এশিয়াজুড়ে এবার উচ্চ তাপমাত্রার প্রভাব লক্ষণীয়। বাংলাদেশের উচ্চতাপমাত্রা যেমন নজর কেড়েছে তেমনি প্রাণ ওষ্ঠাগত করে বিপদে ফেলেছে মানুষকে। কেউ কেউ মজা বা উপহাস বলে বলে বেড়াচ্ছে, মানুষের পাপ কাজের মাত্রা বেড়েছে। পাপ কাজকে কেউ এখন আর তেমন ঘৃণা করে না, ভয়ও পায় না। কারণ এদেশের মানুষ সিংহভাগই ধর্মপ্রাণ। এদেশের মতো এত বেশি মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা পৃথিবীর আর কোনো দেশে আছে বলে মনে হয় না। মানুষ পাপ কাজ করে আর ধর্মীয় উপাসনা করে প্লাস-মাইনাস থিওরিতে মনের ভারসাম্য এনে আত্মতৃপ্তি লাভ করে।
Advertisement
মানুষ নিজেদের আরাম আয়েশের জন্য প্রকৃতির ওপর নির্বিচারে নিষ্ঠুরতা চালিয়ে উল্লাসে মেতে উঠেছে। উন্নয়নের নামে প্রকৃতির সবুজ গায়ের চামড়া তুলে কালো পশমী চাদর ও জামা পরিয়ে দিয়েছে। গরমের মৌসুমে মানুষ বা কোন প্রাণী কি কালো পশমী কোট পায়ে দিয়ে থাকতে পারে?
আধুনিকতার নামে শহরের ব্যাপ্তি ঘটছে প্রতিটি দেশে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির নামে গোটা পৃথিবীর বুকজুড়ে কংক্রিট ও কালো পিচের ঢালাই এঁকে দেওয়া হয়েছে। ক্ষমতার লোভে যুদ্ধের দামামা চালিয়ে সাইরেন বাজিয়ে বোমা-বারুদ ফাটিয়ে পৃথিবীর শান্ত সুন্দর পরিবেশ ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। আরাম আয়েশের জন্য এসি, কুলিংফ্যান, ফ্রিজ নামক কীট মানুষের গাড়ি, বাড়ি, অফিস, আদালত, রিসোর্ট প্রভৃতিতে খামচে বসে অনর্গল উচ্চ তাপমাত্রা ও বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে দিয়ে উপহাস করছে।
কার্বন কমানোর নামে সেমিনার, কনফারেন্স, কনভেনশন করতে গিয়ে বেটো দিয়ে ওয়াক আউট করে চলে যাচ্ছে স্বার্থের সংঘাতের কারণে। মারণাস্ত্র বিক্রি করে যাদের জাতীয় ও বার্ষিক আর্থিক বাজেট নিরুপণ করা হয় তারা এ ব্যাপারে শুধু ভণিতা ছাড়া আর কি করতে পারে? তাই পাপমাত্রা শুধু ধর্মপ্রাণ মানুষকে কেন্দ্র করে প্রার্থনার ওপর নির্ণীত করাটা বড় ভুল হবে। পাপের মাত্রাটা নির্ভর করছে বড় বড় অর্থনীতির বড় বড় মেগা কর্মকাণ্ডের ফলে প্রকৃতির ওপর ব্যাপক হারে নিষ্ঠুরতা চালানোর মধ্যে।
Advertisement
আসলে যুদ্ধের উন্মাদনায় পড়ে বৈশ্বিক উষ্ণতা কেউই তেমন পাত্তা দিচ্ছেন না। কিছুদিন আগে বলা হতো- পৃথিবী আর দেড় বছরের মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রণ হারাবে। হঠাৎ করে এখন বলা হচ্ছে, দেড় বছর নয় আর মাত্র দেড় মাসের মধ্যে পৃথিবীর ভাগ্য জানা যাবে (বিবিসি)। কারণ, আর মাত্র দেড় মাসের মধ্যে যে বিশ্ব পরিবেশ সম্মেলন হতে যাচ্ছে সেখানে বড় বড় কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর ভূমিকা কি হবে তা দেখার মতো বিষয়। সেখানে নির্ধারিত হবে কার্বন নিয়ন্ত্রণের জন্য নতুন নীতিমালা।
রাশিয়া গ্যাস সরবরাহে ইউরোপের ওপর থেকে অবরোধ তুলে না নেওয়ায় গোটা ইউরোপে কাঠ ও কয়লার ব্যবহার বেড়েছে। তাই ইউরোপে অতি বেশি কার্বন নির্গমন হতেই আছে। এটা আরও কতদিন বা বছর কলবৎ থাকবে তা বোঝা মুশকিল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলাবস্থায় ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ চলছে। ইরান, লেবাননসহ গোট মধ্যপ্রাচ্যে অশান্তি। সবার সামরিক উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে এবং দ্রব্যমূল্য আরও নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে।
বিশ্ববাণিজ্য ও জরুরি খাদ্য এবং ওষুধ সরবরাহ আরও বেশি সঙ্কুচিত হয়ে পড়লে বিশ্বমন্দা নিয়ে মানুষ আরও বেশি হতাশ হবে। তখন ধনী দেশগুলো কার্বন নিঃসরণের জন্য কোনোরূপ অর্থ ব্যয় করতে মোটেও রাজি হবে না। ফলে গোটা বিশ্ব অচিরেই একটি চরম ক্রান্তিকালের মুখোমুখি এসে উপনীত হয়েছে। সেখান থেকে অচিরেই কোনো মুক্তি পাওয়ার আশা করা বৃথা।
এত গেলো ইউরোপের ধনী দেশগুলোর কথা। করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট, বন্যা, দাবানল, ডেঙ্গু, মরুর দেশ আমিরাত ও ওমানে আকস্মিক অতিবৃষ্টি ও ফ্লাশফ্লাড ইত্যাদি নিয়ে গোটা পৃথিবীতে কঠিন অর্থনৈতিক আঘাত লেগে গেছে। বড় আঘাতে ইতোমধ্যে আফ্রিকা ও এশিয়ার ছোট ছোট ১৬টি দেশ নাস্তানাবুদ হয়ে পড়েছে। দেশে দেশে জ্বালানি সংকট ও উচ্চদ্রব্যমূল্য চোখে পড়ার মতো অবস্থায় জানান দিচ্ছে সামনের ভয়াবহ আশঙ্কার কথা।
Advertisement
আমাদের দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ১৬ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার মাত্রা সফলভাবে প্রচারিত হলেও সাম্প্রতিক ভয়াবহ তাপপ্রবাহ ও জরুরি এলার্টের ফলে মানুষ ঘরে বসে দিনাতিপাত করতে বাধ্য হচ্ছে। এসময় বিদ্যুতের চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় ঘন ঘন লোডশেডিং মানুষকে জানান দিচ্ছে- এটাই যথেষ্ট নয়। এখন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার সংখ্যা কত কোটি তা কারও জানা নেই। অটোর চার্জ, সেচ মেশিনের অতি ব্যবহার ও অতি গরমে গ্রামের মানুষও দেশীয় তৈরি সস্তা এসি কিনে ঘরে ঘরে লাগাচ্ছে। তাই বিদ্যুতের সংকট আরও বেশি ঘনীভূত হচ্ছে।
এপ্রিল শেষ হলো তেমন কোনো বরিষণের দেখা নেই। আবাদি জমি ফেটে চৌচির। সেচ দেওয়ার উপায় নেই। কারণ, পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। সাথে চরম অভাব লেগেছে বিদ্যুৎ সরবরাহে।
আমি একজন আশাবাদী মানুষ। চিরকাল আশা ও ভরসার মধ্যে দিয়ে পৃথিবীর সব হতাশা জয় করে মানুষ বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা খুঁজে পাক সেই চেষ্টা করি। এখনো করছি এবং ভবিষ্যতে সেটা করেই যাব। কিন্তু মানুষের কাজের গতি বন্ধ হলেই তো সম্ভাব্য বিপদের হাতছানি চলে আসে। মানুষের দেহে যেমন রক্তপ্রবাহ সঠিক থাকা জরুরি তেমনি একটি দেশের সারাদেহে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎপ্রবাহ থাকাটা খুব জরুরি।
সমস্যাটা এখানেই অনুভব করছি। পড়াশোনা ও গবেষণার জন্য দীর্ঘদিন জাপানে ছিলাম। প্রথমদিকে দেশ থেকে জাপানে গিয়ে মনে হতো সেখানে কি রাত হয় না? রাতের রাস্তায় কারও ঘুম নেই। সেটা গাড়ি, ট্রেন বা মানুষের। কোনো শব্দ নেই শুধু আলো আর আলো। সবাই শিফট বদল করে নিজের কাজ করেই যাচ্ছে। ওর মধ্যেই বিরাম, বিশ্রাম চলছে। কেউ কাউকে কোনোভাবেই ডিস্ট্রার্ব করছে না। ওরা তো গ্যাস, তেল সবই কিনে আনে। নিজের কিছুই নেই। তবুও ওদের অভাব নেই।
ও হ্যাঁ, এখনো ঢাকার চেয়ে টোকিও বা পাশের শহরতলির নির্মাণ খরচ এবং জমির দাম অনেক কম। ওদের তো বিদ্যুৎ রেশনিং করতে হয় না। ওখানে এক মিনিট কেন, এক সেকেন্ডের জন্য বিদ্যুৎ কোথাও চলে যায় না। কারণ ওরা খুব সৎ ও কর্মঠ। ওরা মুখে প্যাঁচ প্যাঁচ করে বাহুল্য কথা বলে না। কথায় ও কাজে সততা প্রমাণ করে দেখায়। আমরা চোরের খনিতে বাস করি। এটা নতুন কথা নয়। রেন্টাল বিদ্যুতের প্রভাবে টাইকুনরা এই চরম বিপদের সময় চুপ করে আছেন কেন?
এপ্রিল শেষ হলো তেমন কোনো বরিষণের দেখা নেই। আবাদী জমি ফেটে চৌচির। সেচ দেওয়ার উপায় নেই। কারণ, পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। সাথে চরম অভাব লেগেছে বিদ্যুৎ সরবরাহে।
গত বছর প্রথম দেশে জানা গেছে লোডশেডিংয়ের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করার কথা। সেটা সরকারিভাবে রাখঢাক না করে সময়সূচি ধরে ঘোষণা করা হয়েছে। সেই ঘোষণা অনুযায়ী লোডশেডিংয়ের ক্ষেত্রে নিয়ম মানা হচ্ছে না বলে সারাদেশের জনগণ অভিযোগ করে চলেছেন।
চাহিদা অনুযায়ী দূরে থাক্, এমনিতেই তো বিদ্যুৎ থাকে না। চাহিদা মতো ভোক্তাকে বিদ্যুৎ দিতে না পারলে তো ক্ষমা চাইতে হয়। এটা আমাদের কৃষ্টিতে নেই অথচ ক্ষমা চাওয়াটাই ভালো উপায়। তা না করে লোডশেডিংয়ের অনিয়ম কথাটা শুনতে ও বুঝতে গিয়ে অনেকে আরও বেশি কষ্ট পাচ্ছেন, হতাশ হয়ে পড়ছেন।
এবছর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু প্রাইমারি স্কুল খোলা। দেশে এসি সম্বলিত ক্লাসরুম কয়টি বিদ্যালয়ে আছে? এই ভয়াবহ গরমে সবার আগে কোমলমতি শিশুদের জন্য স্কুল বন্ধ করা প্রয়োজন ছিল। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সবাই হলে থাকে না। ফলে অনলাইনের খরচের কারণে শিক্ষার্থীরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে সংকটে পড়ে অনুপস্থিত থাকছে।
এগুলোই আমাদের দেশের সেবাদানকারীদের সাথে উন্নত কোনো দেশের সেবাদানকারীদের তফাৎ। কেউ কি সেটা বুকে হাত দিয়ে অস্বীকার করতে পারবেন? জোড়াতালি দেওয়া জীবনে আমাদের সবাইকে কেন বিদ্যুৎ নিয়ে কষ্টে থাকতে হবে? অভিজাত এলাকা ও বস্তি বা দুর্গম গ্রামীণ এলাকায় বাস করা সবাই তো রক্তমাংসের মানুষ। তাদের কারও শরীরে কি ঠান্ডা ও গরমের মধ্যে অনুভূতির কি কোনো পার্থক্য আছে?
লোডশেডিংয়ের জন্য যাদের চারতলার চৌবাচ্চায় কৃত্রিম পানি তুলে শিং-মাগুর মাছের প্রজেক্ট আর চলছে না, যাদের ছাদবাগানের গাছগুলো পানির অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে তাদের কথা আলাদা করে ভাবার অবকাশ নেই। রাজধানীর কোন কোন রাস্তায় সিটি করপোরেশনের কতটি গাড়ি পানি ছিটাচ্ছে বস্তি এলাকার কলসি কাঁখে খাবার পনি সংগ্রহ করতে যাওয়া দরিদ্র মানুষগুলোর কাছে সেটাও খুব বাহুল্য বা কৌতুক মনে হচ্ছে। যাদের প্রিয় ছেলের কিনে দেওয়া এসিটাও চালানো যাচ্ছে না, আইপিএসে চার্জ না হওয়ায় সিলিং ফ্যানও ঘুরছে না তাদের জন্য সবকিছু হতাশার মধ্যে নিপতিত হলেও তালের হাতপাখা দুটো কিন্তু চালানো যাবে। কারণ, আমি আশাবাদী মানুষ।মরু শহর দুবাইয়ে হঠাৎ তীব্র বন্যার মাত্রা ওদের অধিবাসীদের পাপমাত্রার কারণে ঘটেছে তা বলা মুশকিল। কারণ সেখানে শত শত ভিন্নধর্মাবলম্বী লোকের বাস। কিন্তু আমাদের দেশের ওপর কি হলো? বিপদ বার বার আসে এজন্য বিকল্প উপায় খুঁজে বের করতেই হবে। এজন্য আগাম বড় পরিকল্পনা এখনই গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।fakrul@ru.ac.bd
এইচআর/ফারুক/জিকেএস