মতামত

সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশের প্রশংসায় যুক্তরাষ্ট্র

 

সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে। সন্ত্রাস দমনে রোল মডেল হিসেবে বাংলাদেশ এখন পরিচিতি লাভ করেছে। এর পেছনে অন্যতম কারণ হলো রাষ্ট্রের মূলনীতি, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এবং প্রধানমন্ত্রীর অসাম্প্রদায়িক মানসিকতা।

Advertisement

বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল ও অকার্যকর করার জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র এবং অপতৎপরতার উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশে তৎপর সন্ত্রাসীগোষ্ঠীগুলো সবই এ দেশের অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা সন্ত্রাসবাদী। তারা কখনো জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), কখনো হরকাতুল জিহাদ, কখনো আল্লাহর দল ইত্যাদি নাম ধারণ করেছে।

ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিসান রেস্তোরাঁয়, কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে, সিলেটের আতিয়া মহলসহ বিভিন্ন জায়গায় তারা সন্ত্রাসবাদী হামলা চালিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে তাদের বিরুদ্ধে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। বাংলাদেশের জনগণ জঙ্গিদের ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। মা তার জঙ্গি ছেলেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছেন। আত্মীয়স্বজনরা জঙ্গিদের মরদেহ নিতে পর্যন্ত আসেনি। আমাদের দেশের মানুষ ধর্মভীরু, কিন্তু ধর্মান্ধ নয়। এ সত্য বারবার প্রমাণিত হয়েছে।

গত ৩ মে মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠান নিয়ার ইস্ট সাউথ এশিয়া (নেসা) সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের একটি প্রতিনিধিদল ওয়াশিংটন ডিসিতে বাংলাদেশ দূতাবাস পরিদর্শনকালে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় বাংলাদেশের সাফল্যের প্রশংসা করেছে। বর্তমান সরকার ধর্মীয় উগ্রপন্থাসহ সব রকম জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করেছে অনেক আগেই।

Advertisement

মূলত জামায়াতে ইসলামী ও শিবিরের হাত ধরে দেশে ধর্মীয় রাজনীতি ও জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটে। একাত্তরে পরাজিত হলেও পঁচাত্তর পরবর্তী সামরিক শাসনপুষ্ট সরকারগুলোর সহায়তায় দেশে ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গি কার্যক্রমের বিকাশ ঘটতে থাকে। আশার কথা এই যে, এ দেশের মাটিতে তা কখনই শিকড় গেড়ে বসতে পারেনি এবং পায়নি জনসমর্থন। তবু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সর্বদাই সতর্ক ও তৎপর থাকতে হয়।

নানাভাবে বাংলাদেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদান অনন্য। সন্ত্রাসবাদ আঞ্চলিক সমস্যা নয়, একটি বৈশ্বিক সংকট। উগ্রবাদের বিস্তার ও জঙ্গিবাদ দমনে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির ফলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদের বিস্তার প্রতিহত করা সম্ভব হয়েছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় জঙ্গিবাদের বিস্তারের নেপথ্যে ছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার।

আমরা জঙ্গিবাদের উত্থানের আলামত প্রথম উপলব্ধি করি ১৯৯২ সালে। ‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হব আফগান’- স্লোগানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে মৌলবাদীদের উত্থান ঘটে ১৯৯২ সালে। তারা রাষ্ট্রীয় মদতে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালায়। এতে ২৪ জন নিহত হন। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় হামলাকারীদের অনেকে দেশত্যাগ করে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে সশস্ত্র জঙ্গিবাদের উত্থানের সর্ববৃহৎ আলামত দৃশ্যমান হয় ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট জেএমবি কর্তৃক ৬১ জেলায় একযোগে বোমা হামলার মাধ্যমে। জঙ্গিদের মদত দেওয়ার কাজে রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করারও অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। কিন্তু সফল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে আমরা উল্টো চিত্র দেখি। তিনি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করে সন্ত্রাস ও জঙ্গি তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছেন।

Advertisement

তিনি সন্ত্রাস দমনের লক্ষ্যে দেশের জনগণকে আহ্বান জানিয়েছিলেন। তার আহ্বানে শিক্ষক-ছাত্র, শ্রমিক, ইমাম-পুরোহিত, সব ধর্মের গুরু থেকে শুরু করে সর্বস্তরের জনগণ এগিয়ে এসেছেন। জনগণ সহযোগিতা করেছে বলেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জঙ্গিদের দমন করতে পেরেছে।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ধর্মীয় নেতা, রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের সর্বস্তরের জনবল নিয়ে প্রতিটি বিভাগে জঙ্গিবিরোধী মহাসমাবেশের মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছিল, এ দেশের মানুষ জঙ্গিবাদে বিশ্বাস করে না; সন্ত্রাসীদের ঘৃণা করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবেশ করা হয়; মসজিদে জঙ্গিবিরোধী সচেতনতামূলক আলোচনা করা হয়। এতে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে।

বাংলাদেশের জনগণ ধর্মপ্রাণ, কিন্তু ধর্মান্ধ নয়। তারা ধর্মান্ধ হলে পাকিস্তান থেকে দেশকে স্বাধীন করতো না। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে শোষিত দেশটি ধর্মের মায়াজাল ছিন্ন করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন হয়েছিল। পেয়েছিল একটি নতুন সংবিধান, যার শুরু হয়েছিল অসাম্প্রদায়িকতার মাধ্যমে। সুতরাং এদেশের মানুষ সাম্প্রদায়িকতা তথা জঙ্গিবাদকে আশ্রয়-প্রশ্রয় কখনো দেয়নি এবং দেবে না। বাঙালির মানসেই প্রগতিশীলতার বীজ লুকায়িত আছে। জনগণের জঙ্গিবিরোধী মানসিকতার কারণেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে জঙ্গিবাদ দমনের কাজ সহজ হয়ে যায়।

জঙ্গিবাদ দমনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন নিরাপত্তা বাহিনী, বিশেষ করে বাংলাদেশ পুলিশ ও র্যাব এবং তাদের গোয়েন্দা ইউনিটগুলো অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। পুলিশের অ্যান্টিটেরোরিজম ইউনিট, ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম, সাইবার ক্রাইম, ইনভেস্টিগেশন সেন্টার, পুলিশ হেডকোয়ার্টারের ল’ফুল ইন্টারসেপশন ইউনিট জঙ্গি দমনে সরাসরি কাজ করছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সদস্যরা জীবনের মায়া ত্যাগ করে কাজ করেছে।

বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির জন্মের পর থেকেই ষড়যন্ত্র চলছে- ষড়যন্ত্র এখনো থেমে নেই। ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে অসংখ্য দেশপ্রেমিক প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। জঙ্গি তৎপরতাও বাংলাদেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করার একটি অপচেষ্টামাত্র।

এর আগে জাতীয় রির্বাচন কেন্দ্র করে দেশজুড়ে বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের মধ্যযুগীয় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ও তাণ্ডবলীলা দেখেছি। তারা অগ্নিসন্ত্রাস করে চলন্ত বাসে আগুন ধরিয়ে দিয়ে মানুষকে পুড়িয়ে মেরেছে, পশু পুড়িয়েছে। রাস্তায় গাছ কেটে মধ্যযুগীয় কায়দায় কুপিয়ে মানুষ হত্যা করেছে। হাজার কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করেছে। এমনকি একজন জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে আদালতের রায় ঘোষণার পর সারা দেশে সহিংসতা চালানো হয়।

টেকসই গণতন্ত্র ও উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন টেকসই শান্তি; আর টেকসই শান্তির জন্য দরকার টেকসই নিরাপত্তা। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক সব উন্নয়নের নেপথ্যে রয়েছে দেশের সার্বিক নিরাপত্তাব্যবস্থা। শেখ হাসিনা বাংলাদেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমনের মাধ্যমে নিরাপদ বাংলাদেশ গড়তে পেরেছেন বলেই এখন পৃথিবীর এক অপার বিস্ময়ের নাম বাংলাদেশ। মানুষের জীবন হয়েছে নিরাপদ। জীবনযাত্রার মান উন্নত হওয়ার পাশাপাশি হয়েছে শান্তিময়।

লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। sultanmahmud.rana@gmail.com

এইচআর/ফারুক/এমএস