টানা চার বছর ধরে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় সিলেটে পাসের হার কমছেই। জিপিএ-৫ এ কিছুটা ছন্দপতন হলেও পাসের হারে পিছিয়ে পড়েছে সিলেট শিক্ষাবোর্ড। এ বছরও সেই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেনি সিলেট। গতবারের মতো এবারও জায়গা হয়েছে তলানীতে। দেশের ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে সবার পেছনে সিলেট।
Advertisement
পাসের হারের সঙ্গে এবার জিপিএ-৫ প্রাপ্তিতেও সবার পেছনে সিলেট। অর্থাৎ দুই সূচকেই তলানীতে সিলেট শিক্ষাবোর্ড। বোর্ড কর্তৃপক্ষ এ ব্যর্থতার জন্য গণিত ও সাধারণ বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষার্থীদের খারাপ ফলাফলকে দায়ী করছে। একইসঙ্গে দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষক সংকটের কথাও বলছে।
তবে শিক্ষকরা বলছেন, অভিভাবকদের উদাসীনতা, বিদেশমুখী প্রবণতা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তথা মোবাইল ব্যবহারের প্রতি ঝোঁক বেড়ে যাওয়ায় পড়াশুনা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। একইসঙ্গে পাবলিক পরীক্ষায় ঢালাওভাবে পাসের কারণে পড়াশুনার প্রতি মনোযোগ হারাচ্ছে শিক্ষার্থীরা।
অপরদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষকদের প্রশিক্ষিত করা হলেও মাঠ পর্যায়ে তদারকি, অভিভাবকদের খামখেয়ালীপনা ও বোর্ড কর্তৃপক্ষের কড়াকড়ির অভাবে ফলাফলে ধস নেমেছে। এটা পুরো জাতির জন্য অশনিসংকেত।
Advertisement
এ বছর সিলেট বোর্ডে পাসের হার ৭৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ। গত বছর পাসের হার ছিল ৭৬ দশমিক ০৬ শতাংশ। গতবারের তুলনায় পাসের হার কমেছে ২ দশমিক ৭১ শতাংশ। এবার সিলেট বোর্ড থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৫ হাজার ৪৭১ জন শিক্ষার্থী। গতবার জিপিএ-৫ পেয়েছিল ৫ হাজার ৪৫২ জন।
সিলেট বোর্ডের গত ৫ বছরের পরিসংখ্যান থেকে দেখা গেছে, ২০২১ সালে পাসের হার ছিল ৯৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এরপর থেকেই কমতে শুরু করে পাসের হার। ২০২২ সালে ৭৮ দশমিক ৮২ শতাংশ, ২০২৩ সালে তা আরও কমে দাঁড়ায় ৭৬ দশমিক ০৬ শতাংশ। সর্বশেষ এবছর পাসের হার আরও কমে দাঁড়িয়েছে ৭৩ দশমিক ৩৫ শতাংশে।
টানা চার বছর পাসের হার ধারাবাহিকভাবে কমলেও জিপিএ-৫ এ ছন্দপতন ঘটেছে। ২০২১ সালে জিপিএ-৫ পেয়েছিল ৪ হাজার ৮৩৪ জন, ২০২২ সালে ৭ হাজার ৫৬৫ জন, ২০২৩ সালে ৫ হাজার ৪৫২ জন এবং সর্বশেষ এবছর জিপিএ-৫ পেয়েছে ৫ হাজার ৪৭১ জন।
পাসের হার ও জিপিএ-৫ এ প্রতিবারের মতো এবারও ভালো করেছে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা। এ বছর ৫ হাজার ৪৭১ জন জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর মধ্যে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পেয়েছে ৫ হাজার ১৩৪ জন। আর মানবিক বিভাগ থেকে ২৪৪ জন ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে ৯৩ জন। এ বছর সিলেট বোর্ডের অধীনে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল ১ লাখ ৯ হাজার ৭৩ জন শিক্ষার্থী। এরমধ্যে পাস করেছে ৮০ হাজার ৬ জন। পাস করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৩৩ হাজার ৪০৬ জন ছেলে ও ৪৬ হাজার ৬০০ জন মেয়ে।
Advertisement
খারাপ ফলফলের পেছনে অভিভাবকের উদাসীনতা ও শিক্ষার্থীদের বিদেশমুখী প্রবণতাকেও দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। একইসঙ্গে শিক্ষকদের গাফিলতির কথাও বলছেন তারা।
সিলেট সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর আব্দুল সাজিদ বলেন, সিলেটে দক্ষ শিক্ষকের অভাব নেই। কিন্তু শিক্ষকরা যে প্রশিক্ষণ নিয়ে যান সেটা কতটুকু প্রয়োগ করেন সেটা ভাবার বিষয়।
তিনি বলেন, প্রতি বছর সিলেটে তিন থেকে চার সেশনে শিক্ষকদের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কিন্তু শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের ওপর সেটা ভালো করে প্রয়োগ করতে না পারলে লাভ হবে না। এজন্য শুধু প্রশিক্ষণ না দিয়ে প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে আরও তদারকি বাড়াতে হবে।
সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও ডিন শিক্ষাবিদ আবুল ফতেহ ফাত্তাহ বলেন, প্রথমত আমরা যারা শিক্ষক ও অভিভাবক রয়েছি আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করতে পারছি না। দ্বিতীয়ত, যেভাবে আমাদের শিক্ষার্থীদের পাঠ উপযোগী করে তোলার কথা সেক্ষেত্রেও আমরা পারছি না। তাদের মধ্যে নানা উপসর্গ রয়েছে। কারণ তারা দেখছে তাদের ভাইবোন বিদেশ চলে যাচ্ছে। সেজন্য সে বড় হয়ে ভালো চাকরি করবে সেই চিন্তা নেই। তাদের চিন্তা চেতনার মধ্যে একটা অস্থিরতা কাজ করছে। এই অস্থিরতা মনোযোগটাকে কেড়ে নিচ্ছে।
তৃতীয়ত তিনি বলেন, শিক্ষকরা যে দায়িত্ব পালন করছেন সেই দায়িত্বে নিঃসন্দেহে একটা ফাঁকফোকর রয়েছে। তা না হলে অন্য জেলার ছেলেমেয়েরা ভালো ফলাফল করছে। আমার জেলার ছেলেমেয়েরা কেন পারছে না। এসবের জবাব খুঁজে বের করতে পারলে তলানী থেকে উত্তোরন সম্ভব।
শিক্ষকদের মন্তব্যসিলেট বোর্ডের সার্বিক ফলাফল খারাপ প্রসঙ্গে চারজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের। তবে কেউই নাম প্রকাশ করতে চাননি।
শিক্ষকরা বলছেন, অভিভাবকদের উদাসীনতা, শিক্ষার্থীদের বিদেশমুখী প্রবণতা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতি ঝোঁক বেড়ে যাওয়ায় তারা পড়াশুনায় মনোযোগ হারিয়ে ফেলছে। বিশেষ করে পাবলিক পরীক্ষায় ‘ঢালাওভাবে’ পাস করার প্রবণতাও খারাপ ফলাফলের জন্য দায়ী।
তারা আরও বলেন, অনেক সময় নির্বাচনী পরীক্ষায় অকৃতকার্য শিক্ষার্থীকে প্রতিষ্ঠান থেকে আটকানো হয়। কিন্তু বিভিন্ন মহল থেকে সুপারিশ করে এসব শিক্ষার্থীকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করানো হয়। পরবর্তীতে এসব শিক্ষার্থীরাই ফলাফল খারাপ করে। যার প্রভাব পড়ে সার্বিক ফলাফলে। তবে প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেটে অভিভাবকের উদাসীনতা ও শিক্ষার্থীদের বিদেশমুখী প্রবণতাকেই বিশেষ করে দায়ী করছেন শিক্ষকরা।
সিলেট শিক্ষা বোর্ডের বক্তব্যসিলেট শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অরুণ চন্দ্র পাল জাগো নিউজকে বলেন, এ বছর বিজ্ঞান ও গণিত বিষয়ে পাসের হারের প্রভাব পড়েছে গড় ফলাফলে। এবার সাধারণ বিজ্ঞান বিষয়ে পাসের হার ৮৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ। গত বছর পাসের হার ছিল ৯৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ। তাছাড়া গণিতে পাসের হার ছিল ৮৯ দশমিক ২২ শতাংশ। গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষার্থীরা ভালো ফলাফল করতে পারেনি। যার কারণে ফলাফলে পিছিয়ে পড়েছে সিলেট বোর্ড।
সাধারণ বিজ্ঞানে খারাপ ফলাফল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রশ্নগুলো লটারির মাধ্যমে আসে। এক বোর্ডের প্রশ্ন যায় অন্য বোর্ডে। সিলেটে এসেছে অন্য বোর্ড থেকে। যার কারণে সাধারণ বিজ্ঞান বিষয় অনেকটা কঠিন হয়েছে। অনেক সময় সিলেবাসে থাকার পরও প্রশ্ন কঠিন করে করা হয়। যেহেতু সিলেবাসের মধ্যেই প্রশ্ন ছিল, তাই সেটাকে কঠিনও বলা যাবে না। তবে অনেকটা ভাগ্যও বলা যেতে পারে।
তিনি আরও বলেন, সিলেট অঞ্চলে ভালো ও দক্ষ শিক্ষকের অভাব দীর্ঘদিনের। তবে এনটিআরসিএ’র মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় দক্ষ শিক্ষকের ঘাটতি পূরণ হচ্ছে। তবে শিক্ষক সংকট এখনও রয়েছে। উপজেলা পর্যায়ে অনেক সরকারি বিদ্যালয়েও শিক্ষক সংকট রয়েছে। এসব কারণে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়ছে। বিশেষ করে মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে রয়েছে। যার কারণে পাসের হারও মানবিক বিভাগে কম।
প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকরা প্রতিষ্ঠানে কতটুকু প্রয়োগ করছেন এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানগুলো তদারকির জন্য মাউশি রয়েছে। কিন্তু মাউশি এ কাজ কতটুকু করছে তারা বলতে পারবে। প্রতিষ্ঠানভিত্তিক মাউশি বা শিক্ষা কর্মকর্তাদের তদারকি আরও বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
পাবলিক পরীক্ষায় ‘ঢালাওভাবে’ পাসের বিষয়ে তিনি বলেন, বোর্ড কর্তৃপক্ষের ঢালাওভাবে পাস দেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ প্রশ্ন করেন শিক্ষক, পরীক্ষা নেন শিক্ষক, খাতা মূল্যায়নও করেন শিক্ষক। এখানে বোর্ডের কোনো হাত নেই।
ভালো ফলাফলের জন্য অভ্যন্তরীণ পরীক্ষায় কড়াকড়ি করা উচিত উল্লেখ করে বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বলেন, এতে বোর্ডের পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কিছু কমবে। কিন্তু গুণগত মান বাড়বে। পরীক্ষায় ফরম পূরণের জন্য আমাদের পূর্বশর্ত হলো নির্বাচনী পরীক্ষায় পাস করতে হবে। তবে ভালো শিক্ষার্থী নির্বাচনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে না পারলে মানবিক দিক বিবেচনা করতে বলা হয়। তবে সেটা ফেল করা শিক্ষার্থীর জন্য কোনোভাবেই নয়।
আহমেদ জামিল/এফএ/জিকেএস