প্রবাস

নারীদের এ কেমন জীবন!

প্রথমের জন্মের পর থেকে আমরা শুনেছি যে কলির শ্বশুর-শাশুড়ি আর ননদ মিলে মাঝে মধ্যে তাকে মানসিক অত্যাচার করতো। সেই মানসিক অত্যাচারের ব্যাপারটা তার সৌদিপ্রবাসী জামাইকে জানালেও সে এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বিষয়টি কতটুকু সত্য তা যাচাইয়ের সুযোগ ছিল না। তবে জজ মিয়া যে খুব ভালো মানুষ ছিলেন না তা একটি ঘটনা থেকে প্রতিয়মান হয়েছিল।

Advertisement

কলির ছোট দাদা (আমার নানা) ইউনূস আলী মারা যাওয়ার পর সে দেখতে আসলো। দাদার জানাজার পর সে লাশ দেখে বাড়িতে যাওয়ার সাহস পায়নি। যেখানে কলির ছোট দাদার জানাজা হয়েছে সেখান থেকে কলির বাবা-মায়ের ঘরের দূরত্ব পঞ্চাশ মিটার। তার স্বামী বলেছিল, তুমি যদি আজ্জয়া বাপের বাইত যাও তাইলে তোমারে তালাক দিয়া দিমু। কেউ কোনও প্রতিবাদ করেনি। প্রতিবাদ করার সাহসও করেনি।

তবে আমি রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে প্রতিবাদ করে বলেছিলাম, ওই মিয়া, আফনে কিমুন বেয়াদ্দব যে কলিকে তার বাইত যাওয়ার লাইগ্যা দিতাছুইন না? কলি কী মানুষ না? একথা বলার সাথে সাথে কলির বড় চাচা আমার হাতটা চেপে ধরে বলেছিলো, বাবা নিজের মাইয়্যা অইলে বুঝবি।

ছাইড়্যা দেও। হে হের বউ লয়্যা যাউগগ্যা। কলি অহন আমরার কেউ না। এরপর কলি প্রথমকে কোলে নিয়ে মা-বাবা আর ভাই-বোনের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রিকশায় করে চলে গেলো। মনে মনে ভাবলাম, আহারে জীবন! মেয়েদের এ কেমন জীবন! সাথে সাথে এও ভাবছিলাম, যে মল্লিক মিয়ার কণ্ঠ আর শারীরিক অবয়ব দেখে বাড়ির সবাই বাঘের মতো ভয় পায় সেই লোকও কি না এত অসহায়!

Advertisement

কলির সংসার সম্পর্কে আমার চেয়ে বেশি কারো ধারণা ছিলো না। এরপর আরও বেশ কিছুদিন অতিবাহিত হয়। শুনলাম কলির আরও একটা ছেলে হয়েছে। এই ছেলের নাম রেখেছিলো শাওন। ছোট ছেলের বয়স যখন ছয় মাস তখন কলি খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। বাড়িতে আম্মার কাছে শুনলাম কলি স্ট্রোক করেছে। সম্ভবত ব্রেইন স্ট্রোক।

কলিকে ভাগলপুরের স্থানীয় একটা হাসপাতালে নেওয়া হলো। কলির অবস্থা আশঙ্কাজনক দেখে দুইদিন পর ঢাকাতে রেফার করে দিলো। ধানমন্ডির কাছে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হলো। ভালো হাসপাতালে নেওয়া হলেও এর মধ্যে কলি কোমায় চলে গিয়েছিল। ছোট ছোট দুটো বাচ্চা রেখে মৃত্যুর সাথে প্রাণপণ লড়াই।

একদিকে বাবা মায়ের অর্থের সাথে যুদ্ধ আর অন্যদিকে মেয়ের জীবন নিয়ে যুদ্ধ। ছয় থেকে সাত দিন হয়ে গেলো। বেঁচে থাকার কোনো সম্ভাবনা নেই। কলির মা-বাবা, ভাই-বোন আর মতি চাচা হাসপাতালে পড়ে রইলেন। কলিকে আইসিইউতে দেখতে গেলাম। সতেজ কিন্তু নিথর দেহ। অসুস্থতার কথা স্বামী জজ মিয়াকে বিদেশে জানানো হলো।

আরও পড়ুন

Advertisement

বীথির সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার সময় সাইকেলটা পঙ্খীরাজ মনে হয় 

সে স্পষ্ট করে বলে দিলো চিকিৎসার জন্য পনেরো হাজার টাকার বেশি দিতে পারবে না। এত আদরের সন্তান কি না অর্থের অভাবে দুনিয়া থেকে চলে যাচ্ছে! কলির বাবার যে সহায় সম্পত্তি ছিল না তা কিন্তু নয়। কিন্তু চিকিৎসার জন্য নগদ অর্থের যোগান দেওয়াও খুব কঠিন হয়ে পড়েছিল। আত্মীয়-স্বজন যার যতটুকু সাধ্য আছে পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিল। তবে যাদের খুব ভালো সামর্থ্য ছিল তারা সে সময় পাশে দাঁড়ায়নি। এমন অভিজ্ঞতা আমার আব্বার ক্যানসারের সময়ও হয়েছিল। বিপদে কে পর কে আপন তা চেনা যায়।

এরই মধ্যে চিকিৎসক জানিয়ে দিয়েছেন, আইসিউতে কলিকে রাখা মানে শুধু শুধু অর্থের অপচয়। জীবিত হয়ে ফেরার কোনো সম্ভাবনা নেই। ব্যাপারটি স্বামীকে জানানো হলে সে বিদেশ থেকে কলিকে দেখতে আসে। স্বামী এসে দেখে যে কলিকে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে।

ডাক্তার বলেছেন, এভাবে রাখার চেয়ে লাইফ সাপোর্ট খুলে ফেলাই ভালো। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও কলির মা চায়নি তার লাইফ সাপোর্ট খুলে ফেলা হোক। কিন্তু যে খরচ তা বহন করার ক্ষমতাও যে নেই! কলির রক্তের সম্পর্কের অনেকেরই অনেক অর্থকড়ি ছিল। তারা টাকা দিয়ে সাহায্য করবে তো দূরের থাক অনেকে দেখতেই যায়নি। নিজেরও তেমন স্বামর্থ্য ছিল না কলির জন্য কিছু করার।

কলির স্বামী আসার পর সিদ্ধান্ত আসলো যে তার লাইফ সাপোর্ট খুলে ফেলা হবে। কিন্তু কলির মা রাজি নন। তবে তাকে বোঝানো হলো যে, কিছু হবে না। এখন বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আবার কয়েকদিন পর নিয়ে আসলে সে সুস্থ হয়ে যাবে। তবে এরমধ্যে একটি বিষয়ে নিষ্পত্তি হলো যে, যদি কলির মৃত্যু হয় তবে তার লাশ বাবার বাড়িতে দাফন করা হবে।

যেহেতু কলি খুব আদরের এবং প্রথম সন্তান, তাই তাকে বাবার বাড়িতেই দাফন করা হবে। জজ মিয়া এই শর্তে রাজি হওয়ার পর কলির লাইফ সাপোর্ট খুলে ফেলা হলো। বাড়িতে ফেরার মাঝ পথেই অনুমিতভাবে কলির মৃত্যু হলো। মাত্র ২৪ বছর বয়সেই দুটো নিষ্পাপ প্রাণের জন্ম দিয়ে ঝরে গেলো একটা তরতাজা ও প্রাণবন্ত প্রাণ!

চলবে...

এমআরএম/জিকেএস