কৃষি ও প্রকৃতি

‘গোল্ডেন রাইস ও বিটি বেগুন চাষ কৃষকের স্বার্থে নয়’

গোল্ডেন রাইস নামের ধানের নতুন জাত ও বিটি বেগুন চাষাবাদের অনুমোদনের জন্য ফের তৎপর হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ও আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। দেশের কৃষিতে জেনেটিকালি মডিফাইড প্রযুক্তি ব্যবহারের যে উদ্যোগ শুরু হয়েছে এবং বিজ্ঞানের নামে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো যেভাবে কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করছে তা বেশ উদ্বেগজনক। এখানে দেশের কৃষকের বা দেশের জন্য কোনো স্বার্থ হাসিল হয়নি। এটা শুধু বাণিজ্যের জন্যই করা হয়েছে।

Advertisement

সোমবার (৬ মে) জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে জিএম শস্য গোল্ডেন রাইস এবং বিটি বেগুন: বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় প্রশ্নের নিরসন জরুরি শীর্ষক মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন বক্তারা। সভার আয়োজন করে বেলা, উবিনীগ, জিএমও বিরোধী মোর্চা, নয়াকৃষি আন্দোলন ও নাগরিক উদ্যোগ।

মতবিনিময় সভায় বীজ বিস্তার ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট ড. এম এ সোবহান বলেন, প্রকৃতির ওপর হস্তক্ষেপ করলে প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নেয়। যেটা করা হচ্ছে, বিটি ব্রিঞ্জাল ও গোল্ডেন রাইস এই দুইটাই কিন্তু আত্মঘাতী। এখানে জেনেটিক সাইন্সের থেকে বেশি হচ্ছে বাণিজ্য। এখানে বুঝতে হবে এ কোম্পানি গুলোর অরিজিন কোথায়। এখানে তাদের স্বার্থ হাসিল করতেই এমন করা হচ্ছে, এখানে বিজ্ঞানের কোনো কৃতিত্ব নেই।

তিনি বলেন, ভুট্টা থেকে জীন নিয়ে ধানে ইনসার্ট করে গোল্ডেন রাইস করা হয়েছে। বলা হচ্ছে ভুট্টায় ভিটামিন এ আছে এখন থেকে ধানেও ভিটামিন এ পাওয়া যাবে। তাহলে ভুট্টা কেন খাবো না আমি, ভুট্টা খেলেইতো সমাধান হয়ে যায়। এবং ভুট্টার ফলন ধানের থেকে বেশি। গোল্ডেন রাইস কিন্তু আমার, আপনার, কৃষকের বা দেশের জন্য করা হয়নি। এটা শুধু বাণিজ্যের জন্যই করা হয়েছে।

Advertisement

বিটি বেগুনের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিটি বেগুন নিয়ে বলা হচ্ছে এটা কাণ্ড ও ফল ছিদ্রকারী পোকা প্রতিরোধ করে। কিন্তু ফল হওয়ার আগেই যদি ফাংগাসের কারণে গাছটা মারা যায় তাহলে এই বিটির কোন দরকার আছে কী ?

সভায় লিখিত বক্তব্যে উবিনীগ এর নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আখতার বলেন, দেশের দুটি প্রধান ফসল ধান এবং সবজির ওপর জেনেটিক ইঞ্জিনীয়ারিং করা, এর স্বত্ত বিদেশি কোম্পানির হাতে দিয়ে দেওয়া, পরিবেশ ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও কৃষক পর্যায়ে চাষের অনুমোদনের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে সরকারকে আমাদের উদ্বেগ জানাচ্ছি এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ও কার্যক্রম গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি।

তিনি বলেন, বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশান গোল্ডেন রাইসকে পুষ্টির একটি মাধ্যম হিসেবে দিয়ে দাতব্য ভাব দেখাতে চাচ্ছে। তারা দাবি করছে ভিটামিন-এ ঘাটতি এবং রাতকানা রোগের জন্য এ ধানের ভাত খেতে হবে। কিন্তু বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ভিটামিন-এ পাওয়ার উৎস আমাদের খাদ্য ব্যবস্থার মধ্যেই আছে।

তিনি বলেন, জিএম ফসল হিসেবে গোল্ডেন রাইসের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সংক্রান্ত ঝুঁকি, কার্যকারিতা এবং এই ধানের আদৌ কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে কি না এই সব প্রশ্নের উত্তর এখনো পাওয়া যায়নি। আমরা পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ জানাচ্ছি যে, তারা সময় নিয়ে এর নিরাপত্তার দিক বিবেচনা করছেন এবং এখনও অনুমোদন দেওয়া হয়নি। কিন্তু কোম্পানি এবং উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে তাড়া দেওয়া হচ্ছে। তারা সরাসরি সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে।

Advertisement

তিনি আরও বলেন, গোল্ডেন রাইস সারা বিশ্বে বিতর্কিত। ফিলিপাইনে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলা হলেও এখন তা বাতিল করা হয়েছে এবং এর বিরুদ্ধে ফিলিপিনো কৃষকরা ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। কাজেই ফিলিপাইনের উদাহরণ দিয়ে বাংলাদেশে অনুমোদন নেওয়ার কোনো অর্থ নেই।

ফরিদা আখতার বলেন, আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সবজি বেগুনেও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করা হয়েছে। এর নাম দেওয়া হয়েছে বিটি বেগুন। ব্যাসিলাস থুরিনজেনসিস (বিটি) ব্যাকটেরিয়া থেকে ক্রিসটাল জিন বেগুনে সংযোজন করা হয়েছে। উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে বেগুনের ফল ও কাণ্ড ছিদ্রকারী পোকা প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। ভারতের মহারাষ্ট্র হাইব্রিড বীজ কোম্পানি মাহিকো বহুজাতিক বীজ কোম্পানি মনসান্টোর সহায়তায় বেগুনের জিন বিকৃতির এ কাজটি সম্পন্ন করে ২০০৫ সালে।

বিটি বেগুন গবেষণা একই সঙ্গে ভারত ও ফিলিপাইনে করা হলেও, এসব দেশে কোন ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি। ভারতের পরিবেশ মন্ত্রণালয় বহুজাতিক কোম্পানি মনসান্টোর স্থানীয় সহায়ক মাহিকো উদ্ভাবিত বিটি বেগুন ছাড়ের ওপর মরেটোরিয়াম জারি করেছে ২০১০ সালে। এমনকি ভারতের সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন প্যানেল অনির্দিষ্টকালের জন্য জিএম ফসলের সবরকম মাঠ পরীক্ষা বন্ধের সুপারিশ করেছে। অন্যদিকে ফিলিপাইনের কোর্টে গ্রীনপিস দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার একটি রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ বিভাগ এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগকে বিটি বেগুনের মাঠ পর্যায়ের গবেষণা বন্ধের জন্যে ২০১৩ সালে আদেশ দেওয়া হয়েছিল। জানা গেছে, যে ভারতে ছাড়পত্র পেতে ব্যর্থ হয়ে তারা প্রথম ফিলিপাইনে চেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু সেখানেও সফল না হয়ে তাদের শেষ চেষ্টা ছিল বাংলাদেশ।

তিনি আরও বলেন, জিএমও নতুন স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরির সম্ভাবনা তৈরি করছে যা কৃষক এবং ভোক্তা উভয়ের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। আশা করছি পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের জাতীয় বায়োসেফটি কমিটি এসব বিষয় ভালোভাবে পরখ করবেন। এছাড়া স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়সহ সব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কাছে বিষয়গুলো নিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।

সংবাদ সম্মেলনে নিরাপদ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ইবনুল সায়ীদ রানা, বাংলাদেশ কৃষক ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট বদরুল আলম, নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেনসহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন।

এনএস/এমআইএইচএস/এমএস