গত কয়েক বছর আগেও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) বাজারদর কম থাকায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পরিকল্পনায় এলএনজি ব্যবহারে নেওয়া উদ্যোগ বাংলাদেশকে যথেষ্ট ভুগিয়েছে৷ এতে দেশের অর্থনীতিতে অস্থিতিশীল বৈশ্বিক বাজারের অভিঘাতের মাত্রাও বেড়েছে।
Advertisement
ক্রমবর্ধমান অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে আরও এলএনজি আমদানির পরিবর্তে জ্বালানি দক্ষতা বাড়ানোর পদক্ষেপ নিলে বাংলাদেশ বছরে ৪৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সাশ্রয় করতে পারবে। এমন পদক্ষেপ বাংলাদেশের ব্যয়বহুল আমদানি নির্ভরতা কমানোর ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিসের (আইইইএফএ) একটি সাম্প্রতিক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। সোমবার (১৩ মে) গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে জ্বালানি খাতের নানা দিক নিয়ে কাজ করা এ প্রতিষ্ঠানটি।
দেশের ক্রমবর্ধমান এলএনজির চাহিদা হ্রাসের এ গবেষণায় ৫১টি শিল্প কারখানার প্রায় ২৫০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন মোট ১২৪টি গ্যাসচালিত ক্যাপটিভ জেনারেটরের ওপর জরিপ চালিয়েছে আইইএফএ।
Advertisement
গবেষণায় দেখা গেছে, জেনারেটর প্রতিস্থাপনের জন্য উল্লেখযোগ্য অগ্রিম বিনিয়োগের প্রয়োজন হলেও এই মূলধন ব্যয় উঠে আসতে দেড় থেকে পাঁচ বছর সময় লাগবে। আর জেনারেটর থেকে নির্গত তাপ উৎপাদনশীল কাজে ব্যবহারের জন্য করা বিনিয়োগ মাত্র এক বছরেই তুলে আনা সম্ভব হবে। তা না করলে, জ্বালানির চাহিদা মেটাতে নতুন অবকাঠামোতে অনেক বেশি বিনিয়োগ করতে হবে৷
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ যখন এলএনজি আমদানির মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে মজবুত করার পরিকল্পনা করেছিলো তখন ধারণা ছিল না যে পরবর্তী দিনগুলোতে আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাজারের চরম অস্থিতিশীলতা, স্থানীয় মুদ্রার (টাকার) দরপতন এবং নাজুক আর্থিক পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে। এমন পরিস্থিতি মোকাবিলার বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নিয়ে ভাবাও সম্ভব হয়নি। গ্যাসভিত্তিক ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদনে দক্ষতা বৃদ্ধি এবং জেনারেটর থেকে নির্গত তাপের উৎপাদনশীল ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে এলএনজি আমদানি ৫০ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ঘনফুট হ্রাস করা সম্ভব এবং এতে বছরে ৪৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সাশ্রয় হতে পারে।
গবেষণার তথ্য বলছে, শিল্পখাতে গ্যাসচালিত ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদনের গড় দক্ষতা ৩৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ এবং উচ্চ-দক্ষতার জেনারেটর ব্যবহারে এটি ৪৫ দশমিক ২ শতাংশে উন্নীত করা সম্ভব। গ্যাসের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতায় আমদানি খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে যার ফলে ভোক্তাদের অতিরিক্ত ব্যয় করতে হচ্ছে। তাই জ্বালানি কৌশল পুনর্মূল্যায়ন করে এবং গ্যাসের ক্রমবর্ধমান চাহিদা নিয়ন্ত্রণে, জ্বালানি দক্ষতা বাড়াতে বাংলাদেশের গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন৷
নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্প্রসারণে ধীরগতি এবং নিজস্ব জ্বালানি সম্পদ আহরণে বিনিয়োগের অভাব বাংলাদেশকে বিশেষ সংকটের মুখোমুখি করেছে। কারণ, বাংলাদেশ পর্যাপ্ত জ্বালানি উৎপাদন করে না। এসব বিবেচনায় এ প্রতিবেদনে সরকারকে মধ্য থেকে দীর্ঘমেয়াদি একটি পন্থা অবলম্বনের আহ্বান জানানো হয়েছে এ গবেষণায়।
Advertisement
এক্ষেত্রে প্রতিবেদনে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানো। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, শুধু গ্যাসভিত্তিক বেইজ লোড প্ল্যান্ট-এর পরিবর্তে কিছু (গ্যাসভিত্তিক) পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট তৈরি করা। যেন জাতীয় গ্রিডে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সংযোগ বাড়ানো হলে এই পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টগুলো নবায়নযোগ্য জ্বালানির অনুপস্থিতিকালে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারে৷ বিকল্প উপায় হিসেবে পুরোনো যে গ্যাস-চালিত কম্বাইন্ড-সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো ভবিষ্যতে বাতিল করা হবে তাদের গ্যাস টারবাইনগুলো রেখে দেওয়া। নবায়নযোগ্য জ্বালানি যখন ব্যবহার করা যাবে না এ গ্যাস টারবাইনগুলো তখন বিদ্যুৎ দিতে পারবে৷
এছাড়াও সামগ্রিকভাবে শিল্পোৎপাদন প্রক্রিয়ায় জ্বালানির অদক্ষ ব্যবহার থেকে সরে আসার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। করপোরেট বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির মাধ্যমে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ক্রয়ে সুযোগ করে দেওয়া আহ্বান জানানো হয় সেখানে৷ এসব পদক্ষেপ ক্যাপটিভ উৎপাদনে দক্ষতাই বাড়াবে না, গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতাও কমিয়ে আনতে অনেক বেশি সহায়তা করবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে৷
আমদানি করা এলএনজির সঙ্গে বাংলাদেশের নাতিদীর্ঘকালের অনিশ্চিয়তাপূর্ণ সম্পর্ক এবং একসময়ের সাশ্রয়ী জীবাশ্ম জ্বালানি কীভাবে দ্রুত অর্থনৈতিক ঝুঁকি হয়ে উঠলো সেটি এ গবেষণায় উঠে এসেছে।
বাংলাদেশের জ্বালানি খাত বিষয়ক প্রতিষ্ঠান আইইইএফএর প্রধান বিশ্লেষক এবং গবেষণা প্রতিবেদনের লেখক শফিকুল আলম বলেন, গ্যাসের ক্রমবর্ধমান চাহিদায় অস্থিতিশীল জ্বালানি এলএনজির ওপর নির্ভরশীলতা মাত্রাতিরিক্ত বাড়লে বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও ঝুঁকিতে পড়বে।
তিনি বলেন, ২০১৮ সালে বাংলাদেশ যখন সাশ্রয়ী দামে এলএনজি আমদানি শুরু করে তখন তা সঠিক সিদ্ধান্ত বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু ঠিক এক বছরের মাথায় এলো কোভিড-১৯ এবং একই সঙ্গে এলএনজির সরবরাহ-শৃঙ্খল (সাপ্লাই চেইন) বিঘ্নিত হলো। এরপর ২০২২ সালে শুরু হল ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। ফলে বিশ্বব্যাপী জ্বালানির দাম এক লাফে অনেকখানি বেড়ে গেল, যা দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সংকটকে আরও তরান্বিত করলো।
শফিকুল আলম বলেন, দেশের উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত জ্বালানি আমদানির পরিকল্পনা করা হলেও আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির মাত্রাতিরিক্ত অস্থিতিশীলতা, স্থানীয় মুদ্রার দরপতন এবং তার আর্থিক অভিঘাত মোকাবিলার বিষয় বিবেচনায় রাখা হয়নি। বিভিন্ন খাতে গ্যাসের ক্রমবর্ধমান চাহিদার জন্য এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে। যেমন, গ্রিড বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের অভাবে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পণ্য উৎপাদন অব্যাহত রাখার জন্য এবং ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদনের খাতিরে গ্যাসের উপর নির্ভর করতে হয়। আর এখানেই রয়েছে সমাধানের পথ।
তার মতে, গ্যাসভিত্তিক ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানির অদক্ষ ব্যবহারের ফলে বছরে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ গ্যাস খরচ হয়। গত দশকে ক্যাপটিভ জেনারেশনের গড় দক্ষতা ৩০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩৫ দশমিক ৩৮ শতাংশে উন্নীত হলেও এ খাতে আরও জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে।
শফিকুল আলম মনে করেন, সাশ্রয়ী জ্বালানির যুগ শেষ হতে চলেছে। কারণ, সরকার অদূর ভবিষ্যতে আরও প্রতিযোগিতামূলক দামে জ্বালানি সরবরাহ করবে। ফলে জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ শিল্প কারখানাগুলোকে অর্থ সাশ্রয়ের দিক থেকে বেশি লাভবান করবে। জ্বালানি সাশ্রয়ে পদক্ষেপ গ্রহণে দেরি করলে রপ্তানিমুখী শিল্প কারখানাগুলো আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যেতে পারে।
জ্বালানি দক্ষতা বাড়ানোর লক্ষ্যে নীতিগত ভিত্তি বাংলাদেশে এরই মধ্যে রচিত হয়েছে। যেমন, অনেক বেশি জ্বালানি ব্যবহৃত হয় এমন স্থাপনা ও কারখানায় এখন জ্বালানি নিরীক্ষা বাধ্যতামূলক। এক্ষেত্রে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি সম্প্রসারণের উদ্দেশে প্রতিষ্ঠিত স্রেডা (টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) দ্রুত জ্বালানি দক্ষতা বাড়াতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।
তবে দেশের জ্বালানি খাতকে আরও সুরক্ষিত ও টেকসই ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিতে বৃহত্তর সহায়তা, প্রণোদনা এবং অর্থায়ন নিশ্চিত করার বিকল্প নেই বলে মনে করেন শফিকুল আলম৷
তিনি বলেন, পুরোপুরি নিজস্ব জ্বালানির ওপর নির্ভরতা আমাদের জন্য অনেকটাই অসম্ভব। তবে নীতিমালা প্রণয়ন করে অবশ্যই আমদানি নির্ভরতায় লাগাম টেনে ধরার উপায় খুঁজে বের করতে হবে। এলএনজি আমদানি নির্ভরতা কমাতে বাংলাদেশের সময় লাগবে। এক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকদের এখনই পরিকল্পনা ও তৎপরতা শুরু করতে হবে, যেন বাংলাদেশ পরবর্তী বৈশ্বিক ধাক্কা সামাল দিতে পারে৷
এনএস/এমকেআর/এএসএম