দেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়সসীমা বর্তমানে ৩০ বছর। বয়সের এ সীমা বাড়িয়ে ৩৫ করার দাবিতে প্রায় এক যুগ ধরে আন্দোলন করছেন চাকরিপ্রার্থীরা। সরকার এ দাবিকে সেভাবে কখনো পাত্তা দেয়নি। সম্প্রতি বয়সসীমা বাড়াতে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর চিঠির পর বিষয়টি নতুন করে আলোচনায়।
Advertisement
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানো কতটা যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত তা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে চলছে নানান আলোচনা-সমালোচনা। তবে বয়সসীমা বাড়ানোর ‘ঘোর বিরোধী’ সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার। সাবেক এ আমলার ভাষ্য, ‘সর্বোচ্চ বয়স ৩০ বছরই যথেষ্ট, এর বেশি বাড়ানোর ন্যূনতম যৌক্তিকতাও দেখি না।’ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক আল-আমিন হাসান আদিব।
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানো কতটা যৌক্তিক? এর প্রভাব-ই বা কেমন হতে পারে?
সব চাকরিতে প্রবেশের একটা মানসিক বয়সও আছে। সামরিক বাহিনীতে চাকরির ক্ষেত্রে যেমন শারীরিক সক্ষমতার বিষয় থাকে, বেসামরিক চাকরিতে সেটা না থাকলেও মানসিক সক্ষমতার বিষয়টি রয়েছে বলে আমি মনে করি। পুরুষ বা নারী যেই হোক না কেন, চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর সংশ্লিষ্ট কাজে মনস্থির করা ও ভালো সার্ভিস (সেবা) দিতে হলে নির্দিষ্ট বয়সের দরকার পড়ে। ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রেও বয়সের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ।
Advertisement
যে ছেলে বা মেয়েটি ২০১৯ সালে প্রায় ৩০ বছরে আবেদন করেছিল, তার এখন বয়স ৩৩ থেকে ৩৪ বছর। এখন যদি বয়সসীমা বাড়িয়ে ৩৫ বছর করা হয়, আর কেউ এ বয়সে শেষবার বিসিএসে অংশ নেয়, তাকে তো চাকরিতে যোগ দিতে হবে ৪০ বছরে।
অনেকে বয়সসীমা বাড়ানোর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরছেন। বিশেষ করে শিক্ষাবিদরা বলছেন এটা এখন সময়ের দাবি। আপনার দ্বিমত পোষণের কারণ কী?
দেখুন, যে যাই বলুক না কেন, চাকরিতে যোগ দিয়ে কর্মক্ষেত্রে অবদান রাখতে হলে একটা নির্দিষ্ট বয়সের অবশ্যই প্রয়োজন রয়েছে। অবদান রাখতে হলে তার জন্য পর্যাপ্ত সময়ও দরকার পড়ে। আমাদের দেশে তো সাধারণ চাকরির ক্ষেত্রে অবসরের বয়সসীমা ৫৯ বছর। দেরিতে চাকরিতে যোগ দিলে অবদান রাখার সময়ও কমে আসবে। ৪০ বছরে কেউ যোগ দিলে মাত্র ১৮-১৯ বছর হাতে থাকবে।
আরও পড়ুন
Advertisement
বিসিএস কিংবা সরকারি অন্য চাকরির ক্ষেত্রে নিয়োগ প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করা গেলে কী বয়স কিছুটা বাড়ানো যাবে?
বিসিএসই তো এখন সবার কাছে তুমুল জনপ্রিয়। সরকারি কর্ম কমিশনের অধীনে যেসব পরীক্ষা হচ্ছে, কোনটাতে একজন প্রার্থী দ্রুত নিয়োগ পেয়েছেন? দেখাতে পারবেন একটাও উদাহরণ? তিন থেকে চার বছর লেগে যাচ্ছে।
একটা উদাহরণ দিই—গত মাসে অর্থাৎ, এপ্রিলে ৪১তম বিসিএসে ক্যাডারদের পদায়ন করা হয়েছে। নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরুর পর সাড়ে চার বছর লেগেছে তাদের কাজে যোগ দিতে। তার মানে যে ছেলে বা মেয়েটি ২০১৯ সালে প্রায় ৩০ বছরে আবেদন করেছিল, তার এখন বয়স ৩৩ থেকে ৩৪ বছর। এখন যদি বয়সসীমা বাড়িয়ে ৩৫ বছর করা হয়, আর কেউ এ বয়সে শেষবার বিসিএসে অংশ নেয়, তাকে তো চাকরিতে যোগ দিতে হবে ৪০ বছরে।
কম বয়সে চাকরিতে প্রবেশ এবং বেশি বয়সে প্রবেশে কর্মক্ষেত্র ও কর্মজীবীর জীবনে কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে?
একজন ব্যক্তি ২৫, ২৬ কিংবা ২৭ বছরে চাকরিতে প্রবেশ করলে তিনি অপেক্ষাকৃত তরুণ থাকেন। এ বয়সে একজন চাকরিতে যোগ দিলে তার কাজ বোঝার ও গ্রহণ করার সক্ষমতা যত থাকবে, ৪০ বছর বয়সী একজনের সেই সক্ষমতা তো আর একই হবে না, কমে আসবে বলে আমি মনে করি। প্রশিক্ষণসহ নানা ধরনের কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে তার কোনো পিছুটান থাকে না। কিন্তু বয়স বেশি হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিয়ে, অন্য চাকরির মতো পিছুটান তৈরি হয়, যা নতুন চাকরি, প্রশিক্ষণ ও অন্য কর্মসূচিতে বাধার সৃষ্টি করতে পারে।
কর্মক্ষেত্রে উচ্চপদে কম বয়সী ও নিম্ন পদে বেশি বয়সী অর্থাৎ, চাকরিজীবীদের বয়সের পার্থক্য কাজের পরিবেশে বিঘ্ন ঘটে?
অবশ্যই বিঘ্ন ঘটবে। কর্মক্ষেত্রে যারা সহকর্মী হিসেবে কাজ করবেন, সেখানেও বয়সের পার্থক্য খুব বেশি যাতে না হয় কিংবা একটা নির্দিষ্ট বয়সের ধারা বজায় রাখার প্রতিও নজর দেওয়া উচিত।
বয়স হয়তো কিছুটা বাড়ানোর কথা আসতে পারে। এ সুযোগ দেওয়া হলে আরও বড় সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে বলে আমি মনে করি। বর্তমানে যত সংখ্যক শিক্ষিত তরুণ চাকরির জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করছে, বয়সসীমা বাড়ানো হলে আরও বেশি সংখ্যক তরুণ এ অপেক্ষায় সময় পার করবে।
বর্তমানে দেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। চাকরিতে অবসরের সময়সীমাও বেড়েছে। সেক্ষেত্রে সার্বিক দিক বিবেচনায় ৩৫ বছর না হলেও কিছুটা বাড়ানোর সুযোগ আছে কি না?
হ্যাঁ, বয়স হয়তো কিছুটা বাড়ানোর কথা আসতে পারে। এ সুযোগ দেওয়া হলে আরও বড় সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে বলে আমি মনে করি। বর্তমানে যত সংখ্যক শিক্ষিত তরুণ চাকরির জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করছে, বয়সসীমা বাড়ানো হলে আরও বেশি সংখ্যক তরুণ এ অপেক্ষায় সময় পার করবে।
দীর্ঘমেয়াদে এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে সমাজে চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আমি যদি এক কথায় বলি সেটা হলো—শিক্ষিত বেকার ভয়াবহ রকম বেড়ে যাবে। পরিবারগুলো বিপাকে পড়বে। রাষ্ট্র শিক্ষিত তরুণদের কাছ থেকে প্রোডাক্টিভ (উৎপাদনমুখী) এবং উদ্ভাবনী কোনো সহযোগিতা পাবে না। সব মিলিয়ে সমাজে নেতিবাচক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।
এএএইচ/এএসএ/এএসএম