দেশজুড়ে

বিলাসী রিসোর্টের বলি ৬০-৭০ বছর বয়সী ৩১ গাছ

ফরিদপুর শহরের টেপাখোলা লেকপাড়ে ১৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘ফরিদপুর টেপাখোলা রিসোর্ট’ নামে এক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। জেলা পরিষদের জায়গায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। আর এ প্রকল্প বাস্তবায়নে কাটা পড়বে সেখানকার ৬০-৭০ বছর বয়সী ৩১টি গাছ। এরইমধ্যে গাছগুলো কাটতে টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। এগুলো কাটতে গায়ে খোদাই করে চিহ্ন দিয়ে দেওয়া হয়েছে।

Advertisement

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে ২১১ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘ফরিদপুর টেপাখোলা রিসোর্ট’ নামে প্রকল্পটি পাস হয়। তৎকালীন স্থানীয় সংসদ সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেনের প্রচেষ্টায় প্রকল্পটি একনেকের বৈঠকে যায়। নকশা অনুযায়ী টেপাখোলা রিসোর্টে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য, টেপাখোলা রিসোর্ট স্কুল ব্লক, জিমনেসিয়াম, মসজিদ, রিসোর্ট সেন্টার, ভিক্টরি মিউজিয়াম, ভিক্টরি কমপ্লেক্স, ওয়ান্ডার হুইল, ফুড কোর্ট, সিনিয়র সিটিজেন কর্নার, আর্ট অ্যান্ড ক্রাফ্ট সেন্টার, চিল্ড্রেন ওয়াটার গেম, চিল্ড্রেন সুইমিংপুল, টেপা ক্যাফে ও হল, অ্যাম্পিথিয়েটার, বোর্ট ল্যান্ডিং ক্যাফে ও বঙ্গবন্ধু ইনডেক্স ফিঙ্গার টাওয়ার তৈরির পরিকল্পনা ছিল। পরে বঙ্গবন্ধু ইনডেক্স ফিঙ্গার টাওয়ারটি বাদ দিয়ে প্রকল্পের বরাদ্দ ১৮০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়।

ফরিদপুর-৩ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য এ কে আজাদ আগামী একমাসের মধ্যে এ রিসোর্টের কাজ উদ্বোধন করবেন বলে এলজিইডি ফরিদপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহিদুজ্জামান খান জানিয়েছেন।

ফরিদপুর জেলা পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, টেপাখোলা লেকটি ১৪ একর জমির ওপর অবস্থিত। এ লেকসহ আশপাশে মিলিয়ে ১৮ একর জমির ওপর লেকের উন্নয়ন, সম্প্রসারণ ও সৌন্দর্যবর্ধনের প্রকল্প নিয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। ২০২৬ সালের ৩০ জুন প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। তবে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করেছেন প্রকল্প পরিচালক। এ কাজে প্রথম পর্যায়ে ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে লেকপাড়ের পুরোনো ৩১টি গাছ বিক্রির জন্য গত ২৮ মার্চ ৯ লাখ ৯০ হাজার টাকায় নিলাম করা হয়।

Advertisement

সরেজমিন দেখা যায়, টেপাখোলা লেকের পূর্ব ও দক্ষিণ পাড়ের সড়কের পাশে মেহগনি, আম, কাঁঠাল ও নারিকেল গাছ রয়েছে। গাছগুলোর বয়স আনুমানিক ৬০-৭০ বছর। এরইমধ্যে গাছগুলো কাটতে সেগুলোর শক্ত বাকল কেটে লাল রং দিয়ে সংখ্যা বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেকোনো সময় গাছগুলো কেটে ফেলা হবে। এছাড়া প্রায় এক সপ্তাহ ধরে শ্যালো ইঞ্জিনের মাধ্যমে লেকের পানি সেচে ফেলার কাজ শুরু হয়েছে।

তবে পুরোনো এ গাছগুলো কাটার সিদ্ধান্তে স্থানীয় ও শহরবাসীর মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। নগরায়নের যুগে শহরবাসীর প্রাতঃভ্রমণ, বৈকালিক হাঁটা এবং স্বস্তির শ্বাস নেওয়ার একটি বড় স্থান এ লেকপাড়। তীব্র গরম পড়লে অসংখ্য মানুষ প্রতিদিন বিকেলে এখানে ছুটে আসেন একটু স্বস্তি পেতে। পাশাপাশি সারাবছরই শহরের বিভিন্ন মহল্লা থেকে সর্বস্তরের লোকজন ছুটে আসেন লেকপাড়ে অলস ও অবসর সময় কাটাতে।

স্থানীয় বাসিন্দা জাহিদুর রহমান বলেন, ‘ছোটকাল থেকেই গাছগুলো দেখে আসছি। এখানকার লেকের স্বচ্ছতার সঙ্গে গাছগুলোর ছায়াময় পরিবেশ এক দারুণ নিসর্গের অনুভূতি তৈরি করেছে। এ কারণে প্রাকৃতিকভাবেই এটি একটি সুন্দর বিনোদন স্পট হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। এখন এই গাছগুলো কেটে ফেললে এই পরিবেশটাই বদলে যাবে।’

স্বপন মৃধা নামে আরেক বাসিন্দা জাগো নিউজকে বলেন, ‘গাছগুলোর ছায়ায় আমরা ছোট থেকে বড় হয়েছি। তীব্র গরমে একটু স্বস্তি পেতে স্থানীয়রাসহ শহরের বিভিন্ন প্রান্তের অসংখ্য মানুষ এখানে ছুটে আসেন। এখন নাকি এখানে বড় প্রকল্প হবে। পুরোনো গাছগুলো কেটে ফেলা হবে। গাছগুলো কাটার খবরে খুবই মন খারাপ হচ্ছে।’

Advertisement

বাসিন্দা রুস্তম মিয়া বলেন, ‘গাছগুলো ফরিদপুরের ফুসফুস ও অক্সিজেনের ভান্ডার। এলাকার মানুষ এসব গাছের নিচে এসে বিশ্রাম নেন। গাছগুলো কাটা বন্ধ করতে হবে।’

টেপাখোলা লেকপাড়ের বাসিন্দা ও পরিবেশকর্মী এস এম মনিরুজ্জামান মনির বলেন, ‘যেহেতু মূল নকশা অনুযায়ী কাজটি হচ্ছে না, তাই গাছগুলো বাঁচিয়ে রেখেই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা যেতো। পরিবেশ রক্ষায় গাছগুলো না কেটে বাঁচিয়ে রাখা হোক।’

ফরিদপুর সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সদস্য মনোয়ারুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমরা উন্নয়নের বিরোধী নই। তবে গাছগুলো রক্ষা করে এ প্রকল্পের কাজ করা সম্ভব। গাছগুলো কেটে ফেলার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখছি না।

গাছগুলো কেটে ফেললে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে বলে জানান ফরিদপুর নাগরিক মঞ্চের তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক মাহফুজুল আলম মিলন।

এ বিষয়ে ফরিদপুর জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. বাকাহীদ হোসেন বলেন, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার বাসভবন ও বড় বড় গাছগুলো রক্ষা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এগুলো রেখে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয় বলে স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে আমাদের জানানো হয়। ৩১টি গাছ কাটা হলেও পাশাপাশি এক হাজার ৭৬২টি গাছ রোপণ করা হবে। এটি সরকারি উদ্যোগে একটি দৃষ্টিনন্দন কাজ হবে।

এসআর/এএসএম