধ্যে আমার বড় ভাই আজহার আর মামাতো ভাই ইকবালকে সাথে নিয়ে ঢাকায় আমাদের আত্মীয় মাওলানা মাহফুজুর রহমান মুক্তা ভাইয়ের কাছে ফোন দিয়ে জানতে চাইলাম, ইসলাম ধর্মে এমন কোনও আইন আছে কি না যে মেয়ে মানুষ মারা গেলে তাকে স্বামীর বাড়িতেই দাফন করতে হবে? তিনি বললেন, এটা যারা বলছে তারা অন্যায় কাজ করছে। ইসলাম ধর্মে এমন কোনো আইন নেই।
Advertisement
তিনি আরও যোগ করলেন, যারা বন্যার সময় মারা যান এবং কবর দেওয়ার পরিস্থিতি থাকে না তখন তো আমরা তাদের লাশ পানিতে ভাসিয়ে দেই। এতে যদি ধর্মের ক্ষতি না হয় তাহলে মেয়ের লাশ বাবার বাড়িতে কবর দিলে ধর্মের কী ক্ষতি? এই ব্যাপারটি নিয়ে আমরা কয়েকজন কথা বলতে চাইলে বাড়ির মুরুব্বিরা থামিয়ে দিলো। আমরা রাগে যে যার মতো ঘরে চলে আসলাম। একটু পর আবার বের হয়ে যখন লাশের কাছে যাচ্ছি তখন দেখলাম জজ মিয়া আমাদের গ্রামে নির্বাচিত চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম শফিক (ভিপি শফিক) মামাকে কলির দাদার কবরের কাছে গাছের নিচে ডেকে নিয়ে বলছে, “যদি কলির লাশ আমাদেরকে দেন তাহলে আমার অলংকারের দরকার নেই। আর যদি লাশ না দেন তাহলে আমাকে আমার অলংকার দিয়ে দিতে হবে।’ অলংকারের বদলে বউয়ের লাশের হিসাব নিকাশ! এ যেন এক নষ্ট পুরুষ! জজ মিয়ার এমন কথা শুনে আমার মেজাজ গরম হয়ে গেলো। আমি ইকবালকে ডেকে বললাম, আমার সাথে আয়। তাকে বললাম, আমি যা-ই বলি তুই শুধু হ আর হাত ঘুরাবি। কেননা ইকবালের গলা বেশ ভারি ও সুঠাম দেহের অধিকারী। শতশত মানুষের ভিড়ে উচ্চস্বরে বললাম, কার সাহস আছে? আসেন, সামনে আসেন? কলির লাশ স্বামীর বাড়ি যাবে না। ওর দাফন এখানেই হবে। কারো বুকে সাহস থাকলে থামাতে আসেন।
সাথে সাথে বাড়ির কয়েকজন মুরুব্বি বললো, দেখ বাবারা, সমাজ ধর্ম কিছুই থাকবে না। আমি বললাম, সমাজ ধর্ম ছিলো কোথায়? টাকার অভাবে যখন কলির চিকিৎসা হচ্ছিলো না তখন তো কেউ তার খবর নেননি। টাকা দেওয়া তো দূরের থাক, একবার দেখতেও যাননি। তখন ধর্ম যায়নি? তখন জাত যায়নি? তখন সমাজ যায়নি? আর এখন সমাজ নিয়ে এসেছেন? ধর্ম নিয়ে এসেছেন?
দ্বিতীয় পর্ব পড়ুন এখানে
নারীদের এ কেমন জীবন!কলির স্বামীকে বললাম, এই বেয়াদব, আপনার মা-বাবা যখন ওকে অত্যাচার করতো তখনতো কিছু বলেননি? ধর্মের কোথায় ছিলো যে, কলিকে অত্যাচার করতে হবে? হাসপাতালে প্রায় আড়াই লাখের মতো টাকা খরচ হয়েছে, দিলেন তো মাত্র পনেরো হাজার টাকা। তখন সমাজ-ধর্ম যায়নি? এই যদি হয় আপনাদের ধর্ম আর সমাজ তাহলে আমরা মানি না। যদি কারো বুকের সাহস থাকে ফেরান আমাদের। কলির লাশ এখানেই দাফন হবে। কেউ কথা বলবেন না।
Advertisement
আমার সাথে সাথে ইকবালও গলা মেলালো। আমাদের রুদ্রমূর্তি দেখে সবাই লেজ গুটিয়ে চলে গেলো। ইমাম সাহেব জানাজা পড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। জজ মিয়া ওজু করে জানাজার নামাজে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু পাশ থেকে তার বোন তাকে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে চলে গেলো। আর বলতে লাগলো, বৌয়ের জানাজা পড়তে হবে না! হতভাগা স্বামী! মরণকালে স্ত্রীর জানাজা পড়ার সৌভাগ্য তার হয়নি। কলির শ্বশুর বাড়ির লোকজন প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করে সাপের মতো ফণা তুলে চলে গেলো। জানাজা শেষে কলিকে তার দাদা-দাদীর কবরের পাশে দাফন করা হলো। অনেকদিন পরে জানলাম কলি মৃত্যুর কয়েকদিন পূর্বে বাবার বাড়ি এসেই মাকে বলেছিলো, ‘আম্মা এইবার সংসার শেষ কইর্যা আইছি। এই দোজখে যাইবার লাইগ্যা আমারে আর কইবা না।’ কলি তার মায়ের কাছে বলেছিলো, ‘আম্মা প্রথমের বাফরে কইছি, আমি মইর্যা গেলে তুমি যাতে আমার জানাজায় শরিক না অইতারো। আমার উফরে যে অত্যাচার করছে তার শাস্তি যাতে এইডার অয়।’
জীবিত থাকতে সৃষ্টিকর্তা কলির কথা না শুনলেও মরণের পর তার কথা শুনেছিল। ধারণা করা হয় যে কলির ওপর শারীরিক অত্যাচারের কারণে তার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছিল। সেই রক্তক্ষরণের প্রবাহ তার বাবা-মা আর ভাই-বোনের রক্তেও প্রবাহিত হয়েছিল। মা-বাবার শুকনো বাগানে কলি গোলাপের কলি হয়ে জন্মালেও ফুটন্ত গোলাপ হওয়ার আগেই অকালে ঝরে গেলো। রেখে গেলো দুটো পাপড়ি। প্রথম আর শাওন। আর জানিয়ে দিয়ে গেলো, মেয়েরা সর্বত্রই শৃঙ্খলিত। এমআরএম/জিকেএস