কৃষি ও প্রকৃতি

ইউক্যালিপটাস-রেইনট্রি কতটা ক্ষতিকর, কতটা লাভজনক?

তীব্র গরমে ফেসবুকে গাছের সংখ্যা ঘোষণা দিয়ে গাছ লাগানোর হিড়িক পড়ে গেছে। দাম কম এবং দ্রুত বর্ধনশীল বলে অনেকেই ইউক্যালিপটাস ও রেইনট্রি গাছ রোপণ করছেন। তবে ইউক্যালিপটাস প্রচুর পরিমাণে পানি শোষণ করায় ২০০৮ সালে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনে এ গাছের চারা উৎপাদন নিষিদ্ধ করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ইউক্যালিপটাস রেইনট্রি গাছ ক্ষতিকর, পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে এবং গাছগুলো রোপণ ও চারা তৈরিতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। তবুও এ দুটি গাছের রোপণ থেকে পিছু হটছে না বৃক্ষপ্রেমীর।

Advertisement

মূলত ইউক্যালিপটাস-রেইনট্রি আমাদের দেশের মেহগনি, সেগুনের মতোই অ্যাক্সোটিক (বাইরে থেকে আগত) উদ্ভিদ যা আমাদের দেশের পরিবেশের সঙ্গে ভালোভাবে খাপ খেয়েছে।

ইউক্যালিপটাস মূলত কাষ্ঠল গাছ যা প্রকৃতিগতভাবে অস্ট্রেলিয়ায় জন্মে। আমাদের দেশে সাধারণত ক্যামালডোলেনসিস, সাইট্রিওডোরা ও টেরেটিকরনিস এ তিন ধরনের ইউক্যালিপটাস দেখা যায়। অন্যদিকে রেইনট্রি দক্ষিণ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে প্রাকৃতিকভাবে জন্মে থাকে।

বৈজ্ঞানিক গবেষণা অনুযায়ী ইউক্যালিপটাসকে মোটা দাগে দুটি কারণে নিরুৎসাহিত করা হয়। ইউক্যালিপটাস জীব বৈচিত্র্যের কিছুটা বিরূপ প্রভাব ফেলে এবং এটি অত্যধিক পানি গ্রহণ করে। অন্যদিকে রেইনট্রি গাছের বিশেষ কোনো ক্ষতিকর দিক নেই। বরং রেইনট্রি গাছ দ্রুত বর্ধনশীল ও ক্যানোপি (গাছের ডালপালা) বেশি হওয়ায় অল্প দিনেই ছায়া দিয়ে পরিবেশ শীতল করতে ভূমিকা রাখে।

Advertisement

তবে ইউক্যালিপটাসকে নিষিদ্ধ করা হলেও এটি দূরীকরণ এখনো সম্ভব হয়নি। এর কারণ সম্পর্কে জানা গেছে, আমাদের দেশের দরিদ্র কৃষক ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী মূলত গাছ চাষ করে নগদ টাকার জন্যে। নগদ টাকার জন্যে তাদের সবচেয়ে পছন্দের তালিকায় থাকে ইউক্যালিপটাস। কেননা এর চারার দাম কম, দ্রুত বর্ধনশীল এবং ডালপালা কম থাকায় অন্যান্য ফসলে ছায়াজনীত সমস্যার সৃষ্টি করে না। আবার সেগুন, মেহগনিসহ অন্যান্য কাষ্ঠল গাছ থেকে ভালো মানের কাঠ পেতে ন্যূনতম ১৫-২০ বছর অপেক্ষা করা লাগে যেখানে ইউক্যালিপটাস থেকে কাঠ পেতে প্রয়োজন মাত্র ৫-৮ বছর। ইউক্যালিপটাস গাছ থেকে দ্রুত নগদ টাকা পেয়ে পুনরায় ওই জমিতে অন্যান্য ফসল অথবা ইউক্যালিপটাস চাষ করে থাকেন তারা।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বনায়ন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. শাহরিয়ার জামান এ বিষয়ে জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের পুরো দেশে বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের কৃষকেরা অপরিকপ্লিতভাবে ধানের জমির আইল ও ফসলের জমিতে ইউক্যালিপটাস লাগিয়েছে। যার দরুণ জমিতে পানি কমে যাওয়া এবং ফসল ফলাতে অতিরিক্ত পানি প্রয়োজনের কারণে এটি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।

তিনি বলেন ২০২৩ সালের বিখ্যাত ফরেস্ট ইকোলজি অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট জার্নালের উঠে এসেছে, একটি ইউক্যালিপটাস গাছ দিনে পানির প্রাপ্যতার ওপর ভিত্তি করে ৫০-৯০ লিটার পর্যন্ত পানি গ্রহণ করে থাকে। অন্যদিকে ধান চাষাবাদে এক কেজি ধান ফলাতে প্রায় ২৫০০-৩০০০ লিটার পানির প্রয়োজন হয়। ধানের জমিতে ইউক্যালিপটাস গাছ কোনো প্রকার কৃষি বনায়নের পরিকল্পনা না মেনে লাগানো হলে ধানে পানির স্বল্পতা বৃদ্ধি পায়, খরচ বাড়ে, অন্যদিকে রুট কম্পিটিশনের কারণে ফলন কমে। তাই যে স্থানে পানির স্বল্পতা বিরাজমান সেখানে কোনোভাবেই এই গাছ লাগানো যাবে না বলে তিনি মত দেন।

তবে ইউক্যালিপটাস গাছ যদি কৃষি বনায়নের পরিকল্পনামাফিক পানির আধিক্য যাচাই করে চাষাবাদ করা হয় তবে প্রচুর লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। ইউক্যালিপটাসের পাতার নির্যাস থেকে অতি গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টিসেপটিক জাতীয় তৈল পাওয়া যায় যা বহির্বিশ্বে সিনে-ওয়েল নামে পরিচিত এবং বিদেশে এর দাম ও বাজার মূল্য অনেক বেশি। এটি হাঁটু এবং হাড়ের অস্থিসন্ধির ব্যথা উপশম করে। শুধু তাই নয় ভারতেও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় ইউক্যালিপটাসের তেল বহুল ব্যবহৃত হয়। অস্ট্রেলিয়ার নিউসাউথ ওয়েলস প্রদেশের পরিবেশ বিভাগের গবেষণায় ইউক্যালিপটাসকে নেকটার ফিডিং গাছ হিসেবে পরিগণিত করেছে যা পরাগায়নে সাহায্যকারী পতঙ্গের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

Advertisement

ড. মো. শাহরিয়ার জামান আরও বলেন, ২০১৮ সালের এলসভিয়ার এর গ্লোবাল ইকোলজি অ্যান্ড কনসারভেশন জার্নালে উঠে এসেছে যে, ইউক্যালিপটাসকে যদি নাইট্রোজেন ফিক্সিং আকাশমনি অথবা সাদা কিংবা কালো কড়ই গাছের সঙ্গে পারিকল্পিত উপায়ে লাগানো হয় তা মাটির উর্বরতা ও ফলন বাড়ায়। তবে দুঃখের ব্যাপার এই যে ইউক্যালিপটাস গাছ থেকে যে উপকারি পণ্যগুলো পাওয়া যায় তার ব্যবহার বা বাণিজ্যিকীকরণ আমরা এখনো রপ্ত করতে পারি নি। ফলে আপাত দৃষ্টিতে মনে হয়ে থাকে ইউক্যালিপটাস চাষে লাভের চেয়ে ক্ষতির সম্ভাবনা বেশি।

আর রেইনট্রি সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রকৃতিতে প্রত্যেক জিনিসের ক্ষতি এবং উপকার দুটিই দিকই আছে। রেইনট্রির ক্ষেত্রে দেখা যায় ডালপালা দ্রুত বৃদ্ধি পায় ফলে অনেক সময় ভারি ঝড় হলে এগুলো ভেঙে যেতে পারে এবং এর বৃহৎ মূল কখনো কখনো চলাচলের রাস্তা কিংবা ফুটপাত ভেদ করে উপরে উঠে আসে। এছাড়া রেইনট্রির আপাত দৃষ্টিতে মারাত্মক কোন ক্ষতিকর দিক নেই।

তাসনিম আহমেদ তানিম/এমআইএইচএস/এমএস