ঘনঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া ও অত্যধিক শ্রমের মজুরির কারণে দিনদিন অলাভজনক হয়ে পড়ছে চাষাবাদ। তারপরও পেশা ছাড়ছেন না কৃষকরা। তারা বলছেন, পৈতৃক পেশা ছেড়ে তাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। এজন্যই তারা সাংসারিকভাবে ঋণগ্রস্ত হয়েও পেশা ছাড়তে পারছেন না। পেশা কৃষি হলেও তাদের সংসার চলছে অকৃষি খাতের আয় দিয়ে।
Advertisement
কৃষকদের টিকিয়ে রাখতে তাদের ভর্তুকি দেওয়ার ব্যবস্থা ও উৎপাদিত পণ্যের নায্যমূল্য নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন কৃষক সংগঠনের নেতারা। এজন্য ভোক্তা ও উৎপাদনকারীর মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের কথা বলছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা।
কৃষকদের কথা বলে জানা গেছে, এখন অকৃষি আয় ছাড়া সঞ্চয়ের কোনো উপায় নেই। কারণ চাষাবাদ চললেও জমি থেকে তারা কোনো লাভ পাচ্ছেন না। অনেকের হয়তো পারিবারিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে বা কারো সন্তান দেশের বাইরে আছেন। কেউবা কোনো চাকরি করছেন। একমাত্র তারাই একটু ভালো অবস্থায় থাকতে পারছেন। বাকিদের বিকল্প আয় না থাকায় তার পড়ছেন বিপাকে।
সুজানগর উপজেলার বিল গাজনা পাড়ের বোরো চাষি রফিকুল ইসলাম জানান, এবারও খরার কারণে ২০-৫০ শতাংশ পর্যন্ত অতিরিক্ত সেচ দিতে হয়েছে। এতে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। তারপরও ধানের স্বাভাবিক উৎপাদন ধরে রাখা যাবে না। ধানের উৎপাদন ১৫-২৫ শতাংশ পর্যন্ত কম হতে পারে।
Advertisement
তিনি বলেন, উৎপাদন খরচ বাড়লো আবার ফলন কম হলো। কিন্তু ধান বিক্রির সময় দর বাড়ানোর বিষয়টি কারো মাথায় থাকে না।
সদর উপজেলার দুবলিয়া গ্রামের চাষি আব্দুল খালেক বলেন, সরকারকে যেহেতু চাষি ও ভোক্তা উভয়কে দেখতে হয়, তাই চাষির ভর্তুকি দেওয়া উচিত। এতে দামও কম থাকবে আবার চাষিও লাভবান হবেন।
আরও পড়ুন: পেটের দায়ে রিকশা চালান ৮০ বছরের কানাই মাতুব্বর৭ দশক ধরে কামার পেশায় মজিবর রহমানশরবত বিক্রির টাকায় চলে সংসার, ৫ ভাইবোনের পড়ালেখার খরচ
সাঁথিয়া উপজেলার কুমিরগাড়ী গ্রামের কৃষক মহসিন আলী। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘ক্ষতি হলেও আমাদের ফেরার পথ নেই। আবার আমরা যে টিকে আছি সেটা কৃষিকাজ দিয়ে নয়। আমাদের পরিবারের কর্মজীবী অন্য সদস্যদের হয়তো কেউ ভ্যান চালায়, কেউ মাছ ধরে, কেউ বিদেশ থাকে বা কোনো সদস্য চাকরি করে। কৃষি থেকে ক্ষতি হলেও অন্য ক্ষেত্র থেকে হয়তো লাভ আসছে। সে কারণে হয়তো টিকে আছি। বর্তমান জীবনযাত্রার যে ব্যয় তাতে কৃষির আয় দিয়ে টিকে থাকতে পারতাম না।’
Advertisement
বিশ্বাসপাড়া গ্রামের খাজা আবু সাইদ বলেন, ‘চাষাবা করে লস হচ্ছে। কিন্তু চাষাবাদ বাদ দিয়ে যাবো কোথায়? বাপ-দাদা তো এ পেশায় ছিল। আমরা পারিই কৃষি। তাই অলাভজনক হলেও কৃষিকাজ করি।’
পদ্মবিলা গ্রামের কৃষক ডাবলু হোসেন আক্ষেপ করে বেলন, সরকার এত ভাতা দেয় কিন্তু চাষির ভাতা কই? যেভাবে ভাতা দেওয়া হচ্ছে তা অনেক ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় ও টাকার অপচয়। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সচ্ছল লোকজন শখ করে তুলে খায়। এসময় কৃষি প্রণোদনা বাড়ানোর দাবি জানান তিনি।
‘বছর ধরে হয়তো দু-চারটা গরু পালন করছি। হাঁস-মুরগি বা ছাগল পালন করছি। ছেলে বিদেশ রয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে হাতে কিছু টাকা আসে। সে টাকা দিয়ে আবার চাষাবাস করি। শুধু কৃষিকাজ করে সে টাকা দিয়ে চলা সম্ভব না’, বলেন আতাইকুলা থানার পদ্মবিলা গ্রামের নজরুল ইসলাম।
বামনডাঙ্গা গ্রামের চাষি আব্দুল মান্নান বলের, ‘ধানে লস বা সামান্য লাভ থাকে। পাট চাষে সমান সমান। পেঁয়াজে কখনো লাভ কখনো লস আর দুর্যোগ হলে সব শেষ। এভাবে চলি। কৃষিকাজে লস হওয়ায় জমি বন্ধক রেখেও অনেকে চাষ করেন। পৈতৃক পেশা তাই আমরা ছাড়তে পারছি না।’
বনগ্রামের যুবক শামীম আহমেদ বলেন, ‘কৃষিতেই বাপ-দাদারা সমৃদ্ধি পেয়েছিলেন। কিন্তু আমরা বাপ-দাদার কৃষিটি আর ধরে রাখতে পারলাম না। কারণ সেই কৃষি আর আজকের কৃষিতে অনেক তফাৎ।’
তিনি বলেন, ‘এখন বছর শেষে লাভ-ক্ষতির হিসেব মেলে না। তাই আমরা জমিজমা বছর চুক্তিতে লিজ দিয়ে দিই। সরাসরি কৃষিশ্রমিক যারা তারা সে জমি নিয়ে চাষবাস করেন।’
কৃষি ক্রমশ অলাভজনক হয়ে ওঠার কারণ প্রসঙ্গে পাবনার কৃষক সংগঠনের নেতারা জানান, ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির তুলনায় উপকরণ খরচের হার বেড়েছে। উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়ার হার উপকরণের দাম বাড়ার হারের চেয়ে কম। এছাড়া মধ্যস্বত্বভোগীদের মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি, কালোবাজারি ও মজুতদারিও দায়ী। উৎপাদকরা কম ও ব্যবসায়ীরা অধিক লাভবান হচ্ছেন।
দোতলা কৃষির উদ্ভাবক, পাবনার কৃষিবিদ অধ্যাপক জাফর সাদেক বলেন, ফসলি জমি চাষির অহংকার, তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। জমি ঘিরেই চাষির সব পরিকল্পনা। কিন্তু তাদের পৈতৃক পেশাটি আজ হুমকির মুখে।
তিনি বলেন, উৎপাদক ও ভোক্তা শ্রেণির মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের এমন ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে উভয়পক্ষই লাভবান হতে পারে। ফসল উৎপাদনে আগ্রহী এবং সরাসরি বাজারজাতকরণের মাধ্যমে মধ্যস্বত্বভোগীদের অপ্রয়োজনীয় প্রভাব কমানো সম্ভব।
ছোট, বড়, প্রান্তিক—সব কৃষকই ক্ষতির শিকার হচ্ছেন বলে জানান পাবনার খ্যাতিমান চাষি এবং বাংলাদেশ ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএ) কেন্দ্রীয় সভাপতি শাহজাহান আলী বাদশা। তিনি বলেন, চাষি এ পেশা ছাড়ছেন না। কারণ তার হাতে তো বিকল্প কোনো পেশা নেই।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের বিষয়ে তিনি বলেন, কৃষি ও কৃষককে বাঁচাতে হলে চাষিকে ভর্তুকি (সাবসিডি) দিতে হবে। চাষিকে জামানত ও সুদবিহীন ঋণ দিতে হবে। সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনায় কন্ট্রাক্ট গ্রোয়ার্স (চুক্তিবদ্ধ চাষি) বৃদ্ধি করতে হবে। এতে চাষির মুনাফা নিশ্চিত হতে পারে। এটা হলে চাষিকে তার পৈতৃক পেশা বদল করতে হবে না।
এসআর/জেআইএম