“আমার বাবা বেশীরভাগ সময় সাহিত্য গবেষণায় মগ্ন থাকতেন এবং দীর্ঘ সময় তিনি হয় লিখছেন না হয় পড়ছেন অথবা সাহিত্যিক বন্ধুদের সাথে সময় কাটাচ্ছেন। খাবার সময় বাদ দিলে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ হবার সম্ভাবনা ছিল খুবই কম। কিন্তু আমাদের সকল ভাই বোনের প্রতি তাঁর ছিল সাঙ্ঘাতিক রকম স্নেহ যদিও তিনি কখনই তাঁর আবেগ প্রকাশ করতেন না।” কথাগুলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র রথীন্দ্রনাথের। রবীন্দ্র-জন্মশতবর্ষে ১৯৬১ সালে প্রকাশিত “রবীন্দ্রনাথ সেন্টেনারি ভল্যুমে” “মাই ফাদার এজ আই নিউ হিম” শিরোনামে লেখাটা শুরু করেছেন এমনভাবে। রবীন্দ্র ব্যক্তিজীবন নিয়ে শত শত মানুষ লিখেছেন কিন্তু নিজের পুত্রের মুখে বাবার কথা শুনলে এর গুরুত্ব হয়ে ওঠে সীমাহীন। সি এফ এন্ড্রুজ, অ্যাডওয়ার্ড টমসন, উইলিয়াম রোটেনস্টাইন, কালিদাস নাগ, এরনসন, আরনেস্ট রিচসহ প্রতীচ্য ও প্রাচ্যের অগণিত মানুষ রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লিখেছেন। এসব লেখার মধ্যে এক ধরনের কেন্দ্র বিমুখীনতা ছিল বৈ কি! সে হিসেবে ঠাকুর বাড়ির অন্দরমহল থেকে সন্তান হিসেবে রথীনের অভিব্যক্তি নিশ্চিতভাবে আমাদের রবীন্দ্রনাথের কাছে নিয়ে যায়। আমার ধারণা পাঠকের মনে একধরনের গা শিহরণ ভাব জাগে!
Advertisement
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন তা নিয়ে গেল একশ বছর বিস্তর আলোচনা হয়েছে, তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে এসব নিয়ে কথাও বলেছেন। কাজেই বাঙালির কাছে তিনি আলোচিত; বললে ভুল হবে না, তিনি বেশি আলোচিত। অন্য কোনো বাঙালি নিয়ে এত আলোচনা হয়নি, ভবিষ্যতে আর কোনো বাঙালি নিয়ে এত আলোচনা হবে এটাও খুব নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। এই আলোচনার প্রধানতম কারণ হচ্ছে, তাঁর বিপুল সৃষ্টিশীলতা। রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগে বিশ্ব ইতিহাসে সম্ভবত খুব কম মানুষ পাওয়া যাবে যারা রবীন্দ্রচিন্তার বিপুল সম্ভার সম্পর্কে ধারণা রাখেননি সেটা সাহিত্যই হোক, দর্শন হোক কিংবা শিল্পকলা হোক। রবীন্দ্রনাথের চিন্তার একটা বিরাট অংশ ইংরেজিসহ অন্যান্য ভাষায় অনূদিত হয়েছে যার দরুন অনেকেই তাঁর লেখার সাথে পরিচিত হয়ে উঠেছেন। জানতে পেরেছেন তাঁর দার্শনিক ভাবনার বিচিত্র পাঠক্রম। রবীন্দ্রচিন্তার ওপর বিশেষ করে তাঁর সৃষ্টির বিভিন্ন দিক নিয়ে দেশে-বিদেশে গবেষকদের আগ্রহ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, কোন চিন্তা তাঁদের কাছে এখনো অনাবিষ্কৃত সেটাও একটা গবেষণার বিষয়বস্তু বটে! রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘ ৮০ বছর জীবনের মাত্র ২৯ বছর (১৯১২-১৯৪১) বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। পরিণত বয়সের এই ২৯ বছর ছিল তাঁর কাছে সবচেয়ে মূল্যবান। বিশ্বমানব হয়ে ওঠার পেছনে তাঁর সারাজীবনের প্রচেষ্টার গুরুত্বপূর্ণ ভাগীদার এই শেষের তিনটা দশক। কাজেই বিশ্ব সভার অনেকেই তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন, আলোচনা করেছেন, এমনকি ব্যক্তিগত আলাপচারিতার ওপর শত শত পৃষ্ঠা ভরিয়ে তুলেছেন। এ ব্যাপারে পূর্ব দেশের মানুষ তো করেছেনই, পশ্চিমা বিশ্বে এই তালিকা মোটেও নাতিদীর্ঘ নয়। তবে অনেক পাশ্চাত্যবাসী তাঁর জীবনের ওপর বায়োগ্রাফিক নোট তৈরি করেছেন। এসবের ভেতর উঠে এসেছে প্রাচ্যের এক ধ্যানী কবির জীবন-উদ্বর্তনের নানা ধাপ। এই ফাঁকে বলে রাখি, রবীন্দ্রনাথ বিশ্বসভায় পরিচিতি লাভ করার আগেই তাঁকে “বাঙালি বিশ্বকবি” উপাধিতেতে ভূষিত করা হয়। ১৯০০ সালে ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় তাঁকে এই উপাধি দেন। তিনি লেখেন, “কোন বিদেশী যদি বাংলাভাষার প্রতি আগ্রহ দেখায় তার কারণ ঐ রবীন্দ্রনাথ।” খুব সঙ্গত কারণেই এই ব্যক্তি মানুষটার প্রতি বাঙালি তথা বিদেশিদের আগ্রহ অনেকাংশে প্রবল।
রথীন্দ্রনাথ লিখছেন তাঁর বাবার না বলা কথা। ঠাকুর পরিবারের অনেকেই রবীন্দ্রনাথ নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন, অনেকেই তাঁদের সখ্যের কথা জানিয়েছেন আবেগ ভরে। ভাতুস্পুত্রী ইন্দিরা দেবী চৌধুরানীও স্মৃতিকথা লিখেছেন “আংকেল রবীন্দ্রনাথ’’ সম্পর্কে। প্রতিটা কথা আজ একশ বছর পরে হলেও আমাদের ভাবায়, আনন্দও দেয়।
শান্তিনিকেতন ছেড়ে শেষবারের মতন কবিপত্নী মৃণালিনী যেদিন ট্রেনে চড়ে কলকাতায় ফিরছেন; সেদিন সাথে ছিল রথীন। ট্রেন চলছিল লম্বা সাপের মতন পুকুরের পাশ ঘেঁষে। সাদা পদ্মফুল বিকশিত হয়ে কী এক অপূর্ব শোভা বর্ধন করেছিল কে জানে! ১৩ বছরের শিশু রথীন মাকে ডেকে সেই পদ্মফুল দেখানোর জন্য হঠাৎ বিহ্বল হয়ে উঠলো। কিন্তু মা বুঝেছিলেন সূর্য ডোবার বুঝি আর দেরি নেই! ডাক্তার সকল আশা পরিত্যাগ করেছেন। ঠাকুর বাড়িতে সেদিন এক আশ্চর্য নীরবতা। শেষবারের মতো রথীন মাকে দেখতে গেলেন, দু’চোখ বেয়ে জলের ধারা গড়িয়ে মুখ ভিজে গেল নীরবে। খুব সকালবেলা ঠাকুর বাড়ির আঙিনায় এক অসম্ভব রকম ছায়া ঘিরে ধরেছে চতুর্দিকে। কবিপত্নী বিদায় নিলেন ইহজগৎ থেকে। রবীন্দ্রনাথ মৃণালিনীর পায়ের একজোড়া চপ্পল রথীনকে দিয়ে বললেন এটা রেখে দিও।
Advertisement
কোনো মৃত্যু, কোনো হতাশা, কোনো অবসাদ রবীন্দ্রনাথের জীবনের ওপর ছায়া ফেলতে পারেনি। শুধু স্ত্রীর মৃত্যুই নয়, একের পর এক নিজের বাবা, নিজের সন্তান, বন্ধুসম বৌদি–কারো মৃত্যুই তাঁর জীবন সাধনাকে বাধাগ্রস্ত করেনি। তিনি ব্যথাকে জয় করেছেন, শক্তি খুঁজেছেন এক অলঙ্ঘনীয় সত্যের অন্য পিঠের মধ্যে। মৃণালিনীর মৃত্যুর পর কবি শান্তিনিকেতনে আরও বেশি নিজেকে জড়িত করেছেন। রথীন লিখছেন, “Vicissitudes of life, pain and affections never upset the equanimity of my father’s mind. His inward peace was not disturbed by any calamity, however painful. Some inner resources gave him the power to face and rise above misfortunes of the most painful nature”.
একবার তাঁর পায়ে বিচ্ছুতে কামড়েছিল। দু’পা মেলে ধরে বসে ছিলেন চুপচাপ। যন্ত্রণায় পা অসাড়, মনে হচ্ছিল বুঝি শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন এক ভিন্ন কোনো অঙ্গ। তাঁর অনুভূতি ছিল তীব্র কিন্তু ছিলেন সম্পূর্ণ নির্বিকার। রথীন বলছেন, সারাজীবন ধরে তিনি যে শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা আত্মস্থ করার শক্তি পেয়েছিলেন এটা তার একটা।
রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘসময় এক জায়গায় বসে লিখতেন না বা চিন্তা করতেন না; নিয়মিত জায়গা পরিবর্তন ছিল তাঁর নিত্য অভ্যাস। শান্তিনিকেতনে বার বার ফিরে ফিরে আসা এই অভ্যাসেরই একটা অংশ। সেখানে প্রায় এক ডজনেরও বেশি ছোট ছোট কটেজ ছিল। যেখানে তিনি বিভিন্ন সময় থাকতেন এবং লিখতেন। শুধু তিনি স্থানই পরিবর্তন করতেন না। গৃহসজ্জা ও আসবাবপত্রেরও অবস্থান পরিবর্তন করতেন। এখান থেকে সেখানে। সেখান থেকে ওখানে। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে তিনি একবার পুরোনো পরিত্যক্ত দুটো ঘর দারুণভাবে সাজিয়েছিলেন। রুমের ভেতর ইংরেজ শিল্পীদের আঁকা পেইন্টিংয়ে শোভিত করেন।
আগেই বলেছি, তাঁর ছিল নিত্য পরিবর্তনশীল মানসিকতা। এই খামখেয়ালীপনা দারুণভাবে অনেককে অনেক সময় সমস্যায়ও ফেলতো। একবার লন্ডন থাকাকালে নরওয়ে থেকে সে দেশ ভ্রমণের আমন্ত্রণ আসলো। কবির সাচিবিক দ্বায়িত্ব পালনকারী উইলি পিয়ারসন সাথে যাবেন। সবকিছু ঠিকঠাক। টিকিট কাটা হলো টমাস কুক নামে ট্রাভেল এজেন্সি থেকে। টিকিট কেটে আনলেন রথীন। তবে কর্তব্যরত ছেলেটা টিকিট হাতে দেওয়ার সময় মৃদু হেসে সতর্ক করে বললেন, “টিকিট কিন্তু রিফান্ড হবে না”। রথীনকে ওই ট্রাভেল এজেন্সির লোকেরা ভালো করে চিনতো। টিকিট কেটে রথীন ফিরে এলেন সাউথ কেন্সিংটনের ফ্লাটে; টিকিট, ল্যাগেজ, পাসপোর্ট, সবকিছু রেডি। হঠাৎ রবীন্দ্রনাথ বেঁকে বসলেন, কোনোরকম ওজর অজুহাত না দিয়ে বললেন তিনি নরওয়ে যাবেন না; যাবেন আগামীকাল প্যারিসে। যে কথা সেই কাজ। ফেরত দিতে হলো সেই টিকিট। গেলেন প্যারিসে।
Advertisement
রবীন্দ্রনাথের কাছে যারা থাকতেন, মোটামুটি তাঁরা জানতেন এই ধরনের হঠাৎ হঠাৎ পাগলামির কথা। এ ধরনের আচমকা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বৌমাকে নিজের সম্পর্কে বলতেন, “বাবু সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে”। তিনি যখন পূর্ব বঙ্গে আসতেন বিশেষ করে শিলাইদহে; তখন তিন মেয়ে ও দুই ছেলেসহ দারুণ সময় কাটাতেন। ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে তাঁর ছিল নিদারুণ উদ্বেগ। প্রচলিত লেখাপড়ার প্রতি তাঁর ছিল দারুণ বিতৃষ্ণা। তিনি চাননি তাঁর ছেলে-মেয়ে এই চলতি হাওয়ায় গা ভাসাক। কারণ তিনি নিজেও এই প্রচলিত লেখাপড়ার বাইরে ছিলেন। তিনি নিজে সন্তানদের বাংলা পড়াতেন। কবিতা বা গদ্য রচনা নিয়ে পড়ানোর সময় তিনি বুঝিয়ে দিতেন এই মর্মবাণী; বিশ্লেষণ করতেন এবং শেষমেশ মুখস্থ করাতেন। আমাদের দেশের অনেক বুদ্ধিজীবী আজকাল মুখস্থ করার বিরুদ্ধে নানারকম ছবক দিলেও রবীন্দ্রনাথ কিন্তু তাঁর সন্তানদের মুখস্থ করানো থেকে বিরত ছিলেন না। মুখস্থ করলে যে সেটা হৃদয়ের গভীরে বাসা বেঁধে নেয়, সেটা কবি জানতেন। রথীনের নিজের কথায়, “He would take up a poem or a piece of prose and explain it in great detail, paraphrasing and analysing every sentence, repeating it several times, so that by the end of the lesson the whole thing would not only be vividly impressed on our minds but we would be able to recite it from memory”। এরপর একের পর এক যখন অন্য শিক্ষক পড়াতে আসতেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁদের আগে শিখিয়ে দিতেন কীভাবে পড়াবে। কাজেই কবির থেকেই প্রাথমিক নির্দেশনাটা আসতো পড়ানো সংক্রান্ত।
রবীন্দ্রনাথের বিস্ময়কর প্রতিভা কারো কাছে অজানা নয়। অজানা যতটুকু আছে সেটা ওই রথীনের লেখার মধ্যেই। তিনি নিজেও বিস্ময় প্রকাশ করেছেন কীভাবে তাঁর বাবা একই সাথে কবিতা, গান, উপন্যাস, নাটক, গদ্য রচনা, কিংবা আরও বিষয়গুলো এত দক্ষতার সাথে করে যেতেন। একই সাথে বহু বিষয় নিয়ে লেখার মতো অসম্ভব ব্যাপারটা তিনি রপ্ত করেছিলেন বাল্যকাল থেকে। শুধু তা-ই নয়, লেখার মাঝে কোনো বন্ধু বা সাহিত্যানুরাগী দেখা করতে চাইলে তিনি কুণ্ঠাহীন ভাবে সময় দিতেন। হয়তো কয়েক ঘণ্টা পার করার পর তিনি যখন লেখায় ফেরত আসতেন; তখন মনে হতো মাঝখানের সময় তিনি এই লেখার মাঝেই ছিলেন! কোনো সাময়িক বাধা তাঁকে মূল চিন্তা থেকে বিচ্যুত করতে পারত না।
দিনের বেলা রবীন্দ্রনাথ ঘুমাতেন না। বিশ্রামের দরকার পড়তো না তাঁর। গ্রীষ্মের নিদাঘ দুপুরে লিখে যেতেন বিরামহীন ভাবে। ছেদ পড়তো না কোনোভাবেই। রাতে ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা ঘুমাতেন বড়জোর। কাজের ফাঁকে অবসরকালীন তিনি লিখতেন গান। বলতে গেলে গান লেখাটা ছিল তাঁর অবসরকালীন বিনোদনের অংশ। অবশ্য ছবি আঁকার সময়টাও তিনি এমনভাবে আনন্দের সাথে পার করতেন। খুব ছোটবেলা থেকে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন স্বাস্থ্যসচেতন। নিয়মিত ব্যায়াম করতেন, ছিলেন ভালো সাঁতারু। গঙ্গাতে তিনি সাঁতার কেটেছেন অনেকবার। একজন কুস্তীগির এসে কুস্তি শেখাত তাঁকে। তাঁর আকর্ষণীয় চেহারা অনেককেই বিমোহিত করতো। দেশের বাইরেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক ধরনের কৌতূহলের বিষয়বস্তু। ১৯৩০ সালে জার্মানির মিউনিখ থেকে ফিরছেন। হঠাৎ তাঁকে দেখে অভিভূত মানুষ বিস্ময়কর শব্দ উচ্চারণ করে বলে উঠলেন, তিনি আমাদের আরাধ্য পরম পুরুষ! এর আগে ১৯২১ সালের জুন মাসে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বক্তৃতা দেওয়ার সময় তাঁর অনুষ্ঠানের হল রুমে বহু ছাত্রী জনতার ভিড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন, বহু মেয়ে হয়েছিলেন পদদলিত। লন্ডনের ডেইলি নিউজ ১৯২১ সালের ৩ জুন ফলাও করে এ সংবাদ ছেপেছিল।
রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিজীবনে ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু। এটা ঠাকুর বাড়ির ভেতরে বাইরে অনেকেই জানেন। স্ত্রী মৃণালিনী অসুস্থ হলে তিনি পরম মমতায় শুশ্রূষা করেন। অন্যের কষ্ট তিনি সহ্য করতে পারতেন না। মেয়ে রানু টিবি-রোগে আক্রান্ত হলে তাঁর সে কী ব্যস্ততা! হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার ওপর কবির আস্থা ছিল সাংঘাতিক। একবার নৈনিতালে বেড়াতে গেছেন। পাশেই একটা আপেল বাগান। সেখানকার একজন কাঠমিস্ত্রী দুরারোগ্য সেন্ট ভিটাস ড্যান্স রোগে আক্রান্ত। এটা একটা নিউরোলজিক্যাল ডিজঅর্ডার। কবি তাকে দিলেন হোমিওপ্যাথি ওষুধ। কয়েকদিন পর ফিরে এসে জানালেন তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ। মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লো ডাক্তার হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি। ঠিক এমন সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে সম্মানসূচক অনারারি ডক্টরেট উপাধিতে ভূষিত করলে সবাই তাঁকে ড. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখতে শুরু করলেন। নৈনিতালের রামগড়ে অবস্থানরত কবিকে সেসময় যত মানুষ চিঠি লিখতেন সবাই ড. রবীন্দ্রনাথ লিখতেন। এতে স্থানীয় পোস্ট মাস্টার চারিদিকে প্রচার করে দিলেন এখানে কলকাতা থেকে খুব নামকরা একজন ডাক্তার এসেছেন। এতে খুব সকাল থেকে গ্রামবাসীদের চিকিৎসা দেওয়া ছাড়া বিকল্প কিছু থাকলো না। এমনকি শান্তিনিকেতনে থাকাকালে প্রতিটা শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীর দেখাশোনার জন্য তিনি দিনের একটা বড় অংশ ব্যয় করতেন।
রবীন্দ্রনাথ ছোট ছোট শিশুদের নাম দিতেন। আবার বড়দের নামও অনেক সময় পাল্টিয়ে দিতেন সুন্দর করে। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, অমর্ত্য সেন, শান্তিদেব ঘোষ, এমনকি নিজের স্ত্রীর নামও পাল্টে দিয়েছিলেন কবিগুরু। বুদ্ধদেব বসুর মেয়েদের নামকরণ করেছিলেন গুরুদেব। শান্তিনিকেতনে আসার আগে শান্তিদেব ঘোষ ছিলেন শান্তিময়। শান্তিময় থেকে শান্তিদেব হয়ে গেলেন গুরুদেবের নজরে এসে। কবিপত্নী মৃণালিনী ঠাকুর বাড়ি প্রবেশের আগে ছিলেন ভবতারিণী। অচল এই নামটা পরিবর্তন করে করা হল মৃণালিনী।
রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিজীবনের অন্যতম আরেকটা দিক হচ্ছে তাঁর দেশপ্রেম। তবে একটা বিষয় ভুললে চলবে না যে অহেতুক সংকীর্ণতা তিনি পরিহার করেছেন সচেতনভাবে। এজন্য তাঁর ন্যাশনালিজমের ধারণা সম্পূর্ণ আলাদা। দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ তোলা তাঁর অনেক স্বপ্নের একটা। এজন্য তিনি কৃষি শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এজন্য সুদূর আমেরিকাতে তিনি পাঠিয়েছিলেন রথীনকে; এমনকি জামাই নগেন গাঙ্গুলিকেও। ১৯০৯ সালে রথীন আমেরিকা থেকে ফেরত আসলে তাঁকে নিয়ে তিনি পূর্ব বাংলাতে আসেন। নৌকা ভ্রমণ ছিল তাঁর দারুণ শখের একটা ব্যাপার। এ সময় তিনি রাজশাহী, নদিয়া, শান্তিনিকেতন ইত্যাদি জায়গায় গ্রামীণ উন্নয়নের বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে থাকেন।
একবার তিনি গোল আলু চাষ করেন। কিন্তু আলু চাষে মারাত্মক লোকসান হলেও ভেঙে না পড়ে পূর্ণ উদ্যমে আবার ধান এবং ভুট্টা চাষে মনোযোগী হন। নতুন জাতের ধান আনেন আমেরিকা থেকে আর ভুট্টা আনেন মাদ্রাজ থেকে। এ ছাড়া কৃষি উৎপাদনে ব্যাপক সফলতা পাওয়ার জন্য নানারকম প্রজেক্ট হাতে নেন।
গান্ধীজির সাথে তাঁর চিন্তার দূরত্ব ছিল অসীম। গান্ধীজির অনেক কিছুই তিনি গ্রহণ করেননি, মেনে নেননি তাঁর তাথাকথিত স্ববিরোধী আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা। অথচ সামনাসামনি তিনি কোনোদিন অসম্মান করেননি। ১৯২১ সালে জওহরলাল নেহেরু প্রথম যখন শান্তিনিকেতনে যান, সাথে নিয়ে যান গান্ধীকে। নেহেরু একটু বিব্রত হয়ে ছিলেন এ দুজনের দেখা হলে পাছে কোনো অনাসৃষ্টি না বাঁধে! অথচ রবীন্দ্রনাথ কি নজিরবিহীন সম্মান দেখালেন গান্ধীজিকে!
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অত্যন্ত সুপুরুষ। তাঁর ভাতুস্পুত্রী ইন্দিরা দেবী লিখেছেন, তিনি শৈশবকাল থেকে পরিণত বয়েসে আরও বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিলেন। দীর্ঘদেহী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, যেমন ছিল ব্যক্তিত্ব তেমনি অসামান্য দক্ষতা। গান গাইতে পারতেন, পারতেন অন্যকে বিমুগ্ধ করতে অতি অল্প সময়ে। তাঁর প্রতি কেউ বিরূপ হলেও তিনি প্রতিহিংসা দেখাননি মুহূর্তের জন্যও। ১৯১২ সালে লন্ডনে বার্ট্রান্ড রাসেলের সাথে প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল তাঁর। কিন্তু সাক্ষাৎটা মোটেও সুখকর হয়নি। রাসেল বলতে গেলে স্বাভাবিক সৌজন্যতা দেখাননি। এর কারণ রাসেলের দর্শনের সাথে তাঁর চিন্তার ছিল আকাশ পাতাল তফাৎ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর চিন্তার কুণ্ঠাহীন প্রশংসা করেন। ক্যামব্রিজ দার্শনিক ভিটগেন্সটাইন তাঁর প্রতি প্রথম দিকে কিছুটা বিরক্ত হলেও পরবর্তীতে তাঁর প্রতি সাংঘাতিক আকৃষ্ট হন। ভিটাগেন্সটাইনের চিন্তার মোড় বদল হওয়ার পেছনে রবীন্দ্রনাথের যথেষ্ট প্রভাব আছে।
ফরাসি সাহিত্যিক রোমাঁ রোলাঁ ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের একজন। ১৯১৯ সাল থেকে মৃত্যু অবধি তাঁদের ছিল অকৃত্রিম বন্ধুত্ব। আইনস্টাইনের সাথেও ছিল তাঁর দারুণ সখ্য। বিশ্বের খুব মানুষই ছিলেন যারা রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় মুগ্ধতা প্রকাশ করেননি। তাঁর ছিল দারুণ এক সম্মোহনী শক্তি। যেখানেই যেতেন সেখানেই সৃষ্টি হতো একটা অনবদ্য পরিবেশ। এ ধরনের এক সম্মোহনীর গল্প বলে শেষ করি। ১৯২০ সালের কথা। রবীন্দ্রনাথ গেছেন লন্ডনে। সুসান ওয়েন নামে এক ভদ্রমহিলা শুনেছেন রবীন্দ্রনাথ লন্ডনে। কিন্তু ঠিকানা জানেন না। তিনি রবীন্দ্রনাথকে একটা চিঠি লিখে পোস্ট করেছেন এবং খামের ওপর শুধু লিখেছেন “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর”। তার বিশ্বাস ছিল ডাক বিভাগ এই মানুষটাকে নিশ্চয়ই খুঁজে পাবে। চিঠিতে সুসান যা লিখেছেন তা ছিল একদিকে অত্যন্ত মর্মান্তিক; অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের প্রতি সীমাহীন শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। “প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যাবার সময় আমার পুত্র উইলফ্রেড ওয়েন আমার কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় বলে গেল তোমার গীতাঞ্জলির সেই অমর বাণী, “যাবার দিনে এই কথাটি বলে যেন যাই, যা দেখেছি যা পেয়েছি তুলনা তার নাই”। যুদ্ধ শেষে যখন তার মরদেহটা পাওয়া গেলো তখন তার বুকপকেটে ছোট্ট একটা চিরকুট আবিষ্কার করলাম। সেই চিরকুটে লেখা ছিল ঐ কথাগুলো যেগুলো বলে সে আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিল। আর নিচেই লেখা ছিল তোমার নাম, “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর”।’’
এসইউ/এএসএম