দেশজুড়ে

উপজেলা নির্বাচনে কঠিন সমীকরণে মুজিব-আবছার

কক্সবাজার সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ আগামীকাল ৮ মে। জেলার তিন উপজেলা মহেশখালী, কুতুবদিয়া ও কক্সবাজার সদরে এদিন ইভিএম পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।

Advertisement

গত ২৩ এপ্রিল সদরে প্রতীক বরাদ্দ নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় নামেন তিন প্রার্থী কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, কক্সবাজার পৌরসভার সাবেক মেয়র মুজিবুর রহমান চেয়ারম্যান, সাবেক পৌর চেয়ারম্যান নুরুল আবছার ও বর্তমান চেয়ারম্যান কাইসারুল হক জুয়েল। কিন্তু পাঁচ দিনের মাথায় নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন জুয়েল। এরপরই জমে উঠেছে চেয়ারম্যান প্রার্থী মুজিবুর রহমান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল আবছারের প্রচারণার লড়াই।

তবে মুজিবুর রহমানকে হারাতে নুরুল আবছারের পক্ষে একাট্টা হয়ে মাঠে নেমেছেন কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মাহবুবুর রহমান মাবু, একাধিক কাউন্সিলর এবং সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহমুদুল করিম মাসুদসহ একাধিক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান-মেম্বার। তাদের পেছনে সবকিছুর যোগান দিচ্ছেন স্থানীয় এমপি হুইপ সাইমুম সরোয়ার কমল।

এমনটি অভিযোগ করে নানা পথসভায় মুজিবুর রহমান নিজেই বলেছেন, নির্বাচনে তার প্রতদ্বন্দ্বী নুরুল আবছার নন, তিনি লড়ছেন হুইপ কমল, মেয়র মাবুসহ তার হাতে গড়া নেতা ও তাদের কালো টাকার বিরুদ্ধে।

Advertisement

এসব কারণে বলতে গেলে হুচটই খেয়েছেন ঝিলংজা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান থেকে সেবা শুরু করে মেয়র, পৌর আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা মুজিবুর রহমান।

তার হাত ধরে দলীয় পদবীর অধিকারী হওয়া অনেকে এবং দলীয় সিদ্ধান্তে মেয়র-এমপি বানাতে মাঠে কাজ করেও কেন মুজিবের বিরুদ্ধে এ বৈরীতা? এমন প্রশ্ন এখন সাধারণ মানুষের মুখে মুখে। দলীয় জনপ্রতিনিধি ও একাংশ নেতাদের এ বিরোধিতার কারণে মুজিব-চেয়ারম্যান কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখী পড়েছেন বলে অভিমত রাজনৈতিক বোদ্ধা মহলের।

দলের নেতা-কর্মী ও ভোটারদের মতে, নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর দিকে উপজেলা জুড়ে মুজিবুর রহমানের আনারস প্রতীকের পক্ষে রব ওঠে। কিন্তু আরেক হেভিওয়েট প্রার্থী মুজিবের চাচাতো ভাই কায়সারুল হক জুয়েল নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেওয়ার পর নুরুল আবছারের মোটরসাইকেল প্রতীকের পক্ষে জোর প্রচারণায় মাঠে নামেন কক্সবাজার পৌরসভার বর্তমান মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান চৌধুরী, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহমুদুল করিমসহ অনেকে। তাদের সঙ্গে বিভিন্ন প্রচারণা সভায় যোগ দিয়েছেন ঝিলংজা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান টিপু সুলতানসহ পৌরসভার কাউন্সিলর ও পাঁচটি ইউনিয়নের সাবেক ও বর্তমান বেশ কয়েকজন ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বার।

এসব সভায় মেয়র মাহবুব বলেন, দুর্নীতি-দখল বাণিজ্য, লুটপাট ঠেকাতে নুরুল আবছারকে বিজয়ী করতে হবে। নুরুল আবছার যোগ্য লোক, তিনি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলে মানুষ ন্যায়বিচার পাবে। নুরুল আবছারের পক্ষে গণজোয়ার রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

Advertisement

মেয়র মাবুর মতো মুজিবকে কক্সবাজারের সকল অপকর্মের হোতা হিসেবে উল্লেখ করে নির্বাচন নিজেদের মতো বয়কট করার আহ্বান জানান কক্সবাজার সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহমুদুল করিম মাদু।

অপরদিকে মুজিবুর রহমানের পক্ষে মাঠে নেমেছেন কক্সবাজার পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম, কক্সবাজার সদর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ রেজাউর রহমান রেজাসহ শহর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও পাঁচটি ইউনিয়নের সাবেক ও বর্তমান কয়েক ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বাররা।

নজিবুল ইসলামের মতে, মেয়র থাকাকালে গত পাঁচ বছরে মুজিবুর রহমান কক্সবাজার পৌরসভার যেসব উন্নয়ন করেছেন তা গত অর্ধশত বছরেও কেউ করে দেখাতে পারেননি। উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলে পুরোনো অভিজ্ঞতায় পুরো উপজেলার রাস্তাঘাটসহ দৃশ্যপট পাল্টে যাবে। মুজিবুর রহমান মেয়র নির্বাচিত হওয়ার আগে ঝিলংজা ইউনিয়নের টানা ১৪ বছর ইউপি চেয়ারম্যান ছিলেন। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে উচ্চ পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সর্বসাধারণকে সেবা দিয়েছেন। পথসভায় আমরা তার অতীত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের তালিকা তুলে ধরে, মাদক-সন্ত্রাস, অপরাধ বন্ধের পাশাপাশি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আশ্বাস দিচ্ছি।

এদিকে বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান কায়সারুল হক গত ২৩ এপ্রিল প্রতীক বরাদ্দ নিয়ে শহর এবং আশপাশ এলাকায় পোস্টার ও ব্যানার সাঁটিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় নামেন। কিন্তু পাঁচদিনের মাথায় তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। এ সময় মুজিবুর রহমানের দুর্নীতি, লুটপাট ও ক্ষমতার দাপটের কথা তুলে ধরে তাকে প্রত্যাখানের অনুরোধও জানান জুয়েল।

মুজিব ও জুয়েল সম্পর্কে চাচাতো-জেঠাতো ভাই। জুয়েলের বাবা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম মোজান্মেল হক জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও কক্সবাজার পৌরসভার প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন। জুয়েলের বড় ভাই শাহীনুল হক বর্তমানে কক্সবাজার জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। তাই জুয়েলের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো এবং সরে যাওয়ারকালে মুজিবের বিরুদ্ধে প্রচারণায় সবাইকে আশ্চর্যান্বিত করেছে। এতে আবছার লাভবান হচ্ছেন বলে মনে করছেন অনেকে।

তবে শেষ সময়ে এসে মুজিবের হয়ে মাঠে নেমেছেন কক্সবাজার জেলা পরিষদের কয়েকবারের চেয়ারম্যান ও সাবেক সাংসদ মোস্তাক আহমদ চৌধুরী, তার স্ত্রী সাবেক এমপি কানিজ ফাতেমা আহমেদ, চৌফলদন্ডী ইউপি চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমানসহ তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মী। তাই এখন আবার মুজিবুর রহমানের পক্ষে গণজোয়ার চলছে বলে মনে করছেন সচেতন ভোটাররা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের অনেক নেতা বলেন, নুরুল আবছার অতীতে সবসময় সরকারি দলের লেজুড়বিত্তি করে এসেছেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে দীর্ঘ অবস্থানের পর এখন আওয়ামী লীগ কর্মী হিসেবে ঘুরছেন। কিন্তু তিনি দলের বিশ্বস্ত কর্মী নন। এরপর ব্যক্তিদ্বন্দ্বের স্বার্থে তার পক্ষে দলের বেশ কিছু নেতা প্রকাশ্যে ভোট করছেন। নিজেরা নিজেদের উপজেলায় নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত থাকায় জেলার নেতারা না থাকলেও মুজিবুর রহমানের পক্ষেও আওয়ামী লীগের নানা স্তরের নেতাদের দেখা যাচ্ছে। তবে অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, দলের একটি প্রভাবশালী মহল চাইছেন না মুজিবুর রহমান জিতে আসুক।

এ কারণে ঝিলংজায় ১৪ বছরের চেয়ারম্যানি সেবা, কক্সবাজার পৌরসভায় ৫ বছর সেবা, সরকার ক্ষমতায় আসার পর হতে দলীয় নানা পদে আসীন হয়ে এখনো সেবা নিয়মিত করণে কতটুকু মানুষের মন জয় করতে পেরেছেন তা নির্ণয়ের এখনই সময়। তাই এবারের উপজেলা নির্বাচন মুজিব চেয়ারম্যানের কঠিন পরীক্ষাই বটে।

চেয়ারম্যান প্রার্থী মুজিবুর রহমান বলেন, মাঠের অবস্থায় মনে হচ্ছে নুরুল আবছার আমার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী নন। আমাকে লড়তে হচ্ছে কক্সবাজার পৌর মেয়র মাবু ও হুইপ সাইমুম সরোয়ার কমল এমপির বিরুদ্ধে। অথচ দলীয় সিদ্ধান্তে আমিই তাদের মেয়র ও এমপি বানিয়েছি। এখন পৌরসভার সরকারি গাড়ি ব্যবহার করে আমার পোস্টার, ব্যানার ছেঁড়া হচ্ছে। আমার অবস্থান কক্সবাজারের মানুষের অন্তরে। ব্যানার পোস্টার ছিঁড়লেও তারা আমাকে মনে রাখবে। ৮ মে এর প্রতিফলন ঘটবে। আমি জয়ী হয়ে আসলে, তাদের কর্মকাণ্ডে নানা জায়গায় জবাবদিহিতায় পড়তে হবে। তাই তারা আমাকে নির্বাচনী মাঠে হারাতে চাচ্ছে বলে আমার ধারণা।

অপরদিকে চারবার পৌর চেয়ারম্যান থাকা ডায়নামিক নেতা হিসেবে পরিচয় পাওয়া নুরুল আবছার একদশক ধরে তেমন জন সম্পৃক্ততায় নেই। একসময়ের জনপ্রিয়তা ও বর্তমানে মেয়র, আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী, জনপ্রতিনিধি ও কমিউনিটি নেতাদের সম্পৃক্ততায় মাঠে বিচরণ বেড়েছে। তিনি জয় ছিনিয়ে নিতে পারবেন কি-না, এ নিয়ে সমীকরণরা কঠিনই হয়ে উঠেছে। জয় পেলে তিনি মহারাজের আদলে আভির্ভূত হবেন। আর পরাজয় হলে, ছিটকে পড়বেন আলোচনা হতে এমনটি অভিমত রাজনৈতিক বোদ্ধাদের।

তবে নিজেকে পূর্বের মতোই জনপ্রিয়তায় এগিয়ে রয়েছেন বলে দাবি করেছেন নুরুল আবছার। সুষ্ঠু ভোট হলে জয় সুনিশ্চিত বলে দাবি তার।

কক্সবাজার পৌরসভা ও ঝিলংজা, পিএমখালী, খুরুশকুল, চৌফলদন্ডী ও ভারুয়াখালী এ পাঁচটি ইউনিয়ন নিয়ে সদর উপজেলার মোট ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ২২ হাজার ৯৯৬ জন। ভোটকেন্দ্র ৮২টি। পৌরসভার ভোটাররা নির্বাচনে বড় প্রভাব ফেলতে পারে। কক্সবাজার পৌরসভার ভোটার রয়েছেন ৬৭ হাজার ৫৭৭। এ ভোটাররাই উপজেলা নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন।

এফএ/এমএস