আইন-আদালত

কনডেম সেলে জামায়াত নেতাদের সুবিধা দিতে রিট হয়ে থাকতে পারে

মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক বা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতাদের কনডেম সেলে সুবিধা দিতে রিট আবেদন করা হয়ে থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ (এ এম) আমিন উদ্দিন।

Advertisement

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের কনডেম সেলে রাখা যাবে না মর্মে হাইকোর্টের দেওয়া রায় চেম্বার আদালতে স্থগিত হওয়ার পর নিজ কার্যালয়ে এক প্রতিক্রিয়ায় অ্যাটর্নি জেনারেল এ তথ্য জানান।

এসময় তিনি বলেন, রিটকারীদের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির নিজেও একজন জামায়াতের সমর্থক।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, হাইকোর্টের জাজমেন্টে ডাইরেকশন (নির্দেশনা) ছিল, অবজারবেশন ছিল। এগুলো যদি এখন স্টে না করা হয়, পরবর্তীতে রায় আসবে। আজ থেকে তো এটা বাতিল হয়ে গেলো। তখন সুপ্রিম কোর্ট যে ডাইরেকশনগুলো দিলেন তা বাস্তবায়ন করতেই হবে। এখন স্টে না করে পরবর্তীতে যদি দুই মাস পর রায় আসে, তখন আইনের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী কিন্তু কন্টেমে চলে যাবো আমরা, প্রথম কথা।

Advertisement

তিনি বলেন, দ্বিতীয় কথা- এখানে আইনের কতগুলো প্রশ্ন তুলেছিলাম আমরা, হাইকোর্ট যে ডাইরেকশনগুলো দিয়েছেন সেগুলো আইনগতভাবে দিতে পারেন কি পারেন না; আপিল বিভাগ কনফার্ম না করা পর্যন্ত আমরা মানবো না। এ জন্য আমরা সিপি (আপিল আবেদন) ফাইল করবো। সিপি ফাইল করার পর যদি সুপ্রিম কোর্ট বলেন ঠিক আছে, সেক্ষেত্রে মানতে বাধ্য সরকার।

রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা আরও বলেন, ফাইনালিটি পৌঁছানো, শব্দটি ছিল রুলস থার্টির একটা শব্দ অ্যাড হয়ে গেছে, সাজা কার্যকর (সেনটেন্স এক্সিকিউশন) আমরা বলছি, আদালত কোনো শব্দ আইনের সঙ্গে সংযুক্ত করতে পারেন কি না, সেটা আদালতকে দেখতে হবে। আমাদের কথা ছিল আইন যেটা আছে সেটা বলতে হবে সংসদকে। আর যুক্ত করতে হলে সেটা একমাত্র সংসদ করতে পারে, অন্য কেউ পারেন না।

তিনি জানান, আদালত শুধু ব্যাখ্যা করতে পারেন। এখানে তিনি এক্সিকিউটিবল, এটা একটি নতুন শব্দ, যেটা আইনে ছিল না। এ বিষয়গুলো আমরা তুলে ধরেছিলাম। এগুলো দেখে ঠিক না করে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়া পর্যন্ত বিষয়টি এক্সিকিউট করা যাবে না।

তিনি বলেন, সেটা বলার পর কোর্ট আমাদের আবেদন গ্রহণ করলেন এবং আপিল ফাইল না করা পর্যন্ত অর্থাৎ আগামী ২৫ আগস্ট পর্যন্ত সময় দিয়েছেন এবং আমাদের বলেছেন, এর মধ্যে আপিল আবেদন করার জন্য। বলেছি এর মধ্যে আমরা জাজমেন্ট পেয়ে আমরা আপিল আবেদন করবো।

Advertisement

এক প্রশ্নের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল প্রথমে বলেন, যেটা কোর্টে বলেছি সেটা বাইরে বলবো না।

কিন্তু পরে তিনি বলেন, আপনারা যেটা বলতে চাচ্ছেন মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দায়ের করা (যুদ্ধাপরাধীদের) কতগুলা মামলাও আছে, তাদের কিন্তু মৃত্যুদণ্ডাদেশ হয়েছে। সেই দণ্ডাদেশবিষয়ক উনাদের দলের উনি (আইনজীবী শিশির মনির) কিন্তু একজন সমর্থক। সেই দলের দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের বেনিফিট (সুবিধা) দেওয়ার উদ্দেশ্য হয়তো এদের দিয়ে মামলা করাতে পারেন। আমরা আদালতে বলেছি, হয়তো উদ্দেশ্য থাকতে পারে উনার। উনার দলীয় লোকদের সুবিধা দেওয়ার জন্য এটা করতে পরেন।

আরও পড়ুন

‘মৃত্যুদণ্ড চূড়ান্ত হওয়ার আগে কনডেম সেলে নয়’ রায় স্থগিত

বিচারিক ও প্রশাসনিক ফোরামের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত হওয়ার আগে আসামিকে নির্জন কারাবাসে (কনডেম সেল) রাখা যাবে না- মর্মে দেওয়া হাইকোর্টের রায় আগামী ২৫ আগস্ট পর্যন্ত স্থগিত করেছেন আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালত।

হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদনের শুনানি নিয়ে বুধবার (১৫ মে) আপিল বিভাগের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিমের চেম্বার জজ আদালত আদেশ দেন। এ সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষকে নিয়মিত লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করতে বলা হয়েছে।

আদালতে আজ রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ (এ এম) আমিন উদ্দিন, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ, মোহাম্মদ মেহেদী হাছান চৌধুরী ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত তালুকদার। অন্যদিকে রিট আবেদনকারীদের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।

এর আগে গত ১৩ মে মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত হওয়ার আগে আসামিকে নির্জন কারাবাসে (কনডেম সেল হিসেবে পরিচিত) রাখা যাবে না বলে রায় দেন হাইকোর্ট। আদালত বলেন, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে অন্য বন্দিদের মতোই দেখতে হবে। তবে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি বা অন্য বন্দিদের নিরাপত্তার স্বার্থে, সংক্রামক রোগ, স্বাস্থ্যগতসহ ব্যতিক্রম পরিস্থিতির কারণে তাকে কনডেম সেলে রাখতে পারবে কারা কর্তৃপক্ষ। এক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দির বক্তব্য শুনতে হবে।

এক রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে হাইকোর্টের বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি মো. বজলুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ পর্যবেক্ষণ, নির্দেশনাসহ এ রায় দেন।

বিচারিক ও প্রশাসনিক ফোরামের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত হওয়ার আগে দণ্ডিত আসামিকে কনডেম সেলে রাখার বৈধতা নিয়ে ২০২১ সালে ওই রিট করেছিলেন বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত হয়ে কনডেম সেলে থাকা তিন আসামি।

রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০২২ সালের ৫ এপ্রিল হাইকোর্ট রুল দেন। বিচারিক ও প্রশাসনিক ফোরামে মৃত্যুদণ্ডাদেশ চূড়ান্ত হওয়ার আগে দণ্ডিতকে কনডেম সেলে রাখা কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা রুলে জানতে চাওয়া হয়। চূড়ান্ত শুনানি শেষে রুল নিষ্পত্তি করে পর্যবেক্ষণ-নির্দেশনাসহ রায় দেন আদালত।

রায়ের পর অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ (এ এম) আমিন উদ্দিন বলেন, রায়ের বিষয়টি সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে। নির্দেশনা অনুসারে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তারই ধারাবাহিকতায় আলাপ-আলোচনা করে শেষ পর্ব আজ আপিল আবেদনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।

এদিকে কারা কর্তৃপক্ষের ২০২২ সালের নভেম্বরের এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, দেশের কারাগারগুলোতে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া ব্যক্তিদের জন্য ২ হাজার ৬৫৭টি সেল আছে। আর কনডেম সেলে ২ হাজার ১৬২ জন বন্দি আছেন।

ফৌজদারি কোনো মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ে আসামির মৃত্যুদণ্ড হলে ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৭৪ ধারা অনুসারে তা কার্যকরে হাইকোর্টের অনুমোদন নিতে হয়। এটি ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) হিসেবে পরিচিত। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪১০ ধারা অনুসারে বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামি হাইকোর্টে আপিল করতে পারেন।

হাইকোর্টে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকলে এর বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল করার সুযোগ আছে দণ্ডিতের।

সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন করার সুযোগ আছে। এ ছাড়া সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ অনুসারে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে পারেন। ক্ষমার আবেদন রাষ্ট্রপতি যদি নামঞ্জুর করেন, তাহলে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে আইনগত বৈধতা পায় বলে রিটে উল্লেখ করা হয়।

রিট আবেদনকারী তিন আসামির ক্ষেত্রে পৃথক মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। এর বিরুদ্ধে তাদের করা আপিল ও ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।

রায়ে হাইকোর্ট বলেছেন, দেখা যায় উচ্চ আদালতে ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তির জন্য ছয় বছর অপেক্ষা করতে হয়। এর বিরুদ্ধে আপিল করা হলে সে ক্ষেত্রে শেষ হতে আরও আট বছর লেগে যায়। এরপর রিভিউ করা হলে তা নিষ্পত্তিতে দুই বছর লেগে যায়। এ হিসাবে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির জন্য ১৫-২০ বছর অপেক্ষা করতে হয়।

দণ্ডিবিধির ৭৩ ও ৭৪ ধারা অনুসারে আসামিকে নির্জন কারাবাসে (কনডেম সেল হিসেবে পরিচিত) রাখা যায়। বিধান অনুসারে এই মেয়াদ ৩০ দিনের বেশি হবে না। এই ৩০ দিন মেয়াদে টানা ১৪ দিন এবং মাসে ৭ দিনের বেশি নির্জন কারাবাসে রাখা যাবে না। মৃত্যুদণ্ড চূড়ান্ত হওয়ার আগে দীর্ঘদিন নির্জন কারাবাসে রাখা দুবার সাজা প্রদানের শামিল।

মামলার বিচারপ্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে আদালত বলেন, বিচারিক আদালতে হত্যা মামলার বিচার শেষ হতে ৫-৬ বছর লেগে যায়। সমাজের সচেতন নাগরিক ও সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত ১২ বছরেও শেষ হয়নি। এটা দীর্ঘসূত্রতার জ্বলন্ত একটি উদাহরণ।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির জামিনের নজির দেখা যায় না উল্লেখ করে হাইকোর্ট রায়ে বলেছেন, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দি জামিন আবেদন করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪২৬ ধারা অনুসারে হাইকোর্ট বিভাগের জামিন আবেদন গ্রহণ করা উচিত।

তথ্য অধিকার আইন অনুসারে কারা কর্তৃপক্ষ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দির সংখ্যা এবং সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রি অফিস ডেথ রেফারেন্স মামলা, আসামির সাজা কমা ও খালাস বিষয়ে তথ্যাদি জানাতে বাধ্য বলে রায়ে এসেছে। ওই আইনে কেউ তথ্য চাইলে তা সরবরাহ করতে এবং সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে ও বার্ষিক প্রতিবেদনে প্রকাশ করতে বলা হয়েছে।

এফএইচ/এমকেআর/জিকেএস