মতামত

ইসরায়েলের গণহত্যা ও শব্দের আধিপত্য

সাত মাস ধরে গণহত্যা চালাচ্ছে ইসরায়েল। সারা বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার নিশ্চুপে তা অবলোকন করছে। ১৯৭১ সালেও এমনটি হয়েছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গণহত্যা চালাচ্ছিল বাংলাদেশে আর সারা বিম্বের অধিকাংশ সরকার অবলোকন করছিল। এ শতাব্দীতে গণহত্যা প্রথম হলো মিয়ানমারে, এখনও তা চলছে। এবং বিশ্ব নাগরিকরা তা ইতোমধ্যে ভুলে গেছে। ফিলিস্তিনিদের গণহত্যা এখনও শিরোনাম, হয়তো আরও কয়েক মাস এমন চলবে।

Advertisement

এ পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি শব্দ আবার নতুন ভাবে আলোচনায় আসছে। যেমন- অ্যান্টি-সেমাইট বা সেমাইটবিরোধী, জেনোসাইড বা গণহত্যা, হলোকাস্ট বা গণহত্যা, মানবিক অধিকার বা হিউম্যান রাইটস ইত্যাদি। ১৯৭১ সাল থেকে দেখা যাচ্ছে, প্রতিটি গণহত্যার পেছনে মার্কিন ইন্ধন বা সহায়তা প্রধান, চীন তার সহযোগী। এবার চীন-রাশিয়া নিশ্চুপ, রাশিয়া তার নিজের যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত। এক্ষেত্রেও প্রশ্ন উঠতে পারে পুঁজিবাদ বা পুঁজিবাদ ব্যবস্থা অক্ষুণ্ন রাখার জন্য জেনোসাইড আবশ্যকীয় কি না? বা যুদ্ধ?

যে শব্দগুলোর কথা বলছিলাম। আমাদের সাধারণ আলোচনায়, অ্যাকাডেমিক চর্চায়, সাধারণের ভাষ্যে অনেক শব্দ ব্যবহৃত হয়, যাকে আমরা স্বতঃসিদ্ধ বলে মনে করি। এসব শব্দের অনেকগুলো পূরণো, বয়স ৭০/৮০ থেকে ১০০। এ শব্দগুলো যারাই চালু করুক না কেন, ভেবে বা না ভেবে, সেগুলো ক্রমেই একটি বিশেষ শ্রেণি/গ্রুপ/জাতির স্বার্থের এবং আধিপত্য বিস্তারের হাতিয়ার হয়ে উঠছে।

আজ পাশ্চাত্যের যে কোনো সংবাদ মাধ্যম পড়লে বা দেখলে এবং ইউটিউবে আধিপত্য বিস্তার করে আছে ‘অ্যান্টি সেমাইট’ বা সেমাইটবিরোধী শব্দটি। পাশ্চাত্যে এটি মহা এক গালি বিশেষ যার অন্তর্গত জাতিদ্বেষ। ইসরায়েলের গণহত্যার প্রতিবাদ করলেই তা ‘অ্যান্টি সেমিটিক’ হিসেবে ধরা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রধানদের মার্কিন কংগ্রেসে ডাকা হচ্ছে তাদের ছাত্ররা কেন ‘অ্যান্টি সেমাইট’ হচ্ছে? ইসরায়েলের প্রতি চরম অসম্মানকারী শব্দ হচ্ছে অ্যান্টি সেমাইট। এখন অধিকাংশের মননে অ্যান্টি সেমাইট হচ্ছে ইসরায়েলের প্রতি জাতিদ্বেষকারী শব্দ। ‘সভ্য সমাজে’ তা অচল। আসলে ‘সভ্য সমাজ’র একটি অলিখিত সংজ্ঞা আছে, যা পাশ্চাত্যের মনপূত নয় তাই সভ্য নয়। অর্থাৎ সভ্য সমাজেরও একটা মানদণ্ড তৈরি করেছে পাশ্চাত্য। অনবরত প্রচারে পাশ্চাত্যের এ শব্দগুলো ও মাপকাঠি আমাদের মননে গেথে গেছে।

Advertisement

খুব সম্ভব, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে, যখন পাশ্চাত্য জুলুম করে ইসরায়েল সৃষ্টি করছে তখন ইসরায়েলি নেতারা এ শব্দটি চালু করেন। আগেও যে তা ব্যবহৃত হতো না তা নয়। ইসরায়েলি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা ছিল সেমাইটবিরোধী। সে থেকে পাশ্চাত্যের ভাষায়, বিশেষ করে রাজনৈতিক ভাষ্যে তা চলে এসেছে। এখন পাশ্চাত্যে এ শব্দ ব্যবহার শাস্তিযোগ্য অপরাধ, কেননা তা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যাচ্ছে।

বিট্রানিয়া বিশ্বকোষ পৃথিবী স্বীকৃত। তার যে সংক্ষিপ্ত সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে, তাতে Semite শব্দটির সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এভাবে- একটি সাধারণ ভাষা থেকে উদ্ভূত বিভিন্ন ভাষার একটি, যা কোনো ব্যক্তি ব্যবহার করে। সেমাইট শব্দটির অন্তর্গত- আরব, আক্কাদ, কেনান, কিছু ইথোপীয় ও আর্মেনীয় এবং হিব্রু ট্রাইব। আরব উপদ্বীপ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ অব্দে সেমাইট ট্রাইবসমূহ ভূমধ্যসাগরের উপকূল অভিমুখে অভিবাসন শুরু করে। অনেকে ইরাক ও নীলনদ বদ্বীপে। ফিনিশিয়ায় তারা হয়ে যায় সমুদ্রগামী। মেসোপটিমিয়ায় তারা মিশে যায় সুমেরিয়দের সাথে। অবশেষে অন্য সেমাইটদের সঙ্গে হিব্রুরা প্যালেস্টাইনে বসতি বাধে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ইহুদিরা ধরে নিচ্ছে প্যালেস্টাইন শুধু তাদের বাসভূমি। কিন্তু, প্যালেস্টাইন কখনও শুধু ইহুদিদের বসতি ছিল না। সে এলাকায় বা দেশে দুটি ভাষা প্রচলিত- আরবি ও হিব্রু। ইসরায়েলে এখন সরকারি ভাষা হিব্রু ও আরবি। আরবদের সমার্থক সেমাইট।

বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরী মানিক সম্প্রতি এক ভাষ্যে বলেছেন, বর্তমানে যারা ইহুদি তাদের কোনো নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী হিসেবে ধরা যায় না। ‘ইউরোপের ককেশীয় নৃতাত্ত্বিক গোত্রের মানুষের সংমিশ্রণে বর্তমানে যেসব সংকর ইহুদি ধর্মাবলম্বী রয়েছেন তাদের সেমেটিক গোত্রের লোক বলে বিবেচনা করা যায় না। কেননা তারা এখন বহু গোত্রের লোকের সংকারায়ণে সৃষ্ট।’

১৯৭১ সালে পাকিস্তান ছিল গণহত্যার ফ্রন্ট। পেছনে ছিল আমেরিকা ও তার অনুসারীরা। এখন গণহত্যার ফ্রন্ট ইসরায়েল, পেছনে আমেরিকা ও পাশ্চাত্য। সেমাইট-অ্যান্টি সেমাইট কোনো বিষয় নেই।

Advertisement

মুসলমান, খ্রিস্টান ও ইহুদিদের আদি নবি হজরত ইব্রাহিম, ইসলামের অনেক রিচ্যুয়াল এসেছে ইহুদি ধর্ম থেকে। খ্রিস্টান ধর্মের অনেক রিচ্যুয়ালের সঙ্গেও মিল আছে ইহুদি ধর্মের। হজরত মুসা, ঈসা, সবাই তিন ধর্মেরই নবি। হজরত ঈসা নন। কেননা, আদি খ্রিস্টানদের অনেকে মনে করেন ঈসার প্রতি বিশ্বাসঘাতক জুডাস ইহুদি ধর্মাবলম্বী। হজরত ইব্রাহিমের বড় ছেলে হজরত ইসমাইল ছিলেন ইসলামের অনুসারী। হজরত ইব্রাহিমের ছোট বউয়ের বড় ছেলে হজরত ইসহাক হচ্ছেন ইহুদিদের প্রেরিত পুরুষ। হজরত ইব্রাহীম তাকে নিয়ে কেনানে গিয়েছিলেন। অর্থাৎ, ইসলাম ও ইহুদি দুটি সেমেটিক ধর্ম। পার্থক্য একটাই, যে কেউ ইসলামে আসতে পারেন, যে কেউ ইহুদি হতে পারেন না।

ইহুদিদের আদি ইতিহাস বিশ্লেষণ করা আমার উদ্দেশ্য নয়। ইসলাম ও ইহুদি ধর্ম ওই অর্থে সেমিটিক। আরবরা সেমিটিক। বিচারপতি মানিক বলছেন, ইসরায়েল এখন আদি ইহুদিরা নেই বা থাকলেও নগণ্য সেটি সত্য। অধিকাংশ সংকরায়িত ইউরোপীয় ইহুদি, আফ্রিকারও আছেন। অধিকাংশ ককেশীয়। কিন্তু প্যালেস্টাইনে আদি সেমাইট, আরব বা মুসলমান সংখ্যা বেশি। তাদের হত্যা ও বিতাড়িত করলেনও।

১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের প্রস্তাবে দুটি রাষ্ট্র গঠনের কথা থাকলেও, ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বালফুর, ইহুদি ধনকুবের রথসচাইল্ডের সহায়তায় ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন, বালফুর ঘোষণার মাধ্যমে। প্যালেস্টাইন গঠিত হয়নি। ইহুদি হয়েও নোয়াম চমস্কি বলেছেন, ইসরায়েল হচ্ছে পাশ্চাত্য ও আমেরিকার নতুন ঔপনিবেশ সৃষ্টিকারী প্রকল্প। অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্য নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখার জন্য তারা জোর করে ইসরায়েল সৃষ্টি করেছে।

যারা এর পেছনে আছে- ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, আমেরিকা, কানাডা এদের প্রত্যেকের কলোনি ছিল এবং ওই কলোনিতে বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ এনে, আদি বসতিদের নিকেশ করে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করেছে মূলত গণহত্যার মাধ্যমে। চমস্কি আরও বলেছেন, এ রাষ্ট্রগুলো বাইরে সেক্যুলার ভাব করলেও এক অর্থে মৌলবাদী, খ্রিস্টান ধর্মে গভীরভাবে বিশ্বাসী। তাদের অনেক নীতি আদি খ্রিস্টীয় নাতি দ্বারা প্রভাবিত। ওল্ড টেস্টামন্টে আছে, ইহুদিরা তাদের দেশে (প্যালেস্টান) ফিরবে। সুতরাং, ধর্মীয়ভাবে তারা ওই কথায় বিশ্বাসী। চমস্কি উল্লিখিত নতুন কলোনির প্রকল্প হিসেবে বিভিন্ন দেশ থেকে ইহুদিদের সেখানে এনে বসানো হয়েছে, বিচারপতি মানিকের ভাষায় সংকায়িত ইহুদি সংখ্যাগরিষ্ঠ ককেসীয়।

অন্যদিকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে খ্রিস্টানদের ক্রসেড বা ধর্মযুদ্ধের ইতিহাস ঐতিহ্য আছে। ফলে একই নবীর দুই পুত্রের অনুসারীরা এখন মুখোমুখি। ইসরায়েলকে সমর্থনকারীরা, ধর্ম, নৃতাত্ত্বিক ও নিজ স্বার্থের (পুঁজি, সাম্রাজ্যবাদ) কারণে ইসরায়েলকে সমর্থন করছে। এ কারণে তারা বলছে, ইহুদিরাই সেমাইট এবং প্যালেস্টানের আদি পুরুষ, সুতরাং এ জমি তাদের। এ বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা। কিন্তু, পাশ্চাত্যের প্রচারণার কারণে দাঁড়িয়ে গেছে, ইসরায়েলে বসবাসকারী ইহুদিরাই (যেহেতু তারা হিব্রু ব্যবহার করে) সেমেটিক। আর ইসরায়েলকে সমালোচনা করা anti-semite. বিশ্বের বুদ্ধিজীবীরা তা মেনে নিয়েছেন। কেউ বলছেন না বা বলেননি, ইসরায়েলিরাই anti-semite. কারণ, ইসরায়েলে আদি অধিবাসী আরবদের তারা উৎখাত করছে, আরবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। পাশ্চাত্য anti-semite আসলে, শব্দটি এমনভাবে মননে গেথে গেছে, যে এর অন্য কোনো অর্থ থাকতে পারে তা কারও মনেই হচ্ছে না।

মূলকথা, ইসরায়েল না থাকলেও ইহুদিবাদী আন্দোলন না থাকলেও পাশ্চাত্য ও আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্য এক ইসরায়েল সৃষ্টি করত পুঁজিবাদের স্বার্থে এবং গণহত্যা চালাতো। অস্ত্র ব্যবসার জন্য। রাজনৈতিক আধিপত্যের জন্য। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ছিল গণহত্যার ফ্রন্ট। পেছনে ছিল আমেরিকা ও তার অনুসারীরা। এখন গণহত্যার ফ্রন্ট ইসরায়েল, পেছনে আমেরিকা ও পাশ্চাত্য। সেমাইট-অ্যান্টি সেমাইট কোনো বিষয় নেই।

পরের কিস্তিতে এ যুদ্ধ থেকে উদ্ভূত আরও কয়েকটি শব্দ বিশ্লেষণ করা হবে।

এইচআর/জেআইএম/ফারুক