• উচ্চশিক্ষায় পিছিয়ে নেই ছাত্রীরা, এগিয়ে ফলাফলেও• বিয়ে-সংসারের চাপে বিসিএসের প্রস্তুতিতে ‘ভাটা’• নারীদের পিছিয়ে পড়ার নেপথ্যে কোটা বাতিলের প্রভাব
Advertisement
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) পরীক্ষার মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে নিয়োগে ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছেন নারীরা। আগের পাঁচ বিসিএসে নারীদের নিয়োগের হার ছিল এক-চতুর্থাংশ, অর্থাৎ ২৫-২৬ শতাংশের ঘরে। সর্বশেষ ৪৩তম বিসিএসে তা নেমেছে ২০ শতাংশেরও নিচে। সর্বশেষ ৬টি সাধারণ বিসিএসের গড় হিসাবে প্রতি ১০০ ক্যাডার পদের ৭৫টিতেই নিয়োগ পেয়েছেন পুরুষরা। নারীদের ক্যাডার পদে নিয়োগের হার মাত্র ২৫ শতাংশ।
অথচ দেশের উচ্চশিক্ষায় ছাত্র ও ছাত্রীদের সংখ্যা প্রায় সমান। অ্যাকাডেমিক বিভিন্ন পরীক্ষার ফলাফলেও এগিয়ে ছাত্রীরাই। এমন প্রেক্ষাপটে উচ্চশিক্ষা শেষে ছাত্রীদের চাকরির ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ার কারণ অনুসন্ধানের তাগিদ দিয়েছেন শিক্ষাবিদরা।
বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) কর্মকর্তাদের অভিমত অবশ্য ভিন্ন। তারা বলছেন, অ্যাকাডেমিক পরীক্ষায় নারী শিক্ষার্থীরা ভালো করলেও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় নানান কারণে তারা পিছিয়ে পড়ছেন। এটি শুধু বাংলাদেশে নয়, বৈশ্বিক চিত্র একই। এছাড়া নারী কোটা বাতিলের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবও সর্বশেষ বিসিএসে পড়তে পারে বলে ধারণা তাদের।
Advertisement
পিএসসি প্রকাশিত ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ৪৩তম বিসিএসে প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা শেষে ২ হাজার ১৬৩ জনকে নিয়োগের চূড়ান্ত সুপারিশ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে নারী প্রার্থী মাত্র ৪২১ জন। বাকি এক হাজার ৭৪২ জনই পুরুষ। শতাংশের হিসাবে নারীদের এ বিসিএসে নিয়োগের হার মাত্র ১৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ। অন্যদিকে পুরুষের নিয়োগের হার ৮০ দশমিক ৫৪ শতাংশ। অর্থাৎ, এই বিসিএসে ক্যাডার পদে নিয়োগ পওয়া প্রতি ১০০ জনের প্রায় ৮১ জনই পুরুষ।
এর আগে ২০১৭ সালে ৩৬তম বিসিএসে ২ হাজার ৩২৩ জনকে চূড়ান্ত সুপারিশ করে পিএসসি। এরমধ্যে নারী ক্যাডার ছিলেন ৬০৯ জন, যা মোট নিয়োগপ্রাপ্তদের ২৬ দশমিক ২২ শতাংশ। বাকি ৭৩ দশমিক ৭৮ শতাংশই পুরুষ প্রার্থী। পরের বছর ৩৭তম বিসিএসে নিয়োগের চূড়ান্ত সুপারিশ করা হয় এক হাজার ৩১৪ জনকে। তাদের মধ্যে মাত্র ৩২৩ জন নারী, শতাংশের হিসাবে যা ২৪ দশমিক ৬০ শতাংশ।
সুযোগ থাকা সত্ত্বেও নারীদের বিসিএসে পিছিয়ে পড়ার কারণ হিসেবে বিয়ে ও সংসারের চাপ সামলে পড়াশোনা করতে না পারার কথা জানিয়েছেন অনেকে। অবার অনেকে চেষ্টা করেও নানান কারণে শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারছেন না।
২০২০ সালে ৩৮তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হয়। তাতে ২ হাজার ২০৪ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করে পিএসসি। এরমধ্যে নারী প্রার্থী ছিলেন ৫৯৩ জন, শতাংশের হিসাবে যা ২৬ দশমিক ৯১ শতাংশ। ৪০তম বিসিএসে নিয়োগের চূড়ান্ত সুপারিশ পাওয়া এক হাজার ৯৬৩ জনের মধ্যে নারী ৫১১ জন। এছাড়া এক হাজার ৪৫২ জন পুরুষ।
Advertisement
৪১তম বিসিএসের ফল প্রকাশ হয় ২০২৩ সালে। এতে সুপারিশপ্রাপ্ত হন ২ হাজার ৫১৬ জন। তাদের মধ্যে ৬৭২ জন নারী এবং এক হাজার ৮৪৪ জন পুরুষ। শতাংশের হিসাবে নারী ২৬ দশমিক ৭১ এবং পুরুষ ৭৩ দশমিক ২৯ শতাংশ।
৬ বিসিএসে গড়ে ১০০ ক্যাডারে ৭৫ জনই পুরুষ২০১৭ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ছয়টি সাধারণ বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হয়েছে। সেগুলো হলো— ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৪০, ৪১ ও ৪৩তম বিসিএস। এতে মোট নিয়োগ পেয়েছেন ১২ হাজার ৪৮৩ জন, যার মধ্যে নারী ৩ হাজার ১২৯ জন। বাকি ৯ হাজার ৩৫৪ জনই পুরুষ।
আরও পড়ুন
১০ শতাংশ কোটা পেয়েও বিসিএসে পিছিয়ে নারীরা ১০ মন্ত্রণালয়-বিভাগে নারী সচিব, নারী ডিসি ৭ জন ছয়টি বিসিএসে ৭১৬১ নারী কর্মকর্তা নিয়োগপিএসসির বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ছয়টি সাধারণ বিসিএসে ক্যাডার পদে নিয়োগ পাওয়াদের মধ্যে নারী ২৫ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। বাকি প্রায় ৭৫ শতাংশই পুরুষ। অর্থাৎ, প্রতি ১০০ ক্যাডারের ৭৫ জন পুরুষ এবং নারী ২৫ জন।
উচ্চশিক্ষায় ছাত্রীদের উপস্থিতি কেমন?দেশে উচ্চশিক্ষায় এগিয়েছেন নারীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্র ও ছাত্রীর পার্থক্য কমে আসছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অ্যাকাডেমিক পরীক্ষায়ও ছাত্রদের চেয়ে এগিয়ে ছাত্রীরা। এমনকি বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায়ও ছাত্রীদের ফলাফল ভালো।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ১৬৩টি সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যায় ও তাদের অধীন প্রতিষ্ঠানে মোট শিক্ষার্থী ৪৭ লাখ ৫৬ হাজার। এরমধ্যে ছাত্র ২৫ লাখ ৪২ হাজার এবং ছাত্রী ২২ লাখ ১৪ হাজার। সে হিসাবে মোট শিক্ষার্থীর ৪৮ শতাংশ ছাত্রী এবং ৫২ শতাংশ ছাত্র।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়টি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১টি ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কয়েকটি বিভাগে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের ফলাফলে প্রথম পাঁচজনের মধ্যে অধিকাংশই ছাত্রী। তারা পড়াশোনায় মনোযোগী ও ভালো ক্যারিয়ার গড়ার প্রত্যাশী। বিভাগের শিক্ষকরাও জানান, ছাত্রীদের আগ্রহের কারণে বিসিএসসহ চাকরির পরীক্ষায় তাদের ভালো করার সম্ভাবনা বেশি।
বিসিএসসহ দেশে বিদ্যামান অধিকাংশ চাকরির পরীক্ষার বিষয়বস্তু অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার সঙ্গে মিল নেই। একজন গ্র্যাজুয়েট যে বিষয়েই পড়ুক না কেন, দিনশেষে বাংলা, ইংরেজি, সাধারণ জ্ঞানের একই প্রশ্নে সবাইকে পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। এতে অ্যাকাডেমিক পরীক্ষায় ভালো করা শিক্ষার্থীরাও চাকরির পরীক্ষায় পিছিয়ে পড়ছেন।
ইউজিসির চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর জাগো নিউজকে বলেন, ‘উচ্চশিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ বেশ কয়েক বছর ধরে বাড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নারীদের উপস্থিতি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে ইউজিসি সবসময় পরামর্শ দিয়ে থাকে। তারা যাতে ভালোভাবে উচ্চশিক্ষা শেষ করতে পারেন, সেদিকেও গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে সরকার। পাশাপাশি নারী শিক্ষার্থীদের ফলাফলও ভালো। আমরা যে ইউজিসি ও প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক দেই, সেটাতেও নারীরা এগিয়ে।’
বিসিএসে নারীরা পিছিয়ে কেন?সরকার নারীর ক্ষমতায়নে জোর দিচ্ছে। পররাষ্ট্র, প্রশাসন, পুলিশসহ বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগ পাচ্ছেন নারীরা। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও নারীদের বিসিএসে পিছিয়ে পড়ার কারণ হিসেবে বিয়ে ও সংসারের চাপ সামলে পড়াশোনা করতে না পারার কথা জানিয়েছেন অনেকে। অবার অনেকে চেষ্টা করেও নানান কারণে শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারছেন না।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে ২০১৭ সালে স্নাতকোত্তর শেষ করেন সানজিদা পারভীন। স্নাতকে ওই বিভাগে যৌথভাবে পঞ্চম এবং স্নাতকোত্তরে তৃতীয় হন তিনি। ২০১৭ সালে প্রথমবার ৩৮তম বিসিএসে আবেদন করেন। প্রথমবারেই প্রিলিমিনারিতে টেকেন সানজিদা। লিখিত পরীক্ষা দিলেও উত্তীর্ণ হতে পারেননি। এরপর সানজিদার বিয়ে হয়ে যায়।
বিয়ের পর স্বামী ও শ্বশুর-শাশুড়ির ইতিবাচক সহযোগিতা পেলেও সেভাবে পড়াশোনাটা আর হয়ে ওঠেনি। এরপর ৪০ ও ৪১তম বিসিএসে আবেদন করলেও প্রিলিমিনারিতেও পাস করতে পারেননি সানজিদা। পরবর্তী সময়ে পড়াশোনা ছেড়ে পুরোপুরি সংসারে মনোযোগ দিয়েছেন।
পরীক্ষার আগে শেষ সময়ে প্রস্তুতি নিচ্ছেন চাকরিপ্রার্থীরা/ ফাইল ছবি
জাগো নিউজকে সানজিদা বলেন, ‘প্রথমদিকে খুব ইচ্ছা ছিল, আত্মবিশ্বাসও ছিল। বিয়ের পর নানার কারণে আর পড়াশোনাটা হয়ে ওঠেনি। আমার হাজবেন্ড খুব হেল্পফুল। ও চাইতো আমি যাতে ক্যাডার হই। আমার শ্বশুর-শাশুড়িও চাইতেন। কিন্তু আমি আর মনোযোগ দিয়ে পড়তে পারিনি। এখন দুই সন্তানের মা। চাকরির বয়সও কিছুদিন অগে শেষ।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন দীপ্তি রহমান। ফলাফলের দিক দিয়ে বিভাগে তৃতীয় তিনি। বর্তমানে বিসিএসের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ৪৪ ও ৪৫তম বিসিএস দিয়েছিলেন। তবে প্রিলিমিনারিতে টিকতে পারেননি। ৪৬তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষা দিয়ে আত্মবিশ্বাসী দীপ্তি। জাগো নিউজকে দীপ্তি বলেন, ‘আমার লক্ষ্য প্রশাসন অথবা পররাষ্ট্র ক্যাডার। ৪৬তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি ভালো হয়েছে। আশা করছি লিখিত পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পাবো।’
আরও পড়ুন
পিএসসির ‘ভুতুড়ে নিয়োগে’ বিসিএস ক্যাডার, দুদকের মামলা ‘শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ক্ষতিগ্রস্ত করছে বিসিএস পরীক্ষা’ বছরে শেষ হবে একটি বিসিএস, সুফল পাবেন চাকরিপ্রার্থীরাতিনি বলেন, ‘অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা ও চাকরির পড়ালেখা; বিশেষ করে বিসিএসের প্রস্তুতি একেবারে ভিন্ন। আমি অংকে খুব কাঁচা। বিভাগে আমাকে অংক কষতে হয়নি। এখন করতে হচ্ছে। সাধারণ জ্ঞান রপ্ত করতে হচ্ছে। সবমিলিয়ে পড়াশোনা শুরু করতে হচ্ছে একেবারে নতুন করে। এখানে সফল হওয়া অতটা (অ্যাকাডেমিক ভালো ফলাফলের মতো) সহজ নয়।’
চাকরির পরীক্ষায় ‘গলদে’ পিছিয়ে নারীরা!বিসিএসসহ দেশে বিদ্যামান অধিকাংশ চাকরির পরীক্ষার বিষয়বস্তু অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার সঙ্গে মিল নেই। একজন গ্র্যাজুয়েট যে বিষয়েই পড়ুক না কেন, দিনশেষে বাংলা, ইংরেজি, সাধারণ জ্ঞানের একই প্রশ্নে সবাইকে পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। এতে অ্যাকাডেমিক পরীক্ষায় ভালো করা শিক্ষার্থীরাও চাকরির পরীক্ষায় পিছিয়ে পড়ছেন। এ প্রক্রিয়ায় আমূল পরিবর্তন না আনলে শুধু নারী নন, উচ্চশিক্ষায় ভালো করা অধিকাংশ শিক্ষার্থী চাকরি থেকে বঞ্চিত থেকে যাবেন বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা।
গণস্বাক্ষরতা অভিযানের প্রধান নির্বাহী রাশেদা কে চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের ছাত্রীরা উচ্চশিক্ষায় তো ভালো করছেন। মেধা ও পরিশ্রমের কারণে তারা অ্যাকাডেমিক ফলাফলে এগিয়ে থাকছেন। তাহলে চাকরির ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছেন কেন? এর কারণ হলো— দেশের চাকরির নিয়োগ পরীক্ষাগুলো অ্যাকাডেমিক পড়াশোনানির্ভর নয়। অর্থাৎ, একজন শিক্ষার্থী ১৬ বছর ধরে যা পড়ছেন, চাকরিতে যোগ দিতে তা মোটেও কাজে লাগছে না। এ পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা জরুরি।’
তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি অ্যাকাডেমিক শিক্ষা হাতে-কলমে হলে এবং সেই অভিজ্ঞতানির্ভর চাকরির বাজার গড়ে উঠলে সবক্ষেত্রে দেশের মেয়েরা ভালো অবদান রাখতে পারবে। সরকারকে সেদিকে গুরুত্ব দিয়ে নজর দেওয়া উচিত। তাহলে শুধু বিসিএস নয়, সব চাকরিতে নারীদের সফল পদচারণা দেখা যাবে।’
একই সঙ্গে নারী প্রার্থীরা মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও কেন পিছিয়ে পড়ছেন, তা নিয়ে অনুসন্ধান হওয়া প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি।
অন্যদিকে নারীদের উচ্চশিক্ষায় অংশগ্রহণ বাড়লেও টিকে থাকতে এখনো লড়াই করতে হচ্ছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. গীতি আরা নাসরিন। এর প্রভাব পড়ছে নারীদের চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে।
কোটা বাতিলের পর পিএসসির একটি নীতিগত অবস্থান ছিল। তখন হুট করে নারী ক্যাডার কমলে প্রশ্ন উঠতো যে কোটা থাকায় এতদিন নারীরা বেশি নিয়োগ পেয়েছে। সেটিতে সামঞ্জস্য রাখতে তখন বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল।
অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন বলেন, ‘উচ্চশিক্ষায় নারীদের উপস্থিতি বেড়েছে, এটা সত্য। তবে অনেকে মাঝপথে খেই হারাচ্ছেন। তারা উচ্চশিক্ষা পুরোপুরি নেওয়ার আগেই নানান প্রতিবন্ধকতায় থমকে যাচ্ছেন। তাদের উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। এটা না করা গেলে শুধু বিসিএস নয়, সব ক্ষেত্রেই কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি মিলবে না। আমি মনে করি শুধু বিসিএসে যেতে হবে বলেই উচ্চশিক্ষা নিতে হবে, তা নয়। এখন তো নারীরা ই-কমার্স, ফ্রিল্যান্স করেও স্বাবলম্বী হচ্ছেন। সার্বিক দিক দিয়ে নারীদের এগিয়ে যাওয়াটাই মুখ্য।’
নারী ক্যাডার কমার নেপথ্যে কোটা বাতিল?সরকারি চাকরিতে দীর্ঘদিন ১০ শতাংশ নারী কোটা ছিল। ২০১৮ সালের ৩ অক্টোবর সরকার কোটা পদ্ধতি বাতিল করে। এতে বিসিএসেও নারী কোটা বাতিল হয়। ৩৮তম বিসিএসে সর্বশেষ নারী কোটা বহাল ছিল। ৩৯তম বিসিএস ছিল ‘বিশেষ বিসিএস (স্বাস্থ্য)’।
৪০ ও ৪১তম বিসিএসে নারী কোটা না থাকলেও নারী প্রার্থীদের নিয়োগ পাওয়ার হার ছিল ২৬ শতাংশের ঘরে। তখন বলা হয়েছিল কোটা বাতিল হলেও নারী ক্যাডার কমেনি। ৪২তম বিসিএসও ছিল বিশেষ। সর্বশেষ ৪৩তম বিসিএসে ব্যাপক হারে নারী ক্যাডার কমেছে। পিএসসির কর্মকর্তারা অবশ্য এখন বলছেন বিসিএসে নারীদের আরও পিছিয়ে যাওয়ার নেপথ্যে নারী কোটা বাতিলের একটা প্রভাবও রয়েছে।
পিএসসির দুজন কর্মকর্তার সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলে জাগো নিউজ। তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, কোটা বাতিলের পর পিএসসির একটি নীতিগত অবস্থান ছিল। তখন হুট করে নারী ক্যাডার কমলে প্রশ্ন উঠতো যে কোটা থাকায় এতদিন নারীরা বেশি নিয়োগ পেয়েছে। সেটিতে সামঞ্জস্য রাখতে তখন বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল।
তারা আরও জানান, সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা বাতিলের কয়েক বছর পার হয়ে যাওয়ায় এখন আর সেটা মাথায় রাখেনি পিএসসি। এখন পুরোপুরি মেধাভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। সেক্ষেত্রে বলা যেতে পারে, নারী ক্যাডার কমে যাওয়ার ক্ষেত্রে কোটা বাতিলের কিছুটা প্রভাবও রয়েছে।
নারী ক্যাডার কমা নিয়ে যা বলছে পিএসসিপিএসসির সদস্য সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক জাগো নিউজকে বলেন, ‘ছেলেরা চাকরির ক্ষেত্রে অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়। মেয়েরা অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা বেশি করে, সেখানে ভালো ফল করে। অনেক ছেলে তো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরপরই চাকরির পড়াশোনা শুরু করে। পাশাপাশি বাইরের জ্ঞানেও তারা এগিয়ে থাকে। বিশেষ করে সমসাময়িক ঘটনা, গণমাধ্যমের খবরে তারা চোখ রাখে। এজন্য ছেলেরা এগিয়ে যায়।’
বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন ভবন/ ফাইল ছবি
তিনি আরও বলেন, ‘খুব সাধারণভাবে চিন্তা করুন, দেখবেন বিসিএস পরীক্ষার সময় মেয়েদের বিয়ের বয়স হয়। আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটই এমন। এতে অনেকেই সন্তান নিয়ে সংসারে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এসব কারণে বিসিএস পরীক্ষায় ভালো করা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে।’
পিএসসির চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন অবশ্য মেয়েরা খুব পিছিয়ে তা মানতে নারাজ। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘বিসিএসে এখনো আবেদনের হার ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের তুলনামূলক কম। প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় সব পর্যায়েই তো নারী প্রার্থীদের অংশগ্রহণের হার কম। তারপরও বলবো মেয়েরা আগামীতে ভালো প্রস্তুতি নিয়ে মেধা দিয়ে আরও ক্যাডার হবেন।’
বিশেষ বিসিএসে নারী ক্যাডার বেশিসাধারণ বিসিএসে নারী ক্যাডার কম হলেও বিশেষ বিসিএসে তাদের নিয়োগ পাওয়ার হার তুলনামূলক বেশি। পিএসসির বার্ষিক প্রতিবেদনে সর্বশেষ ৩৯ ও ৪২তম বিসিএসের যে পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে, তা থেকে এমন চিত্র দেখা গেছে। এ দুটি বিসিএসে শুধুমাত্র চিকিৎসকদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
৩৯তম বিশেষ বিসিএসে মোট ৬ হাজার ৭৯২ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে ৩ হাজার ১৯২ জনই নারী। বাকি ৩ হাজার ৬০০ জন পুরুষ। শতাংশের হিসাবে ৪৭ শতাংশ নারী এবং ৫৩ শতাংশ পুরুষ।
৪২তম বিশেষ বিসিএসে অবশ্য নারী ক্যাডার আরও বেড়েছে। এ বিসিএসে ৪ হাজার ক্যাডার নিয়োগ দেওয়া হয়। এরমধ্যে নারী এক হাজার ৯৬১ জন এবং পুরুষ ২ হাজার ৩৯ জন। সে হিসাবে ৪৯ দশমিক শূন্য ২ শতাংশই নারী এবং ৫০ দশমিক ৯৮ শতাংশ পুরুষ।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. মো. কামরুল হাসান বলেন, ‘মেডিকেল কলেজগুলোতে ছাত্রী বাড়ছে। ডাক্তার হিসেবেও মেয়েরা বেশি পাস করছেন। তাদের মধ্যে এখন বিসিএসের ঝোঁকও বেড়েছে। ক্যাডার হওয়ার পর তাদের দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পদায়ন হয়। আগে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে যেতে অনেকের অনীহা ছিল। এখন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিবেশ ভালো হওয়ায় তারা স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করতে পারছেন। এজন্য বিসিএসে ঝুঁকছেন নারী চিকিৎসকরা।’
এএএইচ/কেএসআর/এএসএম