মতামত

অর্থনীতি গতি ফিরে পাবে কবে?

অর্থনীতি আমার কাছে বেশ জটিল মনে হয়। ক্রলিং পেগ, সুদহার, নীতি সুদহার, কলমানি রেট, রিজার্ভ, ডলার সংকট, ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও, ওভার ইনভয়েস, আন্ডার ইনভয়েস- অর্থনীতির অনেক টার্ম বুঝি না। আমরা আমজনতা একটা জিনিসই বুঝতে চাই, আমার যা আয় আছে, তা দিয়ে যেন স্ত্রী-সন্তান নিয়ে মোটামুটি খেয়েপরে বাঁচতে পারি। কিন্তু এই জায়গাটাতেই সমস্যা। আয়ের সাথে ব্যয়ের মিল থাকছে না। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়ে গেছে। এক দুই মাস হলে হয়তো সামাল দেওয়া যেতো। কিন্তু আয়-ব্যয়ের এই গরমিল চলছে বছরের পর বছর।

Advertisement

হতদরিদ্র, দরিদ্র, নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে অনেক আগেই। ঘুরে দাঁড়ানোরও কোনো সুযোগ নেই। মূল্যস্ফীতি ডাবল ডিজিটে স্থির হয়েছে অনেক আগেই। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে। সরকার সেটা জানে না, তা নয়। গত নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে অগ্রাধিকার তালিকায় এক নম্বরে ছিল দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ। নতুন মন্ত্রিসভায় ডায়নামিক বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি দারুণ দৌড়ঝাঁপ করছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এখনও দ্রব্যমূল্য আকাশেই আছে।

আওয়ামী লীগ এখন টানা চতুর্থ মেয়াদে দেশ শাসন করছে। আগের তিনটি মেয়াদ যতটা সাফল্যে মোড়ানো ছিল, এই মেয়াদ তেমনটি নয়। এই মেয়াদে চ্যালেঞ্জ অনেক বেশি। দেশের মানুষের স্বার্থেই এ চ্যালেঞ্জ উতড়ানো জরুরি। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে আওয়ামী লীগের মূল লক্ষ্য ছিল উন্নয়ন। শেখ হাসিনার সাহসী ও দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ পরিণত হয় উন্নয়নের রোল মডেলে।

পদ্মা সেতু, এক্সপ্রেসওয়ে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, টানেল, মেট্রোরেল, সাবমেরিন, স্যাটেলাইট, পারমাণবিক বিদ্যুৎ- উন্নয়নের একের পর এক চমকে সবাই গর্বিত। এই সময়ে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার মর্যাদা অর্জন করেছে। সব সামাজিক সূচকেও বাংলাদেশের বদলে যাওয়ার ছবি পরিষ্কার। বাংলাদেশের অর্থনীতি যে দারুণ মোমেন্টাম পেয়েছিল, কোভিড এসে তাতে প্রথম ধাক্কা দেয়। কোভিডের ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এসে শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বের অর্থনীতি টালমাটাল করে দেয়। সেই যুদ্ধ থামে তো নাইই, উল্টো ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের আগ্রাসন মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।

Advertisement

কোভিড এবং যুদ্ধের অভিঘাত গোটা বিশ্বেই লেগেছে। কিন্তু শক্তিশালী অর্থনীতির দেশগুলো তা সামাল দিতে পারলেও বাংলাদেশের মতো বিকাশমান অর্থনীতির পক্ষে তা সামাল দেওয়া সম্ভব ছিল না। সে কারণেই ২০০৯ থেকে ২০২১ পর্যন্ত অর্থনীতির যে গতি তা ২০২১ সালের পর থেকে উল্টো পথে হাঁটতে থাকে। বাড়তে বাড়তে বাংলাদেশের রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল। কমতে কমতে তা এখন ২০ বিলিয়ন ডলারে নিচে নেমে এসেছে।

ডলারের বাজারের অস্থিরতা টালমাটাল করে দিয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভারসাম্য। দীর্ঘদিন টাকার সাথে ডলারের বিনিময় মূল্য ৮৫ টাকার আশেপাশে থাকলেও এখন সরকারি ভাবেই তা ১১৭ টাকা। খোলাবাজারে তা ১২৫ টাকা ছাড়িয়েছে। আমানত ও ঋণের সুদের হার দীর্ঘদিন ৬-৯ এ আটকে রাখা হলেও এখন তা বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে আমদানি খরচ বেড়েছে, উৎপাদন খরচ বেড়েছে, ব্যবসার ব্যয় বেড়েছে। সরাসরি যার প্রভাব পড়েছে সাধারণ মানুষের ওপর।

অর্থনীতির চাপ সামাল দিতে সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ’এর দ্বারস্থ হয়। দীর্ঘ মূল্যায়ন শেষে আইএমএফ ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ মঞ্জুর করে। এরই মধ্যে ঋণের দুই কিস্তি ছাড় হয়েছে। তৃতীয় কিস্তি ছাড় করতে আইএমএফ প্রতিনিধিরা দুই সপ্তাহের সফরে বাংলাদেশে আসেন। নানান বৈঠক শেষে তারা তৃতীয় কিস্তির অর্থ ছায়ে সম্মত হয়েছেন। আশা করা যায়, এ মাসেই তৃতীয় কিস্তির অর্থ পাওয়া যাবে।

তবে চাইলেই আইএমএফ’এর ঋণ পাওয়া যায় না। এজন্য মানতে হয় তাদের নানা শর্ত। এ পর্যন্ত আইএমএফ যে যে শর্ত দিয়েছে, তার সবগুলোর সাথেই আমি একমত। ব্যাংকখাতে সংস্কার, রাজস্ব আয় বাড়ানো, খেলাপি ঋণ কমানো, ভর্তুকি কমানো- ঠিকঠাক মতো কাজগুলো করতে পারলে দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের অর্থনীতি মজবুত হবে। কিন্তু সমস্যা হলো সময় খারাপ।

Advertisement

অর্থনীতির এই দুঃসময়ে এসব সংস্কার করতে গেলে তার অভিঘাত লাগে সাধারণ মানুষের গায়ে। ভর্তুকি কমানোর অনেক উপায় আছে। টেকসইভাবে ভর্তুকি কমাতে হলে অপচয়, দুর্নীতি কমাতে হবে, দক্ষতা বাড়াতে হবে। কিন্তু সরকার কঠিন পথে না গিয়ে সহজ পথে হেঁটেছে।

ফলে দফায় দফায় বেড়েছে তেল-গ্যাস-বিদ্যুতের দাম। জ্বালানির দাম বাড়লে সবকিছুর দামই বাড়ে। রাজস্ব আয় বাড়ানোর টেকসই উপায় হলো রাজস্ব জাল দেশজুড়ে বিস্তৃত করা। কর দেওয়ার মতো সব মানুষকে করজালের আওতায় আনা। কিন্তু সেই কঠিন পথে কখনোই হাঁটার সাহস দেখায় না রাজস্ব বোর্ড। তারা বরং করছাড় কমিয়ে, করহার বাড়িয়ে আয় বাড়াতে চায়। তাতে চাপ পড়ে নির্দিষ্ট কিছু লোকের ওপর। নির্দিষ্ট চাকরি যারা করেন, মানে যারা রাজস্ব বোর্ডের আওতায় আছেন, তাদের নিয়েই চলে কচলাকচলি।

 

এখন সবার অপেক্ষা এই দুঃসময় কাটিয়ে অর্থনীতি কবে আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। বাংলাদেশের যে সম্ভাবনা, তাতে ঘুরে দাঁড়ানো অসম্ভব নয়। তবে অর্থনীতির টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে ব্যাংকখাতে আন্তরিক সংস্কার করতে হবে, খেলাপি সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে, যারা ব্যাংকের টাকা নিয়ে মেরে দিয়েছে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে, টাকা পাচার বন্ধ করতে হবে, দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে, দক্ষতা বাড়াতে হবে, সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে।

 

ঠিকঠাক মতো ভ্যাট আদায় করতে পারলেও রাজস্ব আয় বাড়ানো সম্ভব ছিল। কিন্তু সাধারণ মানুষ ভ্যাট দিলেও তার পুরোটা সরকারের কোষাগারে জমা পড়ে না। আইএমএফ বারবার ব্যাংকখাত সংস্কারের কথা বলে আসছে। এবার আইএমএফ টিম আসার আগেই বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল ব্যাংকের সাথে একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছিল।

উদ্যোগটি দৃশ্যত ভালো হলেও যারা ব্যাংকগুলোকে দুর্বল করলো তাদের শাস্তি না দিয়ে একীভূত করার উদ্যোগের সমালোচনা করেন অনেকে। তার পরও ব্যাংকের সংখ্যা কমিয়ে আনা গেলে সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির জন্য ভালো হতো। কিন্তু সে উদ্যোগও মুখ থুবড়ে পড়েছে।

আইএমএফ প্রতিনিধিদল থাকতে থাকতেই গত সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংক সুদহার বাজারভিত্তিক করা এবং ডলারের দাম এক লাফে ১১০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১১৭ টাকায় নির্ধারণ করে। দীর্ঘমেয়াদে এ সিদ্ধান্তও বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য ভালোই হবে। কিন্তু এর চেয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া, সেটা সামাল দেওয়ার মতো সক্ষমতা এই মুহূর্তে বাংলাদেশের অর্থনীতির নেই।

সুদহার বাড়লে সেটা ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যাক্তাদের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করবে। যাতে উৎপাদন খরচ বাড়বে। ডলারের দাম বাড়ার প্রভাব তো সর্বগ্রাসী। সব ধরনের আমদানি পণ্যের দাম বাড়বে। বিশেষ করে জ্বালানি ও সারের ওপর এর প্রবল ও সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশের খরচ বাড়বে। সব মিলিয়ে বাজারে আরেক দফা উল্লম্ফনের শঙ্কায় কাঁপছেন অনেকে।

এতসব নেতিবাচক প্রভাবের মধ্যেও আমরা যে এখনও আরাম করে খেতে পারছি, তার কৃতিত্ব পুরোটাই কৃষকের। তারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, বছরের পর বছর ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েও যেভাবে ফসল ফলাচ্ছেন, তাতে তাদের প্রতি কুর্ণিশ। এবারও যেমন ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। সামনে আমরা বিদ্যুৎ পাই আর না পাই, খাওয়ার হয়তো অভাব হবে না।

এমনিতেই খরচ বেড়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের আয় বাড়েনি। বরং মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় কমে গেছে। কোভিডে চাকরি ও ব্যবসা হারানো অনেকে এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি। এখন সবার অপেক্ষা এই দুঃসময় কাটিয়ে অর্থনীতি কবে আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। বাংলাদেশের যে সম্ভাবনা, তাতে ঘুরে দাঁড়ানো অসম্ভব নয়। তবে অর্থনীতির টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে ব্যাংকখাতে আন্তরিক সংস্কার করতে হবে, খেলাপি সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে, যারা ব্যাংকের টাকা নিয়ে মেরে দিয়েছে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে, টাকা পাচার বন্ধ করতে হবে, দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে, দক্ষতা বাড়াতে হবে, সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে।

১২ মে, ২০২৪লেখক : বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

এইচআর/ফারুক/জিকেএস