শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ মে যখন স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন তখন তিনি বঙ্গবন্ধু ভবনে থাকতে পারেননি; বাড়িতে ঢুকতেও পারেননি। আমরা তো এখন সবাই জানি ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের ৬৭৭ নম্বর বাড়িতে বাবা-মা, চাচা, ভাই ভাবিসহ পরিবারের সদস্যদের জন্য একটু দোয়া পড়তে চেয়েছিলেন সেটাও জিয়াউর রহমান সরকারের বাধার কারণে পারেননি। বাড়ির সামনে রাস্তার ধারে দোয়া পড়েছিলেন।
Advertisement
ওই রাতে ঢাকায় রাত্রিযাপন করার মতো জায়গা ছিল না। তিনি সে রাতে লালমাটিয়ার একটা বাসায় উঠেছিলেন। বাসার ঠিকানা ছিল ৬/১০, ব্লক ডি লালমাটিয়া। বাসাটি ছিল বঙ্গবন্ধুর এক নিকটাত্মীয় সৈয়দ হোসেনের তিন কক্ষের বাসা। এভাবেই শেখ হাসিনার লড়াই শুরু হয়েছিল। এখনকার দিনের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা কি এটা কল্পনাও করতে পারবেন? শেখ হাসিনার জয় মানেই বাংলাদেশের সংগ্রামের জয়। বিগত ৪২ বছরের ইতিহাস তাই প্রমাণ করেছে।
এমন শিরোনাম দিয়ে প্রায় বিশ বছর আগে আমি একটি লেখা লিখেছিলাম। যদিও শিরোনামটি একরকম ধার করা শিরোনাম। কবি নির্মলেন্দু গুণের একেটি কবিতা ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’। সেখানে একটি লাইন ছিল এমন- ‘কবি নজরুল পরাজিত হলে ক্ষতি কার?’ আজ থেকে ৪৩ বছর আগে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। পাঠকদের মধ্যে যাদের বয়স ৫০ বছরের নিচে তাদের হয়তো বোঝার কথা নয় কি রকম ভয়ংকর এক পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা বাংলাদেশে এসেছিলেন। শেখ হাসিনা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন মানে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যাত্রায় প্রত্যাবর্তন করা।
নতুন করে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হওয়া। আমি এ তথ্যটি একাধিকবার দিয়েছি যে, ১৯৮১ সালের ১১ মে অর্থাৎ শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তনের ছয়দিন আগে ‘নিউজ পত্রিকা’য় শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘আমি বিপদ জেনেই দেশে যাচ্ছি। মহৎ কাজ করতে গেলে ঝুঁকি নিতেই হয়।’ ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত দলের কাউন্সিলে শেখ হাসিনার অবর্তমানে (অনুপস্থিতিতে) তাকে সভাপতি করা হলো। শেখ হাসিনাকে সভাপতি নির্বাচন অনিবার্য ছিল; বঙ্গবন্ধু সৈনিকরা সেসময় বঙ্গবন্ধুর যোগ্য উত্তরসূরি খুঁজছিলেন।
Advertisement
বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ তখন তিন ধারায় বিভক্ত; আওয়ামী লীগ (মালেক উকিল), আওয়ামী লীগ (মিজান চৌধুরী), আওয়ামী লীগ (দেওয়ান ফরিদ গাজী)। ১৯৮১ সালের ১৬ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর আজ থেকে ১৮৫ বছর আগে যে বিশ্ববিদ্যালয় (১৮৩৯ সাল) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেই বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় শেখ হাসিনাকে যথার্থভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছিল।
১৯৯৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় তৎকালীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সম্মানসূচক ‘ডক্টর অব ল ডিগ্রি’তে ভূষিত করে। এই উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট জন ওয়েসলিং নিম্নে প্রদত্ত প্রমাণপত্র ‘সাইটেশান’ পাঠ করেন:
‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আপনার পিতা বাংলাদেশের জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। আর আপনিও বারবার নিজের স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে এবং নিজের জীবন বিপন্ন করে দেশে গণতন্ত্রের পুনর্জন্ম ঘটিয়েছেন।’
“সরল অথচ তীক্ষ্ণ বাগ্মিতা দিয়ে আপনি দেশের জনগণের জন্য আপনার সংগ্রামের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেছেন। তা হলো ‘ভাত ও ভোটের অধিকার’। প্রায়ই দেখা যায়, তৃতীয় বিশ্বের জনগণকে ভোটের বিনিময়ে ভাতের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা কিছুই পায় না। অথচ, আপনার সাহসী নেতৃত্বে বাংলাদেশের জনগণের ভাত ও ভোট দুটোর নিশ্চয়তাই পাবে।”
Advertisement
‘বাংলাদেশের জনগণের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো তাদের সাহস। এই সাহস কেবল তাদের ধৈর্যের পরিচায়কই নয়, এর দ্বারা নিজেদের সমৃদ্ধিও বয়ে এনেছে তারা।’
শেখ হাসিনার জয় মানেই বাংলাদেশের সংগ্রামের জয়। বিগত ৪২ বছরের ইতিহাস তাই প্রমাণ করেছে। তাই শেখ হাসিনা পরাজিত হওয়া মানেই সমগ্র বাংলাদেশ পরাজিত হওয়া। প্রয়াত কবি হাসান হাফিজুর রহমান বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনা আপনিই তো বাংলাদেশ।’
‘যে বছর আপনি জন্মগ্রহণ করেন, সে বছর জনগণ ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হলেও পাকিস্তানের নাগপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেনি। সেই কারণে আপনার পিতা সিকি শতাব্দী ধরে বাংলার স্বায়ত্তশাসনের জন্য আন্দোলন করেন। কিন্তু তাকে ও তার জনগণকে একসঙ্গে স্বাধীনতার ফল ভোগ করার সুযোগ বেশি দিন দেওয়া হয়নি। যেসব অফিসার আপনার পিতা, মাতা ও তিন ভাইকে হত্যা করেছে, তারা ভেবেছিল, বাংলার মানুষের প্রতি আপনার পরিবারের সেবা-ভালোবাসার সুযোগ তারা খতম করে দিয়েছে এবং দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আশা সুদূরপরাহত করতে পেরেছে। কিন্তু আপনাকে তারা গণনায় আনতে ব্যর্থ হয়েছিল।’
‘আপনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরবর্তী বছরগুলোয় বাংলাদেশ অস্থিতিশীল ধারায় প্রকাশ্য ও গোপন সামরিক শাসকদের দ্বারা শাসিত হয়েছে। এই অস্থির প্রেক্ষাপটের বিপরীত ধারায় ছিল দুটো জিনিস। প্রথমত, বাংলার জনগণ এবং দ্বিতীয়ত, শেখ হাসিনা। সে সময় সেই গণতন্ত্রের কথা কেউ ভুলে যায়নি, যার পরিপ্রেক্ষিতেই জন্ম হয়েছে বাংলাদেশের। আপনার সত্য কথা বলার অবিচল দৃঢ়তা আপনাকে অপশাসকদের কাছে বিপজ্জনক করে তুলেছিল।
তারা আপনাকে আপনার পিতার বাসভবনে বন্দি করে রাখলেও আপনার উদ্যম, আপনার চেতনা দমিয়ে রাখতে পারেনি। বিশাল দুর্গের মতো পৈতৃক বাড়ি ও তার উত্তরাধিকারের মধ্যে আটকে থাকলেও আপনার বসবাস ছিল সেই মুক্তির মধ্যে, যে মুক্তি হলো সাহসিকতার মুক্তি। আপনার পিতার একটি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখার সিকি শতাব্দী পর আজ আপনি সেখানে গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছেন।’
‘শেখ হাসিনা একজন মহা পিতার সুযোগ্য কন্যা, একটি যোগ্য জনগোষ্ঠীর মহান সেবক। বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় গর্বের সঙ্গে আপনাকে ডক্টর অব ল ডিগ্রি প্রদান করছে।’ (দৈনিক ভোরের কাগজ, ঢাকা : ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭)
আওয়ামী লীগের তৎকালীন নেতাদের (১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে) সবাই যে শেখ হাসিনাকেই সভাপতি হিসেবে মনে প্রাণে চাচ্ছিলেন তা নয়। আওয়ামী লীগের প্রভাবশালীদের কেউ কেউ এ নিয়োগ যে খোলা মনে নিয়েছিলেন তা মনে করলে ভুল হবে। ধারণা করেছিলেন, শেখ হাসিনা হবেন দলের সাক্ষীগোপাল সভাপতি আর দল চালাবেন তারা। তারা ভুলে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনার ধমনিতে শেখ মুজিবের রক্ত, যিনি পাকিস্তানের তেইশ বছর শাসনামলে প্রায় তের বছর কারাগারে কাটিয়েছেন, বারবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন তার কন্যা তো সাক্ষীগোপাল কলাগাছ হওয়ার জন্য জন্ম হয়নি। যিনি একরাতে সব হারানোর বেদনা জয় করতে পারেন তার তো হারাবার কিছু থাকতে পারে না। ১০ মে ১৯৭৯। সেদিন স্টকহোমে অনুষ্ঠিত সর্ব ইউরোপীয় বাকশালের সম্মেলনে শেখ হাসিনাকে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদানের জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছিল। কিন্তু তখন ভারত থেকে সুদূর সুইডেনে গিয়ে সম্মেলনে যোগ দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
সর্ব ইউরোপীয় নেতারা শেখ হাসিনার প্রতিনিধিত্ব করতে লন্ডনে অবস্থানরত শেখ রেহানাকে অনুরোধ করেন। দিল্লি থেকে ফোনে শেখ হাসিনাও বোনকে বলেন সম্মেলনে যেতে। অনুষ্ঠানে কী বলতে হবে সে বিষয়ে তিনি টেলিফোনে ছোট বোনকে নির্দেশনা দেন। শেখ রেহানা সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭৯ সালের জুন মাসে বিলেতের প্রখ্যাত আইনজীবী স্যার টমাস উইলিয়ামস কিউসি এমপির কথা শেখ রেহানার মাথায় আসে। তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বিশিষ্ট কৌঁসুলি ছিলেন এই ব্রিটিশ আইনজীবী। তাকে দিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার মামলা পরিচালনা করা যায়।
এ ব্যাপারে তিনি টেলিফোনে দিল্লিতে বড় বোনের সঙ্গে পরামর্শ করেন। শেখ হাসিনার পরামর্শ অনুযায়ী ১৯৮০ সালের ২০ জানুয়ারি সেন্ট্রাল লন্ডনের কনওয়ে হলে সর্ব ইউরোপীয় বঙ্গবন্ধু পরিষদের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ড. সেলিমকে সাধারণ সম্পাদক মনোনীত করা হয়। ড. শফিক সিদ্দিক সভাপতি পদে প্রস্তাব করেন স্যার টমাস উইলিয়ামসের নাম, যা সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। স্যার টমাস উইলিয়ামসের সম্মতি নেওয়ার জন্য ১৯৮০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি ‘হাউস অব কমন্সে’ গিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন শেখ রেহানা ও ড. শফিক। এবং তাকে জানান, বিদেশে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রচার করার লক্ষ্যে সম্প্রতি সর্ব ইউরোপীয় বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠিত হয়েছে। এতে সভাপতি পদের জন্য তাকে মনোনীত করা হয়েছে।
১৯৮০ সালের ৪ এপ্রিল শেখ হাসিনা তাঁর ছেলে ও মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে দিল্লি থেকে লন্ডন যান। জুন মাসের মাঝামাঝি একদিন স্যার টমাস উইলিয়ামস শেখ হাসিনাকে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আমন্ত্রণ জানান। শেখ হাসিনা তাঁর আমন্ত্রণ রক্ষা করেন। ওই সময় শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু হত্যার তদন্ত কমিশন গঠন করার দায়িত্ব নিতে তাকে অনুরোধ করেন। এতে তিনি সম্মত হন। কিছু দিন পর আবার স্যার টমাস উইলিয়ামসের সঙ্গে শেখ হাসিনা বৈঠক করেন। সেদিন সিদ্ধান্ত হয়, বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবার্ষিকী পালন অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত থাকবেন।
১৯৮০ সালের ১৬ আগস্ট পূর্ব লন্ডনের ইয়র্ক হলে যুক্তরাজ্যপ্রবাসী বাঙালিদের এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি এবং স্যার টমাস উইলিয়ামস কিউসি এমপি প্রধান বক্তা ছিলেন। ব্রিটিশ কনজারভেটিভ পার্টির পক্ষ থেকে ড. কর্নরাড উড ও লেবার পার্টির দুজন পার্লামেন্ট সদস্য বক্তব্য দেন। টমাস উইলিয়ামস বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতার হত্যাকারীদের আদালতের কাঠগড়ায় হাজির করার ব্যাপারে উপযুক্ত কর্মপন্থা গ্রহণ করবেন বলে শেখ হাসিনাকে প্রতিশ্রুতি দেন।
১৯৮০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর লন্ডনের হাউস অব কমন্সের নিকটবর্তী কুন্দুন রেস্টুরেন্টে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে স্যার টমাস উইলিয়ামস কিউসি এমপি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের তদন্ত কমিশন গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। কমিশনের চেয়ারম্যান হলেন স্যার টমাস উইলিয়ামস কিউসি এমপি, সদস্যরা হলেন নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী বিখ্যাত আইরিশ আইনজীবী সন ম্যাকব্রাইড, লেবার পার্টির আইনবিষয়ক মুখপাত্র জেফরি টমাস কিউসি এমপি এবং সলিসিটার অব্রে রোজ। অব্রে রোজকে কমিশনের সেক্রেটারির দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৭৫ সালের হত্যাকাণ্ডের বিচারের পক্ষে বিশ্ববিবেক জাগ্রত করতে এই তদন্ত কমিশন গঠন ছিল শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার নিরন্তর চেষ্টার ফসল।
১৯৮১ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশনের সদস্য জেফরি টমাস কিউসি এমপি ও সলিসিটার অব্রে রোজ বাংলাদেশ সফরের জন্য লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনে ভিসার আবেদন করেন। কিন্তু তাঁদের ভিসা মেলেনি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ডে জেনারেল জিয়া জড়িত থাকা সম্পর্কে তথ্য চাপা দেওয়া সম্ভব হবে না বলেই তদন্ত কমিশনের সদস্যদের ভিসা নামঞ্জুর হয়।
১৯৮১ সালের ২৮ জানুয়ারি লর্ড ফেনার ব্রকওয়ে তদন্ত কমিশনের সদস্যদের বাংলাদেশের ভিসা নামঞ্জুর করার বিষয়টি হাউস অব লর্ডসে উপস্থাপন করেন, যা ৪ ফেব্রুয়ারি হাউস অব লর্ডসে আলোচিত হয়। ওই আলোচনায় তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড ক্যারিংটনসহ অনেকে অংশ নেন। ১৯৮২ সালের ২০ মার্চ আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারবর্গ এবং চার জাতীয় নেতার হত্যা সম্পর্কে প্রাথমিক রিপোর্ট পেশ করে।
১৯৮১ সালের ১৭ মে প্রায় ছয় বছরের নির্বাসিত জীবনের অবসান ঘটিয়ে স্বদেশ ভূমিতে ফিরে আসেন শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে দীর্ঘ ২১ বছর পর আবার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসীন করেন শেখ হাসিনা।
১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর জাতীয় সংসদে কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি’ অধ্যাদেশ বাতিল করা হলে দেশের প্রচলিত আইনে স্বাভাবিক পন্থায় সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করার সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৯৭ সালের ১২ মার্চ বিচার শুরু হয়। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর বিচারক কাজী গোলাম রসুল মামলার রায় ঘোষণা করেন। ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়। এই বিচারের মধ্য দিয়ে জাতি আজ কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। এই প্রক্রিয়ার প্রথম সোপান রচিত হয়েছিল ১৯৭৯ সালের এই দিনে।
শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এসেই দলকে ঐক্যবদ্ধ করেন। দলের ভিতরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছিলেন। বার বার দেশের এই প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত গিয়েছেন। যে কারণে সংবাদ সম্মেলনে দৃঢ়তার বলতে পারেন, ‘আমি বাংলাদেশের মানুষকে চিনি; বাংলাদেশের মানুষও আমাকে চেনে।’ আমরা সবাই জানি প্রখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকার ১৯৭২ সালে ১৮ জানুয়ারিতে।সাক্ষাৎকারে এক জায়গায় ডেভিড ফ্রস্ট বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘পাকিস্তানের কারাগারের দিনগুলোতে আপনার কার কথা মনে পড়তো? আপনার সহধর্মিণীর কথা? পুত্রকন্যাদের কথা? বঙ্গবন্ধু উত্তর দিয়েছিলেন, আমার জনগণের কথা। সেই ডেভিড ফ্রস্ট ২০০৭ সালের এপ্রিল মাসে বঙ্গবন্ধুর কন্যার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন।
সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল আল জাজিরা টেলিভিশনের জন্যে, ‘এটা অনৈতিক, অগণতান্ত্রিক ও বেআইনি। আমার দেশে আমি ফিরব, তারা আটকাবে কেন? তারা মামলায় জড়িয়েছে, আমি মোকাবিলা করব। তারা জেলে ভরবে আমি জেলে যাব। কী করবে আমাকে? মেরে ফেলবে? বুলেট খরচ করবে? গ্রেনেড হামলা চালাবে? আল্লাহর ইচ্ছে থাকলে বেঁচে থাকব, না হলে চলে যাব। কিন্তু আমি দেশে ফিরব না কেন?’ আশ্চর্যজনকভাবে স্পর্শকাতর সময়ে বিশ্বখ্যাত সাংবাদিক ডেভিট ফ্রস্টের আবির্ভাব ঘটে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সেই বিখ্যাত সাক্ষাৎকারের কথা অনেকের মনে থাকবে হয়তো। বঙ্গবন্ধুকে ডেভিট ফ্রস্ট জিজ্ঞেস করেছিলেন, মি. মুজিব আপনার যোগ্যতা কি? বঙ্গবন্ধুর তাৎক্ষণিক উত্তর: আমি আমার জনগণকে ভালোবাসি। পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন, আপনার অযোগ্যতা কি? বঙ্গবন্ধুর সাবলীল উত্তর, আমি আমার জনগণকে বেশি ভালোবাসি।
চার দশক পর শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার নিলেন সেই ডেভিট ফ্রস্ট। শেখ হাসিনাকে ডেভিট ফ্রস্ট প্রশ্ন করলেন: আপনি কি আবারও দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে চান? শেখ হাসিনার উত্তর: এটা জনগণের ওপর নির্ভর করবে। আমাদের জনগণ যদি চায়, তবেই হতে পারি। এটা জনগণই ঠিক করতে পারে। আমি কীভাবে বলতে পারি?
এটা ঠিক, আমি জনগণের সেবা করতে চাই। আর আপনি জানেন, জনগণের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছি। কারণ আমাদের জনগণ খুবই গরিব, তারা সমস্যায় জর্জরিত। এ মুহূর্তে তাদের রাজনৈতিক অধিকার নেই। তাদের কথা বলার অধিকার নেই। তারা অর্থনৈতিক সমস্যায় ভুগছে। তাই আমি তাদের পাশে দাঁড়াতে চাই। কারণ আপনি জানেন, আমার পিতার একটা স্বপ্ন ছিল: তিনি দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলেন।
আমার আদর্শ একই রকম এবং আমার বাবাকে অনুসরণ করতে চাই। কারণ বাংলাদেশের মানুষ এজন্য লড়ছে। তারা গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও মৌলিক অধিকারের জন্য লড়ছে। জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার তো দূরের কথা খুনিদের পুরস্কৃত করেছে। খুনি মোশতাক করেছে ‘ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স আর জিয়া করেছে ইনডেমনিটি আইন, এরশাদ বানিয়েছে ফ্রিডম পার্টি, খালেদা জিয়া খুনিদের সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা বানিয়েছে।
২০০৭ সালের ৭ মে শেখ হাসিনাকে তৎকালীন এক/এগারো সরকারের সব বাধা অতিক্রম করে বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন। তিনি নিশ্চিত ছিলেন দেশে আসলেই গ্রেফতার করা হবে। ভয় দেখানো হয়েছিল তাকে মেরে ফেলতে পারে। তার পরও তিনি লড়াই করেছেন। বিশ্বের ৪১টি দেশের ১৫১টি শীর্ষস্থানীয় পত্রিকায় শেখ হাসিনার ফিরে আসার সংগ্রামকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ হিসেবে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ২০০৭ সালের ১৫ মার্চ থেকে ০৭ মে পর্যন্ত মোট ৫২ দিনের লড়াই বুঝিয়ে দিয়েছিল ‘বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই মূল্যায়ন কতটা সঠিক ছিল।’
যেসব অফিসার আপনার পিতা, মাতা ও তিন ভাইকে হত্যা করেছে, তারা ভেবেছিল, বাংলার মানুষের প্রতি আপনার পরিবারের সেবা-ভালোবাসার সুযোগ তারা খতম করে দিয়েছে এবং দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আশা সুদূরপরাহত করতে পেরেছে। কিন্তু আপনাকে তারা গণনায় আনতে ব্যর্থ হয়েছিল।’ ১৯৯৮ সালে এদেশে ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল। দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলো এ বন্যায় ব্যাপক প্রাণহানির আশঙ্কা করেছিল। বিবিসির মতো সংবাদ মাধ্যমগুলো অন্তত ১০ মিলিয়ন বাংলাদেশের মানুষ মারা যাবে বলে আশঙ্কা করেছিল। এই সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অমানুষিক পরিশ্রম করেছিলেন।
বন্যার পর খুদে কৃষক, বর্গাচাষি, খুদে উদ্যোক্তাদের ঋণ দেওয়ার জন্য নয়ানীতিমালা তৈরি, আদশ প্রদান, ব্যাংকের শাখায় কারা ঋণ পাচ্ছে তার তালিকা করা- এতসব যুগান্তকারী কাজকর্ম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কারণেই সম্ভব হয়েছিল। এগুলোকে আমরা যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত না বলে আর কী বলব। তার কর্মনিষ্ঠার কারণে একজন মানুষও না খেয়ে মরেনি । আশ্চর্যজনকভাবে বন্যার পরের বছর বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন বেড়েছিল ।
বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর মানুষের ওপর ঋণের বোঝা বাড়ানো হয়েছে। ধনী আরও ধনী হয়েছে, গরিব আরও গরিব হয়েছে। শেখ হাসিনা দেশে আসার পর থেকে সব সময় চেষ্টা করেছেন কীভাবে মানুষের কষ্ট লাঘব করা যায়। সেটা তিনি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় হোক কিংবা ক্ষমতার বাইরে থেকে হোক। দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সব সময় তার চেষ্টা ছিল কীভাবে দেশের জনগণের ঋণের বোঝা কমানো যায়। ১৯৯৭ সালে মাইক্রোক্রেডিট সামিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অংশগ্রহণ করেন।
সেই সময় তিনি হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। হোয়াইট হাউসের ওই সাক্ষাৎ অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা আমেরিকার প্রেসিডেন্টের কাছে দাবি করেছিলেন, বাংলাদেশ ওই সময় পর্যন্ত যে ঋণ নিয়েছিল তা যেন মওকুফ করে দেন। প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন মোট ঋণের একাংশ মওকুফ করে দেন। সেই মওকুফ করা অর্থ বাংলাদেশের পরিবেশ সংরক্ষণসহ বনাঞ্চল ও জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশের একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না আজ শেখ হাসিনার বাংলাদেশের অর্ধেক জেলায় কোনো গৃহহীন মানুষ নেই।
শেখ হাসিনা লাখ লাখ ভূমিহীন মানুষকে জমি দিয়েছেন। যে ২০২৪ এর নির্বাচনের আগে ‘টাইম’ ম্যাগাজিন প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে শেখ হাসিনাকে ‘বিস্ময়কর রাজনৈতিক নেতা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, জাতির ক্রাইসিসের সময় শেখ হাসিনাকে ছাড়া আর কাউকে পাওয়া যায় না। আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী ১৯৯৩ সালে এক লেখায় উল্লেখ করছিলেন এভাবে- ‘সপ্তাহ দুই ঢাকাতেই ছিলাম।
দেখা হতেই শওকত ভাই (শওকত ওসমান) আমার হাত ধরে বলেছিলেন, গাফ্ফার, দোহাই তোমার, হাসিনার সমালোচনা করো না। দীর্ঘকাল ধরেই তো চারদিকে তাকিয়ে দেখছি, এত জ্ঞানী-গুণী, ডান বামের বড় বড় নেতা। মুখে হাসিনার এত নিন্দা সমালোচনা। কিন্তু ক্রাইসিসের সময় হাসিনা ছাড়া কাউকে দেখি না।” বিশ্বখ্যাত পত্রিকা ‘গার্ডিয়ান’র সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আই ডু পলিটিক্স ফর দ্য পিপল’ (আমি জনগণের জন্য রাজনীতি করি)।
শেখ হাসিনার জয় মানেই বাংলাদেশের সংগ্রামের জয়। বিগত ৪২ বছরের ইতিহাস তাই প্রমাণ করেছে। তাই শেখ হাসিনা পরাজিত হওয়া মানেই সমগ্র বাংলাদেশ পরাজিত হওয়া। প্রয়াত কবি হাসান হাফিজুর রহমান বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনা আপনিই তো বাংলাদেশ। ’
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
এইচআর/জেআইএম